আমরা যখন কোন পাহাড়-পর্বতে আরোহণ করবো, তখন এদের উপর ও নিচে অনেক সামুদ্রিক খোলস, ঝিনুক পাবো। এভাবে আমরা বুঝতে পারি এই সমস্থ স্থানগুলো একসময় পানির নিচে ছিল। অনেক মানুষ এবং পর্বত আরোহীরা বিশ্বের বহু অংশে যেমন ইরাক, ইরান, ভারত, মিশর, সিরিয়া, চীন, আমেরিকার উঁচু স্থানগুলোতে এই রকম ঝিনুক পেয়েছেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা আরারাত পর্বতের উপরে বেশ কিছু কাঠের টুকরো পেয়েছেন। কাঠের টুকরোগুলোর বয়স অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায় তা ২৫০০ বছর পূর্বের যা হযরত ঈসা(আঃ)এর জন্মেরও আগের সময়ের। কয়েকজন প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্বাস করেন যে এই কাঠের টুকরোগুলো হযরত নূহ(আঃ)এর নৌকার অংশ। ১৯৫১ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল ক্বাফ পর্বতের উপরে একটি কাঠের টুকরো পান। কাঠের টুকরোর উপর একটি প্রাচীন লেখা ছিল। ১ বছর গবেষণার পরে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে এই কাঠের টুকরোটি হযরত নূহ(আঃ)এর নৌকার।
সে সময়ে মানুষ এক জাতি ছিল। সহজ জীবন যাপন করতো। জমি চাষ এবং পশু শিকার করে দিন কেটে যেত। এইভাবে সময় গড়িয়ে গেল। শক্তিশালীরা তাদের শক্তির ব্যবহার শুরু করলো। তারা তাদের দুর্বল ভাইদের উপর নির্যাতন করতে লাগলো। দুর্বলরা শক্তিশালীদের ভয় পেত। তাই তারা নিজেদেরকে সঁপে দিল আর সন্তুষ্ট থাকতো সম্মানহানি আর দাসত্বের জীবনে। পৌত্তলিক বিশ্বাস হযরত নূহ আলাইহিস সালামের (আঃ) এর জীবদ্দশায় ছড়িয়ে পড়ে। দুর্নীতি চলতো প্রকাশ্যে। সাধারণ মানুষ শক্তিশালীদের ভয় করতো। শক্তিশালীরা মূর্তি পূজা করতো। সেই সময়ে, সম্ভবত চার হাজার বছর আগে, হযরত নূহ আলাইহিস সালাম(আঃ) দুই নদীর (দজলা ও ফোরাত) দেশে (বর্তমানে ইরাক)বাস করতেন। হযরত নূহ (আঃ) লক্ষ্য করলেন যে মানুষ সত্য থেকে বিচ্যুত আর দুর্নীতিতে ভরা জীবন যাপন করছে। শক্তিশালীরা দুর্বলদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। ধনীরা গরীবদের মতামত উপেক্ষা করে জোর করে দিন রাত কাজ করাতো। যখন গরীবেরা তাদের নিজেদের এবং তাদের পরিবারকে মুক্ত করতে চাইতো তখন ধনীরা তাদেরকে মারতো আর তাদের উপর অত্যাচার চালাতো। ধনীরা গরীবদের দাস করে রাখতে চাইতো। মানুষ মহান আল্লাহর ইবাদত করতে ভুলে গিয়েছিল। তারা পাথরের তৈরি মূর্তি পূজা করতো। তারা মনে করতো এই সব মূর্তি তাদেরকে পুরস্কার দিবে, বৃষ্টি বর্ষণ করবে, বিপজ্জনক বজ্রপাত থেকে তাদের রক্ষা করবে, ভাল কিছু দিবে এবং অমঙ্গল, দুর্ভাগ্য দূর করবে। মানুষ তাদের নিজের হাতে মূর্তি তৈরি করে তা ফোরাত নদীর তীরে রেখে দিয়েছিল। তারা এইসব মূর্তিকে ডাকতো ওয়াদ, সূয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নসর নামে। তারা ওদের পূজা করতো এবং তাদের সামনে সেজদা দিতো। হযরত নূহ আলাইহিস সালাম (আঃ) স্বীয় সম্প্রদায়কে মূর্তি সেজদা করতে দেখে দু:খিত হলেন। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। মহান আল্লাহতালার কাছে তাঁর সম্প্রদায়কে এই অজ্ঞতা থেকে বাঁচানোর জন্য দোয়া করলেন।
আল্লাহর একত্বের প্রতি আহ্বান
একদিন মানুষ হযরত নূহ (আঃ) কে বলতে শুনল: "হে আমার জাতি, আমি আল্লাহর রসূল। আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনি তোমাদের দান করেন। তাঁর কাছে ক্ষমা চাও। তিনি তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন। তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তোমাদের ভূমি সবুজ করে তোলেন। তিনি তোমাদের পুত্র ও কন্যা দেন। কেন তোমরা প্রতিমার পূজা করছো? কেন তোমরা আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে সরে গিয়েছ?" "তারায় ভরা বিস্তৃত আকাশের দিকে তাকাও। চাঁদ এবং সূর্যের দিকে তাকাও। মৃত্যুর কথা চিন্তা করো। কেন মানুষ মারা যায়?" "তোমরা পাথর দিয়ে মূর্তি তৈরি করেছ। তাদেরকে ওয়াদ, সূয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নসর নামে আহ্বান করো। তোমরা কি মনে করো মূর্তি তোমাদের সন্তান দান করে, এবং আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত করে? তারা তোমাদের বজ্রপাত এবং বন্যা থেকে রক্ষা করে? যদি তা না হয় তবে আল্লাহর ইবাদত করোনা কেন?"
