প্রিয় মাধবী,
আমি জানি, এই চিঠিটা তুই যখন পড়বি তখন আমি তোর কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে চলে গিয়েছি। এতটাই দূরে, যে দূরত্ব পাড়ি দেয়া তোর আমার কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। এই চিঠিটা যখন পড়বি ততদিনে হয়তো তোকে ‘প্রিয়া’ সম্বোধনের অধিকার আমি কবেই হারিয়ে ফেলেছি। কিংবা হয়তো হারাইনি। কে জানে! তুই এই চিঠিটা হয়তো পড়বি আজ থেকে অনেক অনেক বছর পরে। ততদিনে হয়তো আমি এভাবে গুছিয়ে চিঠি লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবো। হয়তো গুছিয়ে কথা বলার, এমনকি নিজের সামান্য কাজগুলোও অন্যের সাহায্য ছাড়া করার সামর্থ্য থাকবে না। কাজেই, তোকে না-বলা কথাগুলো আজই বলে রাখতে চাই।
আমি সবসময় বলতাম- নিজের মনের কথা কখনও মনের ভেতর রেখে দিতে নেই। আমি কখনও কোনো কথা চেপে রাখতে পারতাম না। হয়তো একটু বাচালই ছিলাম! জানিনা... তবে সে কারণেই হয়তো একদিন ধুপ করে তোকে ‘ভালোবাসি’ বলে ফেললাম। বাচাল না হলে এভাবে বলতে পারতাম না। তোর কি মনে আছে সেদিনের কথা? তুই কোনো উত্তর দিসনি। কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে চলেও যাসনি। খানিকটা অবাক হয়ে এক দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলি অনেক্ষণ। মনে পড়ে তোর? আমার কিন্তু বেশ মনে পড়ে সেদিনের কথা এখনও! সেদিনের পর থেকে বহুদিন পর্যন্ত তোর কাছ থেকে আমি কিছুই লুকাইনি। তোর আর আমার মাঝে কোনো না-বলা কথা ছিলো না। কিন্তু কে ভেবেছিলো বল- যে একদিন তোর আমার মাঝের যোজন যোজন অন্ধকার হাঁ করে আমাদের গিলতে আসবে? কে ভেবেছিলো- কথা না-বলা, নিশ্চুপ নিস্তব্ধতাই আমাদের প্রতিদিনকার ভাষা হয়ে যাবে?
আমি জীবনকে অনেক সহজ সমীকরণে দেখতাম। কিংবা অন্তত আমার তা-ই ধারণা ছিলো। ঠিক কবে, কখন যে আমার সেই সমীকরণ আর সহজ রইলো না- মনে নেই। বাবার রিটায়ারমেন্ট, ছোট বোনের পড়াশোনা, মায়ের অসুস্থতা, আমার পিএইচডি, ক্যারিয়ার, পাশ্চাত্যের অপার সম্ভাবনার হাতছানি- এত সব হিসেব-নিকেশের মাঝে কবে যে সবকিছু জটিল করে ফেলেছি- টের পাইনি। তুই আমার সাথেই ছিলি সবসময়। শরীরে, মনে- সাথেই ছিলি। কিন্তু আমিই ধীরে ধীরে দূরে সরে গিয়েছিলাম হয়তো। তখন টের পাইনি। আমি আমার নিজেরই তৈরি জটিল জগতে সব কঠিন কঠিন ইকুয়েশন সমাধান করতে করতে সেগুলোর মাঝেই হারিয়ে গিয়েছি কোনো একদিন। আজ তুই আমাকে আর দেখতে পাস না- তাতে অবাক হবার কিছু নেই। ধীরে ধীরে আমি নিজেই নিজেকে হারিয়ে ফেলছি...
আচ্ছা, সত্যি করে বল তো, আমি যেদিন তোকে বললাম- “আমি আর তোকে ভালোবাসি না”, তুই কি আমার মিথ্যেটা ধরতে পেরেছিলি? তুই কি ঠিক বুঝে গিয়েছিলি- যে আমি তোর চোখে চোখ রাখিনি- কারণ ওভাবে মিথ্যে বলতে পারিনা আমি? বুঝেছিলি- আমার তাড়া ছিলো বলে কথাটা বলেই তাড়াতাড়ি সরে পড়িনি, বরং- ছেলেদের পাবলিক প্লেসে কাঁদতে হয় না বলেই... আমার ধারণা তুই সব বুঝে গিয়েছিলি- তাই কোনো উত্তর করিস নি। যেদিন ‘ভালোবাসি’ বলেছিলাম, সেদিনকার মত এক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলি আমার দিকে... আমিই চোখ তুলে তাকাতে পারিনি।
(চলবে...)