বৃষ্টির ফোটা পড়লো মুখের উপর। ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। ট্রেনের জানালায় হাতের উপর মাথা দিয়ে ঘুম দিয়েছিলাম। দিয়েছিলাম বললে ভুল হবে। ঘুম এসে পরেছিল। কাল রাতে অনেক পড়েছি, তাই। এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। তাই, যে শিক্ষার্থী সারা বছর কিছু পড়েনি, তার জন্যও পড়াশুনা এই সময়ে বাধ্যতামূলক।
বরাবরের মতো আমরা ট্রেনে দস্যুগিরি ফলিয়ে সিট রিসার্ভ করে সব বন্ধুরা একসাথে বসে চলে এসেছি ঢাকা। আমি জানালার পাশে। আমি উল্টা পাশের জানালায় শাওন। এই ছেলে জানালার পাশে সিট ছাড়া ট্রেনে যেতে চায় না। অগত্যা, ওকে যাত্রাসঙ্গী করার জন্য কাউকে না কাউকে জানালার পাশের লোভনীয় সিটটা ছেড়ে দিতে হয়।
শাওনের পাশে আলামিন। আলামিন যেখানে আইফোন সেখানে। আইফোনে গেম খেলার ইচ্ছা সবার। তাই সবাই ওর পাশে বসতে চায়। আর আলামিন একটু পরে পরে ট্রেনে আমাদের ছবি তুলতে থাকে। আর আমরাও পোজ দেওয়ার জন্য অলটাইম রেডি।
আমার পাশে কনক। আমার পিঠের উপর হেলান দিয়ে গান শুনছিল। কনক একটু গান পাগল। তার হেডফোনে সবসময় একটা গানই বাজতে থাকে। “ইশক ভি কিয়া রে মাউলা, দার্দ ভি দিয়া রে মাউলা”। বুঝা যায়, ছেলে প্রেমে পরেছে তো পরেছে, আর উঠতে পারছে না !!!
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের ট্রেনের সিটগুলা আমাদের মতো GROWN UPS দের জন্য বেশ ছোট আর চিপা। কোনোমতে শরীর ঠেকিয়ে বসতে হয়। (শরীরের কোন অংশ সেটা আর নাই বা বললাম)। কনকের পাশেই জিয়া। জিয়া সেভাবেই কোনরকমে সিটের মধ্যে আধ-বসা, আধ-ঝোলা হয়ে সবসময় যা করত, এখনো তাই করছে। ট্রেনে বসেই আমাদের পড়াশুনাসংক্রান্ত সকল সমস্যার সমাধান দিচ্ছে। রাস্তার ২ পাশের দেয়ালে যে পোস্টার লাগানো থাকে, ‘আপনার সর্বরোগের নিশ্চিত সমাধান দেওয়া হয়’ - অনেকটা সেই টাইপ।
জিয়ার ঠিক উলটো পাশে সামনে, আলামিনের সাইডে কোনরকমে ঝুলে বসে আছে জেনারেল ম্যানেজার ফাহিম। কানে হেডফোন ইংলিশ গান, মোবাইলে বিড়ালের ওয়ালপেপার, চুলগুলা স্পাইক। পুরোদস্তুর একটা প্যাকেজ।
আমরা ছিলাম ১২ জনের এক বিশাল দল। দুঃখিত, সবার বর্ণনা দেওয়া গেল না।
ট্রেন থেকে নামলাম কমলাপুর স্টেশনে। স্টেশনটা আমাদের সবার খুব আপন জায়গা, ঠিক যেন আমাদের দ্বিতীয় বাসস্থান। টিকিটচেকার, দারোয়ান, স্টেশনের দোকানদার, ক্যাফেটেরিয়ার মামারা- সবার কাছেই আমরা চেনা মুখ। স্টেশন থেকে বের হয়ে আমরা রওনা দিলাম মৌচাক।
ভর্তি হবো ইউনিভার্সিটির ভর্তি কোচিঙে। ট্রেনের গাদাগাদি থেকে এখন এসির নিচে আমরা। কোচিঙের অফিসে বেশ ভালোরকম হৈচৈ করছি আমরা। প্রায় ২ ঘণ্টা লাগিয়ে আমরা ১২ জন ভর্তি হলাম। অনেকটা বিয়ের পাকা কথা দেওয়া মতন। সবাই খুশি, সবাই হ্যাপি। নিজেরা নিজেদের মতো হৈচৈ করতে করতে নিচে নামছি সিঁড়ি দিয়ে। সেই সিঁড়ি দিয়েই আমাদের সাইড দিয়ে উঠছিল একটা মেয়ে। আর আমরা ১২ জন যেন একসাথে টাশকি খেয়ে গেলাম !
