ছেলেটার নাম রাজীব। বয়স প্রায় নয় বছর। পায়ে ছিড়া একজোড়া জুতো। তাও
আবার দুই রকমের দুইটা। ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে। পরনে ছিড়ে যাওয়া
নোংরা একটা প্যান্ট আর গায়ে মস্ত বড় এক পাঞ্জাবি। গলায় ঝুলানো একটা গামছা।
গামছায় বাধা একটা টিনের বাক্স, যেটার এককোনে পান আর অন্য কোনে
সিগারেট। পিছন দিক দিয়ে রাজীবের গলা জরিয়ে ধরে ঝুলে আছে ওর ৩ বছর
বয়সের ছোট বোন। ক্ষুধার যন্ত্রনায় থেমে থেমে কান্না করছে।
বোনের চোখের পানিতে রাজীবের নোংরা পাঞ্জাবি ভিজে চুপসে যাচ্ছে।
রাজীব পাগলের মত হেঁটে চলেছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। আর
চিৎকার করে বলছে, "এইযে ভাই, একটা পান নিন।"
রাজীবের কথা শুনে কারো মনে কোন দয়া হচ্ছেনা। কেউ রাজীবের
থেকে পান কিনছে না। রাজীবের বোনের কান্না বেড়েই চলেছে। রাজীব
আর সহ্য করতে পারছে না। অন্যমনস্ক হয়ে কাধের বোঝাটাকে ছুড়ে
ফেলে দিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে চলল। পরক্ষনেই মনে হল, ও
তো আমার মতই আমার মায়ের আরেক নাড়ি ছেঁড়া ধন। নিজের অজান্তেই আবার
দৌড়ে গিয়ে কাধের বোঝাটাকে কাধে তুলে নিল। আবার শুরু হয়ে গেল পান
বিক্রি। এবার একটু অন্যভাবে। এবার রাজীব সবার পা ধরে ধরে বলছে, "এইযে
ভাই, একটা পান নিন না। আমার বোনটা না খেয়ে মারা যাচ্ছে।" শেষমেশ অল্প
কয়েকজন ওর থেকে পান কিনল আর বাকি সবাই ওর নোংরা পোশাক দেখে নাক
ছিটকে চলে গেল।
সারাদিনের শেষে রাজীবের আয় মাত্র ৪০ টাকা। এবার ওদের খাবার পালা।
হোটেলে ঢোকার সময় বোন হাত দিয়ে কাছের তরকারিটা দেখিয়ে দিয়েছে।
রাজীব ওর বোনের জন্য ৩০ টাকা দিয়ে মাছ আর ৫ টাকা দিয়ে ভাত কিনলো।
রাজীবের বোনটা রাজীবের সামনে বসে পরম তৃপ্তি নিয়ে ভাত খাচ্ছে। আর
রাজীব তৃপ্তি নিয়ে ওর বোনের খাওয়া দেখছে। খাওয়া শেষে হোটেলের
বিল মিটিয়ে রাজীবের জন্য রইল ৫ টাকা। সারাদিন কষ্ট করার পর খাবার হিসেবে
জুটলো একটা রুটি।
রাত হয়ে গেছে। রাজীবের বোনটা রাজীবের কাধে ঘুমিয়ে পরে যাচ্ছে।
বোনকে নিয়ে থাকার জন্য একটা জায়গার প্রয়োজন। লাল রং করা ওই ভবনটির নিচে
থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খোলা জায়গাতেই বোনকে নিয়ে শুয়ে পড়ল।
বোনটার বয়স মাত্র ৩ বছর বলে হায়নার দল এখন ছোবল দিতে আসছে না। তবে
গতকাল একজন বলে দিয়েছে, "মালটাকে বড় কর। খেয়ে দেখতে হবে তো
টেষ্ট কেমন!" কথাটা শোনার পর রাজীবের মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। ইচ্ছে
করছিল খুন করে ফেলতে। কিন্তু বোনের কথা চিন্তা করে পারেনি। ছোট
বেলা থেকেই বোনটাকে কাধে করে মানুষ করেছে। অসম্ভব রকম ভালবাসে
বোনটাকে। প্রতিরাতে বড় বড় সব স্বপ্ন দেখে ওকে নিয়ে। আজকেও স্বপ্ন
দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল বোনটা ওর পাশে নেই। একটু দুরে পরে
আছে রক্তাক্ত লাশ হয়ে। হায়নারা লুটে পুটে খেয়ে গিয়েছে। ৩ বছরের
মেয়েটা আজ আর রেহাই পায়নি ওদের হাত থেকে। ছোটবোনের
ক্ষতবিক্ষত দেহ রাজীবকে পাগল করে ফেলল। রাজীব এখন অনেক হালকা।
কাধের বোঝাটা আর কাধে নেই। তবে রাজীব নিজের অজান্তেই কাধের
বোঝাটাকে অনুভব করার জন্য পিঠের মধ্যে হাত বুলায়। আর যখন দেখে
বোঝাটা নেই তখন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। আজকেও রাজীব অন্যমনস্ক হয়ে
হেঁটে চলেছে। হঠাৎ একটা গাড়ি এসে রাজীবকে চাপা দিয়ে চলে গেল।
রাজীব লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। কালো পিচঢালা রাস্তা লাল হয়ে গেল রাজীবের
রক্তে। এমনিভাবে শেষ হয়ে গেল রাজীবের জীবনের গল্প।
[গল্পটা কাল্পনিক। তবে আশেপাশের রাজীবদের জীবনের গল্পগুলো
এমনই। যেগুলো আমাদের মত সভ্য মানুষদের ভাবায় না। এগুলো আমাদের কষ্ট
দিতে পারে না বা আমরা এগুলো থেকে কষ্ট পাইনা। তবে আমরা "বাজরাঙ্গী
ভাইজান" মুভির মেয়েটার জন্য কষ্ট পাই। "টাইটানিক" মুভির নায়ক মারা গেলে কষ্ট পাই।
শুধু কষ্ট পেয়েই ক্ষান্ত ক্ষান্ত হইনা, প্রচন্ড রকম কাঁদি। কাঁদতে কাঁদতে সর্দি
লাগিয়ে ফেলি। এই কান্নায় কোন লাভ নেই। আসুন, রাজীবের জায়গায় একবার
নিজেকে কল্পনা করুন। গভীরভাবে উপলব্ধি করুন। বিদেশি মুভি দেখে না
কেঁদে সত্যিকারের রাজীবদের জন্য কাঁদুন। ওদের জন্য কিছু করুন।]
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২০