(দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব)
মা এমনিতেই বিড়াল পাখি বাড়িতে পছন্দ করেন না। পরিবেশ নোংরা করে এজন্য। তারপরেও ওটাকে ধরে বাড়িতে আনলাম। মা দেখার পর কিছুক্ষণ চিৎকার করলেন, কিন্তু আমার জেদের কাছে হার মেনে গেলেন। তখন আমার রাত দিন যায় কবুতরটার পেছনে। এরমাঝেই ওর নাম ‘পরী’ রেখে ফেলেছি। বড় আপু, মেজো আপু ওর পরী নামটা খুব পছন্দ করেছে। আমি ওটার সাথে খেলতাম তাদের বিরক্ত করতাম না জন্য ওরাও নিশ্চিন্তে থাকতো। আমাকে খুশি করার জন্য মাঝে মাঝে ওরা পরী’কে খাবার দিতো। তারা বলে দিয়েছে ঠিকমতো পড়ালেখা করলে বাইরে যেতে না চাইলে আমাকে পরীর যত্ন নিতে দেবে আর পরীর জন্য একটা সঙ্গী এনে দেবে। আমি সে খুশিতে বিরক্তি স্বত্ত্বেও সন্ধ্যের পর থেকে রাতের খাবারের আগ পর্যন্ত পড়া ছেড়ে উঠতাম না। খুব সকালে উঠে পরীকে খাইয়ে দাইয়ে আবারো স্কুলে যাওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত পড়তাম। বিকেলে বাড়ি থেকে বের হওয়া ছেড়েই দিয়েছি প্রায়। মাঝেমধ্যে দু’ টাকার মোটা চানাচুর কিনতে বের হতাম। এর মধ্যে একদিন আমাদের এক আত্মীয় বাসায় এলেন। আমি তখন পরীর ঘর পরিষ্কার করছিলাম। ঘরটা সেরকম জুতের ছিলো না। একটা প্লাস্টিকের ডালা রশি দিয়ে বারান্দার এক কোণে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম মাত্র। সেখানেই ব্যস্ত ছিলাম। ভাইয়া আমার কাজ দেখে কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, কবুতর তো আমার বাসায় অনেকগুলো। দেখি তোমার এটা কি কবুতর। আমি পরীকে ভাইয়ার হাতে তুলে দিলাম। তিনি দেখে বললেন এটা মাদি কবুতর। আমি বললাম, আমাদেরও এটাকে মাদি মনে হয়েছে। তাই এটার নাম ‘পরী’ রেখেছি। তিনি বললেন, খুব ভাল, তোমার আর কোন কবুতর নেই? আমি বললাম নেই। তিনি বললেন, তোমাকে একটা সাদা রঙের কবুতর দেবো। আমি তার মুখ থেকে এই কথাটাই যেন শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তিনি কথাটা বলার পর থেকেই জেদ করে বসলাম তার সাথে। সেদিন তিনি চলে গেলেন।
বেশ ক’দিন কেটে গেলো। ভাইয়াটা আসছে না। সেদিন ভাইয়া যাওয়ার পর মনে মনে কত কল্পনা করলাম পরীর জন্য। নতুন কবুতরের জন্য আলাদা একটা থাকার বন্দোবস্ত করলাম। কিন্তু কই? ভাইয়া আসে না। এরমধ্যে একদিন আমি স্কুল থেকে ফিরছিলাম, দূর থেকে দেখি ভাইয়া একটা সাইকেলে বসে এক পা মাটিতে দিয়ে আমাদের বাড়ির দরজার সামনে মা’র সাথে কথা বলছেন। ভাইয়াকে দেখেই দৌড়ে চলে এলাম। এসেই ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার কবুতর? তিনি বললেন, বাবু আজ কবুতর আনতে পারিনি। মন ভার করে ভাইয়ার সাথে আর কথা বললাম না। পরদিন সকালে অবশ্য ভাইয়া সাদা রঙের একটা গিরিবাজ কবুতর দিয়ে গিয়েছিলেন। আমি ওটাকে ভালমতো খাঁচায় বন্দি করে স্কুলে চলে গিয়েছিলাম। স্কুলে গিয়েও চলতো বন্ধুদের সাথে আমার কবুতর নিয়ে গল্প। ফিরোজ, মানিক, মামুনুর এরাও মনোযোগ দিয়ে শুনতো। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে নতুন কবুতরের পাখা ছেঁটে দেবার পর ওর নাম রেখেছিলাম বাহাদুর। প্রথম প্রথম পরী ও বাহাদুরকে পাশাপাশি ঘরে আলাদা করে রেখেছিলাম। ক’দিন বাদে ওই ভাইয়ার পরামর্শে তাদের এক ঘরেই থাকার বন্দোবস্ত করি। যেদিন প্রথম ওদের এক ঘরে রাখলাম, সেদিন কি কান্ড! সারারাত বাহাদুর বাক বাকুম করে ডেকেছে আর তাদের ঘরের মধ্যে পাখা ঝাপ্টানোর শব্দ করেছে। পরদিন সকালে উঠে ওদের ঘর থেকে বের করে মন খুব ভার হয়েছিল। কারণ, বাহাদুর তার ঠোট দিয়ে ঠকরিয়ে পরীর চোয়ালের একপাশের সবগুলো পালক প্রায় উঠেই ফেলেছিল। ভয় পেয়ে তারপর থেকে আর বাহাদুরকে পরীর ঘরে থাকতে দেইনি। পরে ভাইয়ার সাথে আবারও দেখা হওয়ার পর বিষয়টি জানালে তিনি বললেন, ভুল করেছো। ওরকম প্রথম দু’একদিন ওরা ঝগড়া ঝাটি করেই। তারপর যখন দু’জনের মধ্যে প্রেম হয়ে যাবে, তখন দেখো কি কান্ড হয়। ওদের চেয়ে আপন মনে হয় আর কেউ নেই এমনটা তোমার কাছে মনে হবে। তারপর সেদিনই আবারও পরী আর বাহাদুরকে এক ঘরেই রেখে দিই। আবারও বাহাদুরের সারারাত অবধি ডাকাডাকি আর পাখা ঝাপ্টানো শব্দ। আমি সেদিক খেয়াল না করে তাদের ওরকম করেই রেখে দিই।
এদিকে পরীর উপড়ে ফেলা পাখা প্রায় গজে উঠেছে। পরী এখন নিজে নিজেই উড়ে টিনের চালায় যায় আবার ঘরে ফিরে আসে। পরী বাড়ি চিনে গেছে আমার আনন্দের সীমা নেই। বাহাদুরের পালকও মোটামুটি গজিয়েছে। এরমধ্যে পরী আর বাহাদুরের মধ্যে প্রেমটাও হয়ে গেছে। একদিন স্কুলে যাবার আগে পরী আর বাহাদুরকে টিনের চালায় উঠিয়ে খাবার ছিটিয়ে আমি চলে যাই। বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পর শুধু পরীকেই সেদিন পেয়েছিলাম বারান্দার এক কোণায়। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ওর মন ভার। তারপর ভাল করে খুঁজে বাহাদুরকে আর পাইনি। তখন বুঝতে পেরেছি হালকা পাখা গজাতেই বাহাদুর পরীকে রেখে পালিয়ে গেছে। ভুলটা আমারই ছিলো। ঠিকমতো বাড়ির প্রতি মায়া না হতেই এবং বাড়ি না চিনতেই আমি ওকে টিনের চালায় ছেড়ে দিয়েছি। তারপর এরকম ভুল আর কখনও হয়নি।
বাহাদুর চলে যাবার ক’দিন বাদেই হাটে গিয়ে পরীর জন্য রাজকুমারকে কিনে আনি। রাজকুমারের গায়ের রঙও সাদা ছিলো। কিছুটা বাহাদুরের মতোই দেখতে। তবে রাজকুমার অন্যরকম স্বরে ডাকতো। রাজকুমার আর পরীর মধ্যে প্রণয় জাগাতে সময় লাগেনি। ততদিনে আমি বুঝে গিয়েছি নর আর মাদি কবুতরের মাঝে কিভাবে জোট বাধানো যায়। অল্প দিনের মাঝেই পরী ডিম দেয়। ডিম থেকে দুটো বাচ্চা বেরিয়ে আসে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।