কি তার রূপের বাহার !!! চোখ দুটো টানা টানা, চুলগুলো একপাশে ঝুলে রয়েছে, একটা লাল রঙের ড্রেস, হাতে লাল রঙের একটা মোবাইল, কানে হার্ট শেপের দুল, পায়ে কালো জুতা। সব মিলিয়ে কি যে তার মহিমা, ভাষায় প্রকাশ করতে পারলাম না। ঠিক যেন ‘ফিলিপস বাতি’। আমার চোখজোড়া ঝলসে গেলো।
এরপর সব চুপচাপ হয়ে নামলাম নিচে। নিচে নেমে সবার মুখে শুধু একজনের কথাই চর্চা হচ্ছিল। সেই আলোচনায় আমি ছিলাম না। এরপর অনেক সময় পার হল, নদীতে অনেক জল গড়ালো, সবাই ওকে ভুলে গেলো, কিন্তু আমি ভুলতে পারিনি..................।
***
সেই দিন থেকে প্রায় ২ মাস পর কোচিঙে প্রথম দিন গেলাম। গিয়ে দেখি কাঠের বেঞ্চ। তারপরে একদিন ক্লাসও করলাম। পাক্কা ২ ঘণ্টার ক্লাস। কাঠের বেঞ্চে বসে ক্লাস করে শরীরের অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে ব্যথা হয়ে গেছিলো। মনে পড়লো একটা প্রবাদ, “সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা”। তখনো ফেসবুকে ফিলিংস দিয়ে স্ট্যাটাস দেওয়া যেত না। থাকলে দিতাম FEELING 'ব্যথা' !!!
তবে ক্লাস থেকে বের হয়ে যা দেখলাম, তাতে ক্লান্তি মাথায় উঠলো। সেই ‘ফিলিপস বাতি’ আমার সামনে দাড়িয়ে। হয়তো দেখলাম অনেকদিন পর, কিন্তু কিছু ভুলিনি। এই অল্প সময়ের মধ্যেই মন ভরে দেখে নিলাম। লাল রঙের জামার সাথে ম্যাচিং করা নীল পাথরের কানের দুল। চুলগুলা আজ বেধে রাখা। ‘ফিলিপস বাতির’ সাথে আমার চোখাচোখি হল। আমি আবার তার রূপের আগুনে ঝলসে গেলাম।
ট্রেনে সিট রেখে জিয়ার লেকচার শিট থেকে পড়ছিলাম টপিকগুলা। জিয়ার শিটের অবস্থা খুবই খারাপ। লাল-নীল কালির দাগ দিয়ে শিটের অবস্থা কেরোসিন হয়ে গেছে। লেখাই বুঝা যাচ্ছে না। কিন্তু আমি তো শিটের পড়া মনে করতে পারছি না। আমার তো সেই ‘ফিলিপস বাতির’ কথা মনে পরছে। সেই সাথে তার তীক্ষ্ণ চোখজোড়ার চাহুনি। মনে পড়লো একটা গানের লাইন, “ভোলা তো গেলো না কিছুতেই।”
সেই থেকে প্রতিদিন ক্লাস করার পর ‘ফিলিপস বাতির’ সাথে দেখা হতো। আর আমার অবস্থা হচ্ছিলো গায়ক বালাম এর মতো। উনার গানের লাইনগুলা চরম !!! “আমি প্রেমপিয়াসী, প্রেমে ডুবি, প্রেমে ভাসি...”। একদম গভীর ফিলিংসওয়ালা গান !!!
এমন করে ২ মাস কাটলো। একদিন ক্লাস শেষে সবাই চলে গেলো। আমি আমার ‘ফিলিপস বাতি’-কে দেখার জন্য থেকে গেলাম। আমি থাকবো বলে জিয়া আর কনক ও থেকে গেলো। ক্লাস হচ্ছে ভিতরে। আমি বাইরে দাড়িয়ে আছি। কনক আর জিয়া অন্য একটা খালি রুমে বই আর লেকচার শিট পড়ছে। আমি বাইরে পায়চারি করছি। একটু পর দরজা খুলে একজন গলা বের করলো। আমি তাকিয়ে দেখি লেকচারার। আমাকে বকা দিয়ে তাড়িয়ে দিল। মাথা চুলকে সেখান থেকে সরে গেলাম। সেই কোচিঙের পাশে একটা বিরাট ফুটবলের মাঠ। তাই দেখে ফুটবল খেলার জন্য আমার পা নিশপিশ করতে থাকলো। সেখানেও ভাত পেলাম না। ফুটবলই নাই, আবার ভাত.........