তারা বললো "সে একজন উন্মাদ। একজন দরিদ্র কাঠ মিস্ত্রি। যদি সে আল্লাহর রসূল হতো তাহলে সে পৃথিবীর সব সম্পদের মালিক হতো। আল্লাহ্ একজন ফেরেশতা কেন পাঠান না? কেন তিনি আমাদের মতই একজন মানুষ রসূল করে পাঠিয়েছেন? সে আমাদের থেকে নিচু শ্রেণীভুক্ত। তাঁর থেকে আমরা অর্থবিত্ত, সন্তান সন্ততি এবং ক্ষমতা সব দিক থেকেই এগিয়ে আছি।" তাই তারা তাঁর কথায় কর্ণপাত করলো না। খুব অল্প সংখ্যক দরিদ্র পুরুষ আর নারী তাঁর কথা শুনে তাঁকে বিশ্বাস করলো। তবে তিনি লোকদেরকে এক আল্লাহ্র ইবাদত করার জন্য আদেশ দিতে থাকেন। পেরিয়ে যায় একে একে ৯৫০ বছর।
অবশেষে হযরত নূহ (আঃ) আকাশের দিকে দুই হাত তুলে দোয়া করলেন। তিনি পৃথিবীকে অবিশ্বাসী এবং পাপীদের থেকে মুক্ত করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। "নূহ আরও বললঃ হে আমার পালনকর্তা, আপনি পৃথিবীতে কোন কাফের গৃহবাসীকে রেহাই দিবেন না। যদি আপনি তাদেরকে রেহাই দেন, তবে তারা আপনার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে কেবল পাপাচারী, কাফের।" আল কোরআন
নৌকা তৈরি
মহান আল্লাহতালা হযরত নূহ (আঃ)কে নৌকা তৈরি করার আদেশ দেন। তিনি গ্রামের বাইরে একটি বড় নৌকা তৈরির কাজ শুরু করেন। হযরত নূহ (আঃ) কাঠের কাজে খুব দক্ষ ছিলেন। বিশ্বাসীরা তাঁকে নৌকা তৈরিতে সাহায্য করতো। তাঁরা বিভিন্ন মাপের কাঠের বোর্ড তৈরি করেছিলেন। নৌকা বড় হওয়াতে কাজটা অনেক কঠিন ছিল। এতে তিনটি স্তর ছিল। নৌকাটি ছিল প্রায় ৬০০ ফিট দীর্ঘ, ২০০ ফিট প্রস্থ এবং প্রায় ৭৫ ফিট উচ্চতা বিশিষ্ট। ৮০ বছর কঠোর পরিশ্রমের পর অবশেষে নৌকা বানানো শেষ হলো। এই সময় অবিশ্বাসীরা বলতো, "দেখ ঐ পাগলদের দেখ! তাঁরা মরুভূমিতে নৌকা তৈরি করছে! ঐ দেখ নূহ সে তো পাগল হয়ে গেছে!" আরেকজন বললো," সে তো খুব দক্ষ কাঠ মিস্ত্রি। সে ধূর্ত। নিশ্চয় সে রাজপ্রাসাদ তৈরি করছে।" একজন বললো, " এই নূহ তুমি কি করছ? এখানে কোথায় সমুদ্র?" হযরত নূহ (আঃ) উত্তরে বললেন, " একদিন আমরা তোমাদের সাথে উপহাস করবো যেমন তোমরা আমাদের সাথে করছো।"
অপেক্ষা
একজন বৃদ্ধা মহিলা তাঁর মেয়ে সহ হযরত নূহ (আঃ) এর কাছে এসে জানতে চাইলেন, "আল্লাহ্ কবে এই দুরাচারী, পাপীদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করবেন?" হযরত নূহ (আঃ) মুক্তি দিবস সম্পর্কে জানতেন না। তাই তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। শুধু মাত্র মহান আল্লাহ্ এর সম্পর্কে জানেন। এই সময় আকাশ থেকে একজন ফেরেশতা এসে বললেন,"যখন বৃদ্ধা মহিলাটির বাড়ি থেকে পানি ফোয়ারার মত বের হবে তার মানে হল মহাপ্লাবনের সময় নিকটবর্তী।" এই সংবাদে বৃদ্ধা আনন্দে উদ্বেলিত হলেন। ছোট মেয়েটি আনন্দে হেসে ফেললো।
