সেদিন পরিচিত একজন টেক্সট মেসেজ করে জানতে চাইলেন, 'লেখালিখি কি ছেড়ে দিয়েছি?'
উত্তরে বললাম, 'স্বেচ্ছায় নয়, ভাবনা আসে। তবে সেগুলো অক্ষরে রূপ দেয়ার ইচ্ছা জাগে না'
এমন আরো কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় প্রায়। জেনে শুনে একটা বাজে মানুষের জন্য কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছি, পরিবারকে কষ্ট দিচ্ছি, এত বোকা কেন আমি? রুহির (সে) চরিত্র এত খারাপ চরিত্রের কেন তা আগে টের পাই নি, এত খারাপ একটা মানুষের জন্য এত ভালোবাসা আসে কোথা থেকে, ঘৃণা করি না কেন তাকে...ইত্যাদি ইত্যাদি।
সব সময় যে এসব প্রশ্নের উত্তর দেই, তা নই, দেই কদাচিৎ। বাকী সময়গুলো চুপ করে থাকি। মৌনতাটাকেই তখন নিরাপদ আশ্রয় মনে হয়।
কিন্তু মনে মনে উত্তরটা খুঁজি। কারণ অকারণ সবকটা দিক মিলিয়ে দেখি। উত্তরটা আমার মন জানে। কিন্তু সেই উত্তরটা জাগতিক নয়। তাই ব্যাখ্যা করতে মন সায় দেয় না।
আমাদের চারপাশের সামাজিক জগত, কর্পোরেট জগত...সবটাই ভারী অদ্ভুত। তার চেয়েও অদ্ভুত এই জগতের বানানো নিয়মগুলো। এখানে সব সত্যি প্রকাশযোগ্য না হলেও মিথ্যাগুলো অন্যায়গুলো অবলীলায় সগৌরবে প্রকাশযোগ্য। ঘুষখোর এখানে ঘুষ খেতে, ঘুষের টাকায় ঠাট বাট দেখাতে লজ্জা পান না, বিবাহিত পুরুষ বিবাহ বর্হিভুত সম্পর্ক স্থাপনে লজ্জা পান না, মিডিয়ার লোভনীয় হাতছানিতে পোষাক বিসর্জন দিতে এখানে উচ্চাকাক্ষিরা লজ্জা পান না, মেয়ে মানুষের দেহ কে পুঁজি করে ব্যবসা করতে কোম্পানিগুলোর লজ্জা হয় না, সুদ খেতে লজ্জা হয় না, প্রমোশন আর বাড়তি সুবিধার আশায় বসের সান্নিধ্য প্রীতিতে লজ্জা হয় না... মিথ্যা বলতে আর অসৎ কাজ করতে লজ্জা হয় না.....কারণ, এখানে সব লজ্জার শুরু হয় সত্যি তে। সত্যি বলা এবং প্রকাশ করাটাই এখানে বড় লজ্জার, বড্ড অস্বস্তির। পাছে লোকে জেনে যায়, পাশে তারা মন্দ কথা বলে আমার বিষয়ে!....
প্রসঙ্গক্রমে একটা ঘটনার কথা বলি। বিষয়টা চাকরী সংক্রান্ত। আমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করলেন। বিষয়টি হলো কাজের ব্যাপারে আমার যথেষ্ঠ সুনাম থাকলেও আমার স্পষ্টবাদীতা এবং ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুটনৈতিক গোপনীয়তা মেনে না চলায় অনেক এমপ্লোয়ার আমাকে নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলেও ভুগতে পারে।...
দেখেছেন একবার বিষয়টা...
অফিসের ব্যক্তিগত সহকারীকে সাথে নিয়ে বিদেশ ভ্রমন অথবা বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও অবিবাহিত কিংবা বিবাহিত সহকর্মীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন যেখানে অন্যায় বা নিরাপত্তাহীনতার কারণ নয়, সেখানে একজন মানুষ তার কাজে যথেষ্ট যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তার ব্যক্তিগত বাক স্বাধীনতা ও সত্য প্রকাশের ধরণ কে হুমকি মনে করে তাকে বঞ্চিত করার কি অদ্ভুত কায়দা এ সমাজের?...
আমি বলি কি, এটা নেহায়েতই তাদের কুৎসিত সংস্কৃতি টাকে ঢেকে রাখার অপপ্রচেষ্টা মাত্র যদিও তাতে ঢেকে থাকে না কিছুই। তথাপিও সবাই সব জেনেও না জানার ভান করে চলে কারণ এটাই যে সামাজিকতা, এটাকেই যে কর্পোরেট জীবনাচার বলে! সোজা বাংলায়... 'সামাজিক মিথ্যার বৈধ ব্যাভিচার'
ধরে নিচ্ছি রুহি (সে) এই সমাজের অজস্র প্রতারক প্রেমিকের প্রতিনিধিত্ত্ব করছে।.. সে আমাকে মিথ্যা বলেছে, ঠকিয়েছি, একাধিক মেয়ের সাথে একাধিক সময়ে সম্পর্কে জড়িয়েছে, আমাকে নিয়ন্ত্রন করেছে, শারীরিক ভাবে নিগৃহীত হতে হয়েছে তার কাছে আমাকে, বারবার নিজের সততার প্রমাণ দিতে গিয়ে অপমানিত হতে হয়েছে...