আমি জিয়া আর কনকের কাছে ফিরে আসলাম। হালকা কথা বার্তা হচ্ছে। একটা মেয়ের জন্য এভাবে অপেক্ষা করায় মৃদু ভাবে ইজ্জত দিল জিয়া। আমি গায়ে মাখলাম না। রুমের ফ্যানগুলা ছেড়ে দিলাম। মাথার উপর আস্তে আস্তে ঘুরছে। সাথে বনবন শব্দ। মাথার ভিতরের পোকা যেন নরিয়ে ফেলবে ফ্যানটা। শব্দে বিরক্ত হয়ে আবার বন্ধ করে দিলাম। আর ‘ফিলিপস বাতি’ কে আমার দিলের মধ্যস্থান থেকে ইয়াদ করছিলাম। অনেকে গল্পে উপন্যাসে নিজের ক্রাশকে প্রেম হওয়ার আগেই নিজের বানাইয়া ফেলে। কিন্তু আমি পারলাম না লিখতে। সে আমার ছিলই বা কবে.........। হয়তো হবে একসময়। অপেক্ষায় আছি আমি।
আমি দরজায় এসে দাড়ালাম। বাতাসের ছিটাফোঁটাও নাই কোথাও। দুপুর হয়নি তখনো। আমার তন্দ্রা মতন আসছিলো। কাল রাতে জেগে ছিলাম অনেকক্ষণ। এইতো রাত ৩ টা পর্যন্ত। এতোটা সময় ফেসবুকে ছিলাম। কারোর সাথে চ্যাট না। শুধু খুজেছি একজনকে। নাম জানি না তার। প্রায় ১৫০০ মেয়েদের আইডি ঘুরেছি। পাইনি ওকে। রাত হয়তো বেজেছে ৩ টা। কিন্তু আমি থামতাম না, পাগলের মতো খুজে জেতাম। কিন্তু একসময় মডেমের ব্যালেন্স শেষ হয়ে এলো। তারপর তো ৩ ঘণ্টা ঘুমিয়ে ক্লাস করতেই চলে এসেছি।
এসব চিন্তা করছি আনমনে। চুলগুলা ছিল ছোট। বাতাসে উড়ত না। চুলে হাত বোলাতে লাগলাম। হঠাৎ ঘাড়ের উপর একসাথে যেন অনেকগুলো কাগজ পড়লো। উপরে চেয়ে দেখি একটা তাক। সেখানে কিছু লেকচার শিট আর ফাইল। জিয়া কনকরা পড়ুয়া ছাত্র। ওরা শিট নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে লাগলো। আমার চোখে পড়লো কয়েকটা নতুন চকচকে ফাইল। খুলে দেখি কোচিং এর সবগুলা ব্যাচের স্টুডেন্টদের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার, কলেজের নাম দেওয়া। আমাদের ব্যাচেরটাও আছে। একনজরে নামগুলা দেখে ফেলে দিলাম। কোন কাজের না। পিছন ফিরে দেখি জিয়া আর কনক শিট ভাগাভাগি করছে। আমি এক সেকেন্ড দাড়িয়ে চিন্তা করলাম। পরে আমিও লেগে গেলাম শিট নিয়া কাড়াকাড়িতে। ওইদিন সর্বসাকল্যে ৩ জনে মিলে প্রায় ৪০ টা শিট গায়েব করে দিলাম।
আরো এক ঘণ্টা পার হল। আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে দাঁড়ালাম। ফিলিপস বাতির’ ছুটি হয়েছে। ৫ মিনিট অপেক্ষা করার পর নামলো ফিলিপস বাতি’। রিকশার খোঁজে সামনে এসে দাঁড়ালো, আমার পাশে। সে খোঁজে রিকশা, আর আমি খুঁজি তাকে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমাকে দেখতে না দেওয়ার জন্যই হয়তো হঠাৎ চলে গেলো সে। আমি আমার সঙ্গীদের নিয়ে রওনা হলাম স্টেশনের দিকে। ফিলিপস বাতি’ ছাড়া এখানে থাকার আমার কোন স্বার্থ নেই।
