ওর নাম পরী। বয়স ৭/৮ হবে। ঘরে অসুস্থ মা তাই রাস্তায় রাস্তায় ফুল বিক্রি করে সংসার চালায়।
পরী নাম কেন জানতে চাইলে, ছোট কালে আমি দুধের লাহান সাদা আছিলাম তাই মায় নামডা রাখছে। অহন রইদে রইদে ফুল বেইচা কালা হইয়া গেছি ছ্যার বলেই হাসি দিল পরী। কচি মুখের হাসি এ যেন মেঘের কোলে রোদ ওঠেছে।
- বাবা কোথায় প্রশ্ন করলাম?
হুনছি আমি গেদা কালে বাপে মইরা গেছে। পরীর চোঁখের কোণে পানি টল টল করছে তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল; তাই কথা ঘুরিয়ে বললাম...
- পরী তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও? স্কুলে যাচ্ছো?
ছ্যার মায়ের অসুখ সাইরা গেলেই ইস্কুলে যামু অহন যাইবার পারি না; মিনমিন করে উওর দিল পরী। আমি ইস্কুলে গেলে মায় না খাইয়া মইরা যাইব। পরী একটু থেমে আবার শুরু করল...
ছ্যার আমি বই পইরা বড় হমু আর মায়রে কাজ করবার দিমু না। মায়রে মরুগের গোস্ত কিনা খাওয়ামো।
আমি যেন কোথায় হারিয়ে গেলাম। শুধু শুনেই যাচ্ছি....
পরী আবার বলতে শুরু করলো, আমার মায়রে অনেক দিন হয় রোগে দরছে; মায় কইছিল মরুগের গোস্ত খাইব। টেকা হয় নাই, তয় ছ্যার ফুল বেইচা টেকা মায়রে দিলে ১ টেকা দেয় মাদানের খাইবার দায়। অই টেকা আমি খাই না, জমা কইরা থুই। এক দিন ওই টেকা দিয়া মরুগ নিমু ছ্যার। মায় মেলা খুশি হইব। পরী নিজে নিজে হাসে। এ হাসি যেন বিশ্ব জয়ের, এ হাসির মাঝে লুকিয়ে আছে মমতাময়ী মায়ের প্রতি কচি হৃদয়ের ভালোবাসার টান।
- আবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি না খেয়ে কাজ করো কিভাবে সারা দিন? কষ্ট হয় না তোমার?
মলিন মুখে পরীর উওর, লাগলে ফানি খাই ছ্যার। কত দিন হয় পেট ভইরা ভাত খাইবার পারিনা ছ্যার। দু হাত দিয়ে চোখ মুছে পরী। তয় মার মরুগ নিমুনা, তহন মার লগে পেট ভইরা ভাত খামু। পরীর চোঁখে মুখে ফুটে উঠে প্রত্যাশার স্বপ্ন।
পরীর কথা শুনতে শুনতে কখন যে চোঁখ বেয়ে পানি ঝরছে বুঝতেই পারি নি।
কেন জানি পরীর সাথে আরও কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।
- পরী আজ কত টাকা বিক্রি হয়েছে ফুল?
পরীর হাসি মাখা মুখটা কালো মেঘের ভেলায় তলিয়ে গেল। নিচু সুরে বলল, ২৫ টেকা ছ্যার। মানুষ আইজকা ফুল নেয় নাই।
- টাকা দিয়ে কি কি কিনবে পরী?
মায়ের ওষুধ ও খাবার নিবে। পরীর মুখ থেকে উওর আসল ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে।
- তুমি এখনও কিছু খাও নি?
পরী উওর, মায়ের লগে খামু ছ্যার। মুখে ভালবাসা ও মমতা মাখা হাসি। হঠাৎ পরী বলে উঠল, ছ্যার যাওন লাগে অহন, মেলা কাষ্টমার দেহা যায়। হতের ইশারায় দূরে দেখায় পরী।
তাড়াহুরো করে আমার হাতে একটা ফুল গুঁজে দিল। আমি কথা বলতে পারছি না। কিছু বলার আগেই আমার কথা কেড়ে নিয়ে পরী বলে উঠল;
ছ্যার টেকা লাগব না, ফুলটা আফনেরে ফিরি দিছি। বলেই দৌড়........
কিছু বলব সে সুযোগ ও দিল না। পরী পিছনে ফিরে একবার তাকিয়েছিল। কি যেন বলবে মনে হচ্ছিল, কিন্তু কিছু না বলেই চলে গেল।
ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে টের পাচ্ছি। সামনে এগিয়ে গেলাম তবে আর পরীকে দেখা গেল না। মানুষের ভিড়ে কোথায় যেন মিশে গেল টেরই পেলাম না; নিস্তব্ধতায় শুধু চেয়ে রইলাম দূরের লোকালয়ে.......
বি:দ্র: আমার লিখা এ গল্পটি ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ফেইসবুকে ভাইরাল হয়।
ছবি: জি এম বি আকাশ স্যার।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:১৮