শান্তশিষ্ট, সুদর্শন, মিষ্টিভাষী, সুন্দর মনের এক মানুষের নাম Tanvir Afsar Topu। আমাদের পরিচয়টা ২০১৩ সালের প্রথম দিকে, ফেইসবুকের মাধ্যমে। কখনো সামনা সামনি দেখা হয়নি কিন্তু আমাদের কথা-বার্তা শুনলে রক্তের সম্পর্ক ভেবে অনেকেই ভুল করবেন। কিছু কিছু মানুষের বেলায় রক্তের সম্পর্কের প্রয়োজন হয় না। তারা সার্বজনীন, তারা সকলের, সকল মানুষের। তপু ভাই ছিলেন এমনই একজন সুন্দর মনের মানুষ। তিনি গান করতেন, মূলত সেখান থেকেই আমাদের পরিচয়। তার পর ফোনে কথা, চেটিং। তিনি আমাকে “অলি” বলে ডাকতেন। এই নামের মধ্যে আমি মায়া-মমতা ও ভালোবাসার পরশ খুঁজে পেতাম। তপু ভাইয়ের আচার-ব্যবহারে আমি এতটাই মুগ্ধ হতাম, যা কয়েক লাইনের শব্দে বুঝানো সম্ভব নয়। আস্তে আস্তে তিনি আমার প্রিয় মানুষদের মধ্যে একজনে পরিণত হন।
তপু ভাই একদিন আমাকে বলছিলেন, “অলি তোমার নাম্বার দাও, আমি তোমার সাথে দেখা করবো। তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসবো।” তখনও তিনি জানতেন না আমি প্রবাসে বসবাস করি। তখন আমার প্রবাস জীবনের প্রথম মাস। একটা সময় তিনি আমার সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। এর পর মাঝে মাঝেই তপু ভাইয়ের সাথে আমার কথা হতো। তিনি আমাকে গান শুনিয়ে বলতেন, “অলি গানটা তোমার কেমন লেগেছে?” এভাবেই আমাদের সম্পর্কটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। একটা সময় পাপড়ি থেকে কুঁড়ি হয়, কুঁড়ি থেকে ফুল। মায়া-মমতার সুভাসে মুখরিত হয় চারিদিক।
এর পর আমাদের জীবন থেকে দীর্ঘ একটা সময় চলে যায়। যদিও আমাদের কথা হয়না এখন আগের মতো কিন্তু সম্পর্ক এখনো আছে স্বচ্ছ-সুন্দর ঠিক সজীব প্রকৃতির মতো। শত ব্যস্ততায় আমাদের মধ্য বছর দুয়েক কথা হয়নি কিন্তু আমি ভাইয়ের পোষ্ট দেখলেই লাইক, কমেন্ট করে জানান দিতাম, ফুল গুলো এখনো ঝরে পড়েনি। আছে ঠিক আগের মতোই সুন্দর ও পবিত্র। ভাই উওর দেয়ার ক্ষেত্রে সবসময়রে মতো “অলি” শব্দটিই ব্যবহার করতেন, সেখানে কোন স্বার্থ ছিলো না। ছিলো শুধু মায়া-মমতা ও সুন্দর একটা সম্পর্কের অটুট বন্ধন!
