আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি ২০০৪-২০০৯ সময়টুকু। বিএনপি সরকার এবং তৎপরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছিলো অনেকটা যুদ্ধক্ষেত্রের শামিল। প্রায় প্রতিদিন খবরে শিরোনাম হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কথায় কথায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যেত প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। খোলা থাকলেও কখনো শিক্ষকরা, কখনো ছাত্ররা, আবার কখনো কর্মচারীরা ধর্মঘট ডেকে ক্যাম্পাস অচল করে দিতেন। প্রতি বছর আমরা কয়েক মাস পিছিয়ে যেতাম। ডিপার্টমেন্ট অনার্স এবং মাস্টার্স মিলিয়ে ৮ টি ব্যাচ ছিলো। আমরা তাদেরকে 'ফার্স্ট ইয়ার ওল্ড, ফার্স্ট ইয়ার নিউ, সেকেন্ড ইয়ার নিউ'- ইত্যাদি বলে ডাকতাম।
সে সময় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কোনো ইনকোর্স ছিলো না। সনাতন পদ্ধতির পরীক্ষাব্যবস্থা ছিলো, গ্রেডিং সিস্টেম ছিলো না। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি তো হতো, কিন্তু তারপর তারা জানতো না- কবে পাস করবে, করে বেরোবে- কিংবা আদৌ বেরোবে কিনা।
'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি'- বললেই তখন সবার মুখের অভিব্যক্ত পরিবর্তন হয়ে যেতো- যেন আমরা জেলফেরত দাগী অপরাধী। সবার মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে 'ছিঃ ছিঃ' শুনতাম। নিজেকে অনেক নীচু মনে হতো। মনে হতো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা পড়েননি, তাঁদের সবার একটা বিজাতীয় ঘৃণা রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের উপর।
লোকমুখে শুনেছি, এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিদিন খবরের শিরোনাম হয় না। এখন কেউ ধর্মঘট ডাকে না, অনির্দিষ্টকালের জন্য ভার্সিটি বন্ধও হয় না। ৪ বছরের কোর্স ৪ বছরে শেষ হয়। দলমতনির্বিশেষে সকল শিক্ষক এক হয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে করেই হোক প্রাচ্যের অক্সফোর্ডকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে; কিছুতেই বন্ধ হতে দেয়া যাবে না। তাই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড চলছে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, দেশের এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এরকম অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন যেন সকল ছিদ্রান্বেষী সমালোচকের চোখ এড়িয়ে গেলো। কেউ যেন দেখেও দেখলেন না- শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীদের এই সম্মিলিত প্রয়াস এবং অসাধারণ অর্জন। সবাই মুখ ফিরিয়ে অন্য খবরে ডুবে রইলেন। কেউ প্রশংসা করলেন না। খবরের কাগজে কোনো সম্পাদকীয় লেখা হলো না এ নিয়ে। মনে হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি সবার বিজাতীয় ঘৃণা বুঝি আজও বর্তমান। ভাবতে কষ্ট হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:০০