পানি উপচে পরলো
একদিন আকাশ মেঘে কালো হয়ে আসলো। অবিশ্বাসীরা অতিমাত্রায় নির্যাতন চালাতে লাগলো। তারা মানুষ হত্যা করতো আর মানুষের ঘরে ডাকাতি করতো। দিনের পর দিন অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চললো। অবশেষে ছোট মেয়েটি হযরত নূহ (আঃ) এর কাছে দৌড়ে এলো আর বললো, "পানি উপচে পরছে।" হযরত নূহ (আঃ) সেখানে দ্রুত গেলেন। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের দেওয়া প্রতিশ্রুতি সত্য হয়েছে। পানি ফোয়ারার পানির মতই উপচে পরছে। বিশ্বাসীরা তা দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললো। কেউ কেউ আকাশের দিকে তাকালো। হযরত নূহ (আঃ) সবাইকে নৌকায় উঠার নির্দেশ দিলেন। তখন দিনের আকাশ ছিল রাতের আকাশের মতই কালো। হঠাৎ আকাশে বিদ্যুতের চমক দেখা গেল। শক্তিশালী বজ্রপাতের আওয়াজ হলো। ভারী বৃষ্টি শুরু হলো। আল্লাহতালা নৌকায় জোড়ায় জোড়ায় পশু পাখি উঠানোর আদেশ দিলেন। উপরের স্তরে বড় বড় পশুগুলকে এবং নিচের স্তরে পাখিদের রাখা হলো।
মহাপ্লাবন
পর্বত আর উপত্যকা থেকে পানি উপচে পরা শুরু হলো। অত্যন্ত ভারী বর্ষণ হচ্ছিলো। শক্তিশালী বাতাস বইছিল। আকাশে বিদ্যুৎ চমক আর জোরে বজ্রপাতের আওয়াজ হচ্ছিলো। মাটি হয়ে গিয়েছিল ফোয়ারার মত। আকাশ থেকে নদীর মত পানি পরছিল। বিশ্বাসীরা ছিলেন নৌকার মাঝ স্তরে। তাঁরা জানালা দিয়ে মহাপ্লাবন দেখছিলেন। পানি পাহাড়গুলর উপর থেকে পরছিল। উপত্যকাগুলো হয়ে উঠেছিল পানিতে ভরা নদীর মত। অবিশ্বাসীরা গ্রাম থেকে পলায়ন করছিলো। তারা এখনও হযরত নূহ (আঃ) এর কথার উপর বিশ্বাস করতে পারেনি। মহাপ্লাবনে সব কিছুই ঢেকে গিয়েছিল। পৃথিবী হয়ে গিয়েছিল একটি বড় সমুদ্রের মত। পানি আর পাহাড়ের চূড়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এর মাঝে নৌকা চলতে লাগলো।
অবশেষে ৪০ দিন পর মহাপ্লাবন থামলো। বৃষ্টি থেমে গেল, সূর্যের দেখা মিললো। হযরত নূহ (আঃ) কয়েকটি কবুতর ছেড়ে দিলেন। তারা আর ফেরত এল না। তিনি বুঝতে পারলেন কাছেই ভূমির সন্ধান আছে। তাই তিনি নৌকার মুখ উত্তর দিকে ফেরালেন। এরপর নৌকা গিয়ে পৌঁছাল জুদী পর্বতের চুড়ায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৫ রাত ১০:৪৪