অনেকের সাথেই এমন হয় হয়তো। কিন্তু এই অন্যায়গুলোর কথা যা আমার সাথে বা আমার মত অনেকের সাথে হয়েছে, তা এ সমাজে প্রকাশ করে দেয়াটা এক ধরনের অপরাধ। কারণ এই সমাজ ঠিক করে দিয়েছে এতে করে ওই প্রতারক মানুষটির কিচ্ছু হবে না, তুমি নারী, তাই তোমাকে সব চেপে যেতে হবে তোমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে, তোমার সম্মানের কথা ভেবে!
কি অদ্ভুত শৃঙ্খলা আর নিয়মের সমাজ আমাদের! নারীর সম্মান রক্ষার দোহাই দিয়ে কি সুন্দর পুরুষের আত্নরক্ষার ঢাল তৈরি করে দিচ্ছে এই বহুরূপী সমাজ!
এমন নিকৃষ্ট সমাজের তাই আমি নিকুচি করি।
পেশাগত বা ব্যক্তিগত কমফোর্ট জোনটাকে টিকিয়ে রাখতে আমি সত্যি চেপে রাখি নি কখনো। যা বলা প্রয়োজন মনে করেছি, বলেছি। যা বলার প্রয়োজন মনে করি নি, তা বলি নি....আজ অপ্রিয় সত্যিগুলো অকপটে বলে দেয়ার কারণে আমার লৌকিক কিছু বিরাগভাজন তৈরি হয়েছে ঠিকই, তবে ইচ্ছা থাকলে আমিও হয়তো ভালোবাসার মানুষটার পথটাও অমসৃণ করে দিতে পারতাম....পারতাম কুরুচিপূর্ণ শব্দ ব্যবহার আর আচরণের জন্য তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, মানসিক আর শারিরীক নিগ্রহের প্রতিবাদে প্রমাণ নিয়ে পুলিশের কাছে যেতে, পারতাম নারী নির্যাতনের প্রমান সহ পুলিশের কাছে করা কমপ্লেইনের ফাইল টা তার উর্ধ্বতনের কাছে জমা দিয়ে ইউনিলিভারের গর্বের চাকরি টা কেড়ে নিতে। পারতাম কয়েকদিন পর পর ভালোবাসার কথা বলে আর ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অসংখ্য মেয়ের সাথে তার ব্যাভিচারের প্রমাণ সবার কাছে তুলে ধরে তার মুখোশ খুলে দিতে....করি নি।
সেটা করলে সবার চোখে আমি খারাপ হয়ে যাবো তার জন্যে নয়।......বরং করিনি অন্য কারণে। মানুষের যে সকল প্রশ্ন আমাকে আর আমার মত অনেক কে মৌন হয়ে থাকতে বাধ্য করে, উত্তরটা সেখানেই রয়েছে।
সন্তান বিকলাঙ্গ হলেও কি কোন মা তার সন্তান কে পরিত্যাগ করতে পারে? বিপথে কুপথে চলে যাওয়া সন্তান কে কি কোন মা হত্যা করে? করে না। বরং বিকলাঙ্গ সন্তানের প্রতি একজন মায়ের সুস্থ সন্তানের চেয়েও বেশি স্নেহ আর মায়া কাজ করে। বিপথে চলে যাওয়া সন্তানকে সুপথে ফেরাতে মা ঈশ্বরের কাছে বেশি করে প্রার্থণা করে, বেশি চোখের জল ফেলে। এটাই প্রকৃত মাতৃস্নেহ। সত্যিকার ভালোবাসাও তেমনি। ভালোবাসার মানুষটা যত বড় ভন্ড, প্রতারক অথবা বিকলাঙ্গ চরিত্রের হোক না কেন, প্রকৃত যে ভালোবাসার মানুষ, সে তাকে ত্যাগ করতে পারে না। বরং সে কষ্ট সহ্য করে হলেও তাকে আলোর রাস্তায় ফেরাতে চেষ্টা করে...শেষ পর্যন্ত। যখন প্রতারক ব্যভিচারী মানুষটা বন্য অস্থিরতায় মগ্ন দিন কাটায় আর মিথ্যা জাল বুনে যেতে থাকে অবিরাম, তখনও প্রকৃত ভালোবাসার মানুষটা তাকে পরিত্যাগ করে না।... বরং তার ভালো হবার প্রত্যাশায় ঈশ্বরের সাহায্য কামনা করে। সে বরং দূরে সরে যায়....তবুও তাকে ছেড়ে যায় না!
বাস্তবতা আর ভুত ভবিষ্যত বিবেচনায় যে ভালোবাসা টিকে থাকে সেটাকে ভালোবাসা নয়, সমঝোতা বলে। এই সমঝোতা বাজারের দেহপসারিনী আর তার খরিদ্দারের ভেতরও থাকে। তাই ভালোবাসা আর সমঝোতা কখনও এক হতে পারে না।.... আর এটাই সার্বজনীন সত্যি!
মাতৃস্নেহের কাছে যেমন সব শক্তি হার মেনে যায়, তেমনি কিছু ভালোবাসাও পৃথিবীতে এমন হয় যে, কোন পার্থিব মাঠকাঠিতে তার যৌক্তিকতা মাপা যায় না!