somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হালের বলদের সেকাল একাল

২০ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১০:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কৃষিতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সাথে প্রায় অবলুপ্ত হয়েছে পশু দিয়ে হালচাষ। পুরো বিশ্বের কৃষি নির্ভর দেশগুলোতে ফসল উৎপাদনের জন্য এক সময় বলদ গরু, ষাড়, মহিষ এবং ঘোড়া দিয়ে জমিতে হাল দেওয়া হতো। বিশ্বে ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের সূচনা ঘটার পর কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়। তবে বাংলাদেশের কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় আশির দশক থেকে। কৃষিতে আধুনিকায়নের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত গরুই ছিলো জমিতে হাল দেওয়ার একমাত্র অবলম্বন। আশির দশক থেকে নব্বই দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত কৃষি কাজে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর এবং গরু দিয়ে হালচাষ মোটামুটি সমানভাবে চলতো। দিন বদলের সাথে সাথে এখন সিঁকিভাগ জমিও গরু দিয়ে হাল দেওয়া হয় না। তবে যেসব জমিতে যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না সেসব জায়গায় এখনও বলদ দিয়েই জমিতে হালচাষ করা হয়। মূলত এভাবেই কোথাও কোথাও টিকে আছে প্রায় বিলুপ্ত বাঙালি এবং বাংলার অগুণন বছরের এই ঐতিহ্য।


গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য গরু দিয়ে জমিতে হালচাষ করার জন্য ব্যবহার করা হয় লাঙ্গল। লাঙ্গলকে আদিম কৃষি যন্ত্র বলা হয়। এর দুটো অংশ থাকে। একটি কাঠের তৈরি জোয়াল আর একটি লোহার ফলা। কাঠমিস্ত্রিরা এই লাঙ্গল তৈরি করতো। দুটো গরুকে পাশাপাশি রেখে তাদের ঘাড়ের উপর কাঠের তৈরি জোয়াল সাঁটিয়ে বেধে দেওয়া হয় আর নিচের অংশ ফলা থাকে মাটির সাথে গেঁথে। গরুর কাঁধে জোয়াল বেঁধে দেওয়ার কারণে হাঁটার সময় মাটিতে গেঁথে যাওয়া ফলাও চলতে শুরু করে। বার বার একই সময় জমিতে গরু কাঁধে করে লাঙ্গল টানার কারণে ফলার আঘাতে মাটি ওলট পালট হয়ে যায়। এভাবে মাটিকে বার বার ওলট পালট করার কারণে মাটির নিচের স্তরের পুষ্টিগুণ উপরে এবং উপরের স্তরের আগাছাসহ জমিতে গজে উঠা বিভিন্ন উদ্ভিদ নিচে চলে যায়। এর ফলে জমিতে জৈব সার তৈরি হয়। এছাড়া মাটিতে বায়ু চলাচলের পরিমাণ বাড়ানো এবং মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখার কাজটাও ঠিকঠাক হয়। এখানে বলে রাখা ভাল, যখন হালের জন্য গরুই ছিলো একমাত্র অবলম্বন তখন জমিতে নিয়ে যাওয়ার আগে কৃষকরা হালের গরুগুলোকে বেশি করে খাবার খাওয়াতেন। কারণ হাল দেওয়ার সময় গরুর থেকে গোবর জমিতে পড়লে জমিতে নির্ভেজাল জৈব সার উৎপন্ন হতো। এই সার জমির উর্বরা শক্তি এবং পুষ্টিগুন বৃদ্ধি করতো। যে কারণে এটিকে পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতিও বলা হয়।


কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে জমিতে কমে গেছে প্রাকৃতিক জৈব সারের পরিমাণ এবং এর সাথে জীবিকা নির্বাহকারী ব্যক্তিদের আয়ও। কারণ সে সময় বাণিজ্যিক ভাবে জমিতে হালচাষ করা হতো। অনেক কৃষক শুধুমাত্র হালচাষ করার জন্য আলাদাভাবে বলদ গরু পালন করতেন। নিজেদের জমিতে হাল দেওয়ার পর অন্যের জমিতে হাল দিয়ে বাড়তি আয় করতে পারতেন। কিন্তু গরু দিয়ে হালচাষ কমতে শুরুর সাথে সাথে হালচাষ পেশার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরাও অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। অনুরূপভাবে কাঠমিস্ত্রিরাও চাহিদা না থাকায় এখন খুব একটা লাঙ্গল আর তৈরি করেন না।
তবে ধানচাষের মৌসুমে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে গেলে কোন কোন জায়গায় হঠাৎই দেখা মিলতে পারে বলদ দিয়ে হালচাষের দৃশ্য। যেমন হঠাৎই সেদিন দেখা মিললো বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কদমতলী গ্রামের একটি দিগন্ত জোড়া মাঠে। দূর থেকে এমন অপরূপ দৃশ্য দেখার পর কাছে যেতেই হালচাষ করার ব্যক্তির হুররর হুশ হুশ শব্দ কানে বেজে উঠলো। ট্রাক্টর আর পাওয়ার টিলার আসার পর গরু দিয়ে আর মানুষ চাষ করতে চায় না। দুটো বলদ গরু হাট থেকে কিনেছেন ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে। ৫ বছর ধরে দুটো বলদ গরু দিয়ে হাল দিচ্ছেন। জিজ্ঞেস করতে আব্দুল খালেক নামের এই কৃষক গটগট করে কথাগুলো বললেন।


গরু দিয়ে জমিতে হালচাষ গ্রাম বাংলার চিরচেনা ঐতিহ্য। যেহেতু এখন সনাতন পদ্ধতির এই হালচাষ নেই। তাই এই ঐতিহ্যটিও হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্যকে যেন মানুষ ভুলে না যায় সে কারণে গত কয়েক বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঐতিহ্যবাহী হাল দৌড় প্রতিযোগিতা হচ্ছে। মূলত গরু দিয়ে কিভাবে জমিতে হাল দেওয়া হতো সেটা নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো দেখতে পারেননি। তাদের কাছে এটি তুলে ধরারই একটি প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তি নির্ভর। নতুন প্রজন্মের জন্য নিত্য নতুন বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন প্রযুক্তির আবিষ্কারও হচ্ছে। প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ মানুষ এবং প্রাণীর জীবনের জন্য সব সময়ই আশির্বাদস্বরুপ এটি অনস্বীকার্য। যেমন ব্রিটিশ শাসনামলে নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, জীবন দিয়েও প্রজারা সে সময় সম্পূর্ণভাবে নীলচাষ করা থেকে বাঁচতে পারেনি। কিন্তু জার্মান প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃত্রিম কৌশলে উৎপাদিত কেমিক্যালের সিনথেটিক নীলের কল্যাণে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরা নীলের ব্যবসা ও চাষ গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। নীলচাষ থেকে রক্ষা পায় প্রজারা। অনুরূপভাবে সবুজ বিপ্লবের ফলে কৃষিতে প্রযুক্তির কল্যাণে হালের এই বলদ গরুগুলো মুখে গোমাই লাগিয়ে অনবরত এক নিদারুন কষ্ট সহ্য করে যাওয়া থেকে মুক্তি পেয়েছে।

ছবিঃ আমার তোলা।

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১০:২১
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দেশনায়ক তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে  

লিখেছেন এম টি উল্লাহ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৮


আগেই বলেছি ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং আওয়ামীলীগের যবনায় জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পৌনে একশ মামলা হলেও মূলত অভিযোগ দুইটি। প্রথমত, ওই সময়ে এই প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল দেশনায়ক তারেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পকে নিয়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****

ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ

লিখেছেন সরলপাঠ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠেলার নাম বাবাজী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩১

এক গ্রামীণ কৃষক জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাবে। লোকটি ছিলো ঠোটকাটা যখন তখন বেফাস কথা বা অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে ক্যাচাল বাধিয়ে ফেলতে সে ছিলো মহাউস্তাদ। এ জন্য তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×