ব্যস্ত জীবনে আমরা অনেক কিছুই ভুলে যাই। ভুলে যাই প্রিয় মানুষ গুলোকে। আমি ও ভুলে গিয়েছিলাম তপু ভাইকে। গতকাল হঠাৎ করেই তপু ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়তে লাগলো। বহুদিন ধরে তপু ভাইয়ের কোন পোষ্ট পাচ্ছি না। কথা গুলো ভাবতেই বার বার তপু ভাইয়ের কথা ঘুরে ফিরেই মাথায় আসতে লাগলো। নাম দিয়ে অনেক বার সার্চ দিলাম কিন্তু তপু ভাইকে খুঁজে পেলাম না। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আসলে আমি তপু ভাইয়ের পুরো নামটা ভুলে গিয়েছিলাম। আমি মাঝে মাঝে সব কিছু ভুলে যাই; এ সমস্যাটা আমার কয়েক বছর ধরেই হচ্ছে। এমন কি আমার বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের নাম পর্যন্ত মাঝে মাঝে ভুলে যাই। কেন এমন হয় জানিনা আমি। বড্ড খারাপ লাগছে, আজ তপু ভাইয়ের পুরো নামটাও ভুলে গেলাম। যে কারণে এখন ফেইসবুকে খুঁজে পাচ্ছি না।
কিছু দিন ধরে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। কিছুক্ষণ আগে তপু ভাইয়ের কথা আবার মনে পড়লো। কেন জানি সারাক্ষণ ভেতরে একটা অস্থিরতা কাজ করছিল। বার বার তপু ভাইয়ের কন্ঠটা ভেসে আসছিল বাতাসের সাথে। এটাই বুঝি ভালোবাসা! যা সবকিছু ঊর্ধ্বে! আজ ভেতরে অভিমান জমেছে খুব। তপু ভাইকে জিজ্ঞেস করবো, কেন এতদিন আমার একটা খুঁজ নেননি। বড্ড অভিমান হচ্ছে ভাইয়ের প্রতি। না শেষ পর্যন্ত ভাইকে পেলামই না। বুঝতে পারলাম আইডিটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে, আর না হয় তিনি কর্মব্যস্ত জীবনের সাথে মিশে গেছেন। ধারণাটা মিথ্যা নয়, একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। আসলে সময় এবং স্রোত কারো জন্যই অপেক্ষা করে না। তপু ভাইয়ের সাথে কথা হয়না প্রায় দু-বছর, অথচ সময় গুলো যেন কিভাবে চলে গেলো। সময়রে গতি দ্রুত জানতাম, কিন্তু এত দ্রুত হবে বুঝতেই পারিনি। কথা গুলো ভাবতেই আমার খুব অবাক লাগছিলো! এখন থেকে সময় পেলেই তপু ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করবো। প্রিয় মানুষরা কাছে না থাকলে তাদের মূল্য বুঝা যায়। আমি ও বুঝতে পারছি আজ। এখন থেকে আর ভুল হবে না। তপু ভাইকে খুঁজে বের করবোই এবং নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করবো, সেই পণই করেছি নিজের সাথে।
আজকে কাকতালীয় ভাবে তপু ভাইয়ের আইডিটা যেন কিভাবে সামনে এসে গেলো। সাথে সাথে আইডিতে ক্লিক। শেষ পোষ্টটি ছিল ২০১৭ সালের জুন মাসের ২৬ তারিখে। তাহলে আমার ধারণাই সঠিক হলো। ভাই তাহলে কর্মব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, যে কারণে ফেইসবুকে আসতেই পারেন না। বিষয়টা বুঝতে পেরেই জমে থাকা অভিমান ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। ২০১৭ সালের জুন মাসে দেয়া শেষ পোষ্টে ছোট্ট করে একটি কমেন্ট করলাম, “ভাই আপনি ফেইসবুকে আসেন না?”
উপরের একজন লোককে দেখলাম, তপু ভাইয়ের গাওয়া গানের লিঙ্ক দিয়ে কমেন্ট করেছেন। বুঝতেই পারলাম ভদ্র লোকটি ভাইয়ের গানের ভক্ত। কি মিষ্টি গানের গলা তপু ভাইয়ের! যে কেউ ভক্ত হয়ে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। আরেকটু উপরে গেলাম কে কি কমেন্ট করেছে দেখার জন্য। একটি কমেন্টে চোখ আটকে গেলো আমার। একটি লোক লিখেছেন, “মহান আল্লাহ পাক উনাকে বেহেস্ত নসীব করুন”।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, এসব কি বলছে লোকটি! আরও উপরে গেলাম, আরও কয়েকটা কমেন্ট দেখলাম। হঠাৎই তপু ভাইয়ের কন্ঠটা কানে ভেসে এলো, “অলি তুমি যখন দেশে আসবে আমি তোমার সাথে দেখা করবো; আমি তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসবো।”
তপু ভাই, আপনি’তো আপনার কথা রাখেননি। এমনতো হবার কথা ছিলো না।
ভাই এ আমার চোখের অশ্রুজল নয়,
এ আমার ভেতরে জমে থাকা অভিমান; তার পূর্ণতা পেয়েছে চোখের জলে। মায়া-মমতায় যখন বেঁধেই ছিলেন, তবে কেন দূর আকাশের তারায় