আমার আম্মা। ১৫ বছর বয়েসে বাবার সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন। আমার নানার ৫ সন্তান ছিল। আম্মা ছিলেন দ্বিতীয়, আম্মার বয়স যখন ১৪/১৫ বছর তখন নানার এক এক্সিডেন্টে তার এক সাইড প্যারালাইসড হয়ে যায়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি যখন ঘরে বসে যায় তখন ওই পরিবারের উপর কি ঝড় বয়ে যায় তা সবাই জানে। আত্মীয়স্বজন তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুখ ফিরিয়ে নেন। আর কে কার জন্য এত করে। যাই হোক...
বড় মামার খুব আদরের বোন ছিলেন আম্মা। দেখতে সুন্দর ছিলেন না, তাই মনের মাঝে তার খুব কষ্ট ছিল আজীবন। মামার হাত ধরে ঢাকায় চলে আসেন, ভর্তি হন নার্সিং ট্রেনিং এ, সেই সাথে পড়াশোনাও চালিয়ে জান। চাকুরী হয়, মাসে মাসে বাড়িতে এই দুই ভাইবোন টাকা পাঠান আর খুব কষ্ট করে ঢাকাতে থাকতে লাগলেন। ছোট ভাইবোনদের পড়াশোনার খরচও বহন করলেন আমার বড় মামা আর আম্মা। অনেক সুন্দর হাতের কাজ জানতেন, মানুষের জামা কাপরে নক্সা করে দিয়ে বাড়তি কিছু টাকা উপার্জন করতেন। ছোটবেলা থেকেই নামাজী ছিলেন আর ছিলেন অসম্ভব পরিশ্রমী। বই পড়তে অনেক ভালবাসতেন, আমাদের ঘরে ভাল কাপরের চাইতে অনেক অনেক বই দিয়ে ভরা শুধুমাত্র আম্মা আব্বুর জন্য।
চাকুরীর সুবাদে একদিন আব্বুর সাথে পরিচয়, সেই থেকে আব্বু আম্মাকে পছন্দ করলেন আর তার পরিবারকে জানালেন। আমার আব্বু ছিলেন অনেক বেশি সুন্দর আর নামকরা পরিবারের একজন। আব্বু সরাসরি তার পছন্দের কথা দাদাকে বললেন। দাদা আম্মাকে দেখে পছন্দ করলেন। যদিও আব্বুর পাশে আম্মা ছিলেন একদম বেমানান। কিন্তু আমার দাদার কথা ছিল "এই উড়নচণ্ডী ছেলের জন্য এই গুণবতী মেয়েই দরকার"
আম্মার সুখের দিন শুরু হল। আমাদের সংসারে খুব অভাব ছিল, কিন্তু আম্মা কেমন করে জানি সব অভাবকে সামলে নিতেন। আব্বু আম্মাকে অনেক সন্মান করতেন। কিন্তু তার দুস্টমির কমতি ছিল না। আমরা আমাদের পরিবারের মাঝেই সব সুখ খুঁজে নিতাম। অভাবকে আমরা তাই হাসিমুখে পাশকাটাতে শিখেছি ছোটবেলা থেকেই। আমরা চার ভাইবোন দেখতে আব্বুর মত হয়েছি। আমাদের মুখের দিকে তাকাতেন আর বলতেন "তোমাদের পেটে নিয়ে আমি আল্লাহর কাছে একটাই দোয়া করেছি তোমরা যেন দেখতে আমার মত না হও, আল্লাহ আমার কথা শুনেছে" বুঝতাম নিজে অসুন্দর হবার দুঃখটা তার কত গভীর ছিল !!
ডায়াবেটিক এর কারনে আম্মার মৃত্য হয়। তার দুই পা ভিতর থেকে মাংসে পচন ধরেছিল। অনেক চেস্ট করেও তাকে বাঁচানো গেল না। মারা যাবার কদিন আগে আম্মার পাশে আমি শুয়ে আছি, আম্মা আমার মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছিলেন "তুমি দেখতে তোমার আব্বুর মত আর তোমার দাদার মত"
আমি আম্মাকে বললাম "আম্মা সারাজীবন তোমাকে নামাজ বাদ দিতে দেখিনি, কারো কোন ক্ষতি করতে দেখিনি, অনেক কষ্ট করেছো, তাহলে মৃত্যুর সময় আল্লাহ তোমাকে এত কষ্ট দিচ্ছেন কেন? এটা কেমন বিচার"
আম্মার উত্তর ছিল, "এভাবে বল না, এটা আমার জন্যই ভাল, মানুষ মাত্রই কিছু না কিছু পাপ করে, মৃত্যুর সময় আল্লাহ তাদের কষ্ট দেয়া মানে সেই অনিচ্ছাকৃত পাপ গুলোর শাস্তি তাকে দুনিয়াতেই দিয়ে দিল, পরকালের আজাব কমে গেল।"
আজ মা দিবস। আমার মা নেই কিন্তু তার অস্তিত্ত আমাদের মাঝে বিদ্যমান। পৃথিবীর সকল মা কে মা হবার অসম্ভব গৌরবের জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা !!
~~ আনন্দধারা
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৬ রাত ৮:৫০