ঘড়ির কাঁটা তখন ১০: ৩৫ ছুঁই ছুঁই।
কাকলী সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তা পার হব বলে। হঠাৎ অভাবনীয় আর ইন্টারেস্টিং একটা দৃশ্য চোখে পড়লো। বনানী ডিওএইস থেকে আসা এক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এর গাড়ী উল্টো দিক দিয়ে যাওয়ার রাস্তা দিয়ে মেইন রোডে উঠে এয়ারপোর্ট রোডে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। তখন ডিওএইচএস সিগনালে ডিউটিতে ছিল চিকনা পটকা সিয়েরা লিওন টাইপ অবয়বের ট্রাফিক পুলিশ। রং রুট দিয়ে আসা গাড়ী টাকে দেখা মাত্র হাওয়ার বেগে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশটি রীতিমত ক্ষ্যাপা বাঘের মতন গাড়ীর সামনে ঝাপিয়ে পরে গাড়ীটিকে আটকে দিল। গাড়ীর ভেতর থেকে সামরিক বাহিনীর পোশাক পরিহিত ড্রাইভার গ্লাস নামিয়ে পরিচয় দিতেই উল্টো তাকে দে ধমক। বেচারা ড্রাইভার তো পুরাই ভ্যাবাচ্যাকা। গাড়ীর পেছনের সিটে ব্রিগেডিয়ার এর বউ আর ছেলে বসা। ছেলের বয়স ২০-২১ এর বেশি হওয়ার কথা না। ছেলে আর বউ এবার ব্রিগেডিয়ার এর ঝাল দেখাতে এগিয়ে আসলো। তাতে হিতে বিপরীত হল। ট্রাফিক পুলিশ একেবারে গাড়ির সামনে ঠাই দাঁড়িয়ে গিয়ে নির্বিকার চিত্তে ডিউটি চালাতে থাকলো। পাবলিক প্লেসে রং রুটে গাড়ি চালিয়ে এসে বেশি বাড়াবাড়ি করলে যে ঝামেলা উল্টো বাড়তে পারে, এই বোধোদয় হওয়াতেই কি না গাড়ির ড্রাইভার আর অন্যান্য আরোহী সবাই খানিকটা চুপসে গেল। এরপর ঘটনা কতদূর এগিয়েছে জানা হয় নি আর। কারন ততক্ষনে আমি রাস্তা পার হয়ে অন্য পাশে চলে এসেছি। তবে কিনা দাম্ভিক এই সম্প্রদায় যারা নিজেদের শুধু নিজেদের উত্তম আর সাধারন সিভিলিয়ানদের অধম মনে করেন, যারা মনে করে আইন, সিস্টেম এই সব কিছু কেবল তারাই মেনে চলে...তাদের এই ধরনের নাজুক পরিস্থিতিতে পড়তে দেখে কেন জানি না খুব আনন্দ হল। গাড়িতে বসা এই ছেলেটিই হয়ত প্রায়ই ট্রাফিক জ্যামে বসে বিরক্ত হয়ে ফেসবুকে ‘দেশটাতে সিস্টেম বলে কিচ্ছু নেই’ বলে স্ট্যাটাস দিচ্ছে। অথবা এই ছেলেটিই হয়ত ভার্সিটির ছাত্রদের আন্দোলনে গলায় ফেস্টুন ঝুলিয়ে গলা ফাটিয়ে আগুন ঝরা শ্লোগান দেয়। ...
আর্থ-সামাজিক ও পদমর্যাদার বিবেচনায় একজন ট্রাফিক পুলিশ আর একজন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এর মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এই ট্রাফিক পুলিশ গুলো কে দেখে এলিট সম্প্রদায়ের এই লোকগুলোয় ঘুষখোর বলে গালি দিয়ে ঘৃণায় খানিক থুতু ছেটায়, অথচ দিনের পর দিন বছরের পর পর আমৃত্যু সিভিলিয়ানদের টাকায় আয়েশ করে সেই সাধারণ জনগণ কেই অবজ্ঞা করতে বা হেয় প্রতিপন্ন করতে এই এলিট শ্রেণির কখনও লজ্জা হয় না।
শুকনো পটকা এই মানুষ টি চাকরি হারানোর কিংবা গালি গালাজ খাওয়ার অথবা অসম্মানের কোন ভয় না করে যেভাবে সামরিক পোশাক পড়া মানুষটির চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে অন্যায়টাকে অন্যায় হিসাবে ধরিয়ে দিয়ে যেভাবে তার দায়িত্ব পালন করেছে, সেটি সম্পূর্ণ পুলিশ ডিপার্টমেন্টের জন্য সত্যি অনেক বড় গর্বের বিষয় হত। ঠিক এভাবেই সাহসিকতা বুকে নিয়ে যদি প্রতিটা ট্রাফিক পুলিশ কাজ করতো আমাদের জীবনযাত্রাও অনেক সহজ স্বাভাবিক হয়ে যেত। আমার কেন জানি মনে হয়, পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এ কর্মকর্তারা নিজেরাও জানেন না যে একজন দায়িত্বশীল ও সৎ পুলিশ অফিসারকে কতটা সম্মানের চোখে দেখে এদেশের সাধারণ মানুষেরা। যদি জানত তাহলে অন্তত একদিনের জন্য হলেও তারা সবাই ভাল হয়ে সেই সম্মানের স্বাদ নিতে চাইতেন।
যেদিন বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনে এমন নির্ভীক পুলিশ অথবা ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বেড়ে যাবে, সেদিন নিউজ পেপারের পাতাগুলো আর ফেসবুকের নিউজ ফিডগুলোতে বিশাল এক শূন্যতার সৃষ্টি হবে...তবে সেই শূন্যতা হবে অনেক আনন্দের, হবে স্বস্তির!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ২:২৫