তারপর দিন থেকেই সেই ‘ফিলিপস বাতির’ খোঁজ খবর নেওয়া শুরু হল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। শেষে একদিন একজনের সাথে দেখা হল যে ‘ফিলিপস বাতির’ সাথে ক্লাস করে এবং ভালো করেই চেনে। নামটা জানলাম ‘ফিলিপস বাতির’। সুন্দর এবং আজিব নাম একটা। মোবাইল থেকে সাথে সাথে ফেসবুক.কম। সেখান থেকে লগইন, তারপর সার্চ দা খোঁজ, তারপর খুব দ্রুত নাম ইনপুট, এবং সবশেষে একটা মধুর সমাপ্তি। আইডি টা পেয়ে গেছি। গান গেয়ে উঠলাম।
“আইডিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো,
এখন আর কেও আটকাতে পারবে না...............”।
অ্যাড দিলাম না। আগে কিছু করে নেই। এখন অ্যাড দিলে একসেপ্ট না করার সম্ভাবনা বেশী। আর একসেপ্ট না করলে বড় ইজ্জত। একটুপর ক্লাস শুরু হল। মনটা বেজায় খুশি। আজ হঠাৎ পড়া ধরল টিচার। দিলাম উত্তর। মনটা আজ বড়ই খুশি। আর ক্লাসের সবার মাঝে দাড়িয়ে একা কোন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ফিলিংসও কম মজার না...।
হঠাৎ মনে হল নামটা যেন কোথায় দেখেছি। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে, নামটা আমি আগে দেখেছি। নামটা আমি কোথাও এক জায়গায় তো দেখেছি। ক্লাস শেষে করে স্যার বলল, আমি অফিসে আছি, কারোর কোন প্রবলেম হলে আমার কাছে আসবা”।
শুধু ১ টা শব্দ শুনলাম ‘অফিস’। আর তাতেই মগজের তালাগুলো সব খুলে গেলো। নামটা ছিল ফাইলে। যেটা আমি অকাজের ভেবে ফেলে দিয়েছি। নিজের উপরেই হঠাৎ করে ক্ষেপে গেলাম। ক্লাস থেকে বের হয়েই খালি রুমটায় দৌড় দিলাম। আমার পিছে জিয়া আর কনক, ফাহিম। আমি তন্ন তন্ন করে খুজলাম ফাইলটা। নেই। কোথাও নেই। উল্টা আমার সাথের ৩ জন আবার শিট গায়েব করা শুরু করলো।
এরপর আমি দৌড়ে গেলাম অফিসে। স্যারের সাথে কথা বার্তা বলল বাকি ৩ জন। আর আমি কি করছিলাম...... ফাইলটা খুজছিলাম। যেখানে ফাইলটা থাকতে পারে। অফিসে সোফার সাথে অনেক কাগজ। এসব ঘেটে কিছুই পেলাম না। আমার দিলে বেদনার সুর। নিজের দোষে হারালাম অনেক কিছু।
এরপরের দিন আবার এখানে সার্চ করলাম। পালা পালা করে খুজলাম। ১-২ ঘণ্টা অযথা বসে থেকে খুজলাম। ১ মাস কেটে গেলো। চোখের নিচে হালকা কালি। শুধু আমার না। আমার সাথে যারা যারা খুজতে এসেছে তাদের সবার। প্রায় ১ মাস হয়ে এলো খোঁজাখুঁজি করার। এর মধ্যে জিয়া আর ফাহিম পদত্যাগ করে চলে গিয়েছে।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠলাম। চিন্তা করলাম আজই লাস্ট বারের মতো খুজবো। উপরওয়ালার আশীর্বাদ নিয়ে আসলাম কোচিঙে। ক্লাস শেষে বরাবরের মতো খোঁজা স্টার্ট। উপরওয়ালার আশীর্বাদে অতি আশ্চর্যজনকভাবে ফাইলটা আর পেলাম না। কিন্তু যা পেলাম, তা ফাইলের চেয়েও বেশি দরকারি। ‘ফিলিপস বাতির’ ভর্তির ফর্মটা। চেহারাটা ভালো করে দেখলাম। নামটা দেখলাম। সোজা চোখ চলে গেলো ফোন নাম্বারে। মুখস্ত করলাম ০১৬********।
অফিস থেকে আমি আর কনক বের হয়ে আসলাম। আমার মুখে এক ধরনের জান্তব হাসি। পেয়েছি, আমি পেয়েছি আমার সাধনার ফল। তার নাম্বারটা আমার মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে থাকলো।