তখন বৈশাখ মাসের প্রথম ক’দিন যাচ্ছে। সেবার কালবৈশাখী একটু বেশিই হয়েছে। আমরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সেটা ছিলো টিনের চালার। কালবৈশাখী ঝড়ের কারণে আমাদের টিনের চালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেহেতু ভাড়া বাড়ি তাই পাশের এলাকার একটি দো’তলা বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিই আমরা। নতুন বাড়িতে ওঠার আগেই বাড়িওয়ালা’র সাথে পরিষ্কার কথা বলে নেয়া হয়েছিল ছাদে আমার কবুতরের ঘর থাকবে, আপনাদের কোন সমস্যা হবে কি না। কোন সমস্যা হবে না জানানো পর কবুতরের ঘরটা ছাদেই রাখা হবে ঠিক করি। বাড়ি পাল্টানোর পর আমার মা আর আপুরা বাড়ি সাজাতে যখন ব্যস্ত তখন আমি কবুতরের ঘর ঠিকঠাক ছাদে গড়ে নেয়ার পর খাচায় রাখা পরী, রাজকুমার আর তাদের দুটো বাচ্চাকে ঘরে রাখার জন্য খাঁচা থেকে বের করছিলাম। রাজকুমারের পাখা সুতা দিয়ে বেধে দিয়েছিলাম ঐ এলাকার ছোট্ট ছেলের সহযোগিতায়। ওকে রাজকুমারকে ধরতে দিয়ে আমি সুতা পেঁচিয়ে ওর পাখা বেধেছি। কিন্তু বিপত্তিটা হয়েছিল পরীকে নিয়ে। পরীকে খাঁচা থেকে বের করে ওই ছেলেটাকে ধরতে দিতেই পরী কেমন করে যেন ওর হাত থেকে ফোসকে উড়ে যায়। তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে প্রায়। ছাদ থেকে শুধু দেখতে পেলাম ও অনেক দূরের একটি ৪ তলা ছাদে গিয়ে নামলো। কিন্তু সন্ধ্যের সময় আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেবে না, আর ছাদে তো কোনভাবেই উঠতে দেবে না। আমার বুকের ভেতর চরম অস্থিরতা কাজ করছিল। রাজকুমার আর তাদের বাচ্চা দুটোকে খাইয়ে পুনরায় খাচায় রেখে নিচে গেলাম। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে পরীর জন্য চোখ বেয়ে জল নেমে এসেছে অনেকক্ষণ।
পরদিন ঘুম ভাঙার পরও মন একটুও ভাল হয়নি। খুব সকালেই রাজকুমার আর বাচ্চাগুলোকে খাবার দেবার জন্য ছাদে যাওয়ার খানেক বাদে দেখি আমাদের বিল্ডিংয়ের উপড় দিয়েই পরী উড়ে বেড়াচ্ছে। ওকে দেখেই মন আনন্দে নেচে উঠলো। পরী উড়তে উড়তে পাশেই একটা বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠার ছাদে গিয়ে পড়ে আমাদের এদিকে দেখছিল। আমি কাউকে কিছু না জানিয়ে পা টিপে টিপে বাড়ির বাইরে গিয়ে পরীকে ধরার চেষ্টা করি। কিন্তু কাছে যেতেই সে উড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে আর তাকে ধরতে পারিনি। ব্যর্থ হয়ে ফিরতে ফিরতে একটা ফন্দি আটি। তারপর দ্রুত বাড়ির ছাদে এসে রাজকুমারসহ বাচ্চাদের খাঁচায় ভরিয়ে আমাদের সিঁড়ি ঘরের ছাদের উপর রেখে দিই। খুব আশ্চর্য করেছিল পরী সেদিন আমাকে। ওদেরকে ছাদে রাখতেই পরী খাঁচার কাছে এসে হাজির। তারপর আমি খাঁচা নামানোর পর পরীও নিচে নেমে আসে। এর একটু পর রাজকুমারকে খাঁচা থেকে বের করে খাবার দিই। পরী খুব কাছে চলে এলে ওকে ধরে ফেলি। তারপর আর পাখা সুতা দিয়ে বাধতে যাইনি। দু’পাশের পাখার সামনের দুটো করে পালক রেখে দিয়ে বাকি পালকগুলো উপড়ে দিই। সাধারণত পালক উপড়ে দেয়ার পর নতুন পালক গজিয়ে উঠে উড়তে পারবে এমন অবস্থা হওয়ার পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে কোন কবুতর বাড়ি চিনে যায়। তবে অনেক কবুতর তার আগেও চেনে। যদি ছাদ হয় সেক্ষেত্রে দ্রুত নিজের এলাকা চিনতে সুবিধে হয় কবুতরদের।
নতুন বাড়িতে ওঠার পর আরো বেশ কিছু কবুতর হাট থেকে কিনেছি। যাদের প্রত্যেকের নামও রেখেছি। খুব সুন্দর দেখতে যে কবুতরটা ওর নাম পিহু। তখন ও ছোট ছিল। আর দেখতেও মাদি কবুতরের মতো ছিল। তাই তাকে মাদি কবুতর ভেবে রোমিও নামের আরেকটি নর কবুতরের সাথে এক ঘরে রেখেছিলাম। ক’দিনের মধ্যেই ওদের মধ্যে প্রেম হয়। ভেবেছিলাম পরীর মতো পিহুও ডিম দেবে। বাচ্চা দেবে। কিন্তু ক’দিন বাদে বুঝতে পারলাম পিহু মাদি না। ও নর কবুতরদের মতো ডাকাডাকি করে। পুরোপুরি সে নর সাব্যস্ত হওয়ার পর তার নাম পাল্টে প্রিন্স রাখি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও রোমিও আর প্রিন্সের মাঝের প্রেম ভাঙতে পারিনি। প্রিন্স রোমিওকে এড়িয়ে চললেও রোমিও প্রিন্সের পিছু ছাড়তো না। মন খারাপের কথা হলো দোতলায় একটা মোটা মহিলা আর টেকো স্বামী বসবাস করতেন, আমরা জানতে পেরেছিলাম প্রিন্স আর রোমিকে একদিন তারা ভাতের সঙ্গে খুব আয়েশ করে পেটে পুরেছেন। সে কথা থাক! পরী একবার হাত ফোসকে উড়ে যাবার কারণে ওর পাখাটা উপড়ে ফেলি যাতে করে সে আর উড়ে যেতে না পারে। কিন্তু পালক উপড়ে ফেলাটাই আমার এবং পরীর জন্য এক বুক কষ্ট ডেকে আনে। ওর পালক উপড়ে ফেলার সপ্তাহ খানেক পর এক দুপুরে ওদের খাবার দিতে গিয়ে দেখি পরী নেই। ছাদের কোথাও নেই! খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে পরীকে। প্রিন্স, রোমিও, রাজকুমার আর পরীর দুটো বাচ্চা ছাদে এবং তাদের ঘরে আছে। ছাদের চারদিক ঘুরে ফিরে কোথাও খুঁজে পাইনি পরীকে। পাশের বাড়ির আন্টিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, তিনি দেখেছেন একটা কাক নাকি আমার কবুতরদের তাড়া করেছিল। তখন নিচে পড়ে গিয়ে থাকতে পারে। আন্টির কথা শোনার পর নিচে জঙ্গলের ভেতরসহ চারপাশে তন্ন তন্ন করেও খুঁজেও পরীকে পাইনি সেদিন। অবশেষে পরীকে পরদিন ঠিক দুপুরেই ফিরে পাই আমাদেরই বাড়ির পেছনের ড্রেনের খুব কাছে। পরীকে সেদিন পেয়েছিলাম, পরীকে আমি দেখেছি, কিন্তু পরী আমাকে দেখতে পারেনি, পরীর জন্য আমার যে ভালবাসা তাকে বোঝাতে পারিনি, পরীর জন্য আমার কান্না পরীকে দেখাতে পারিনি। পরী পড়ে ছিল মাটিতে, তার বুকে কলিজা ছিলো না। তার ঘাড়ের সাথে মাথা ছিলো না!!
ছবিঃ আমার কবুতর জোড়ার। ২০১৫ সালে কিছু কবুতর বাসায় রেখেছিলাম। এরপর আর রাখার সুযোগ হয়নি। সুযোগ হলে আবারও রাখার ইচ্ছে আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০২০ রাত ১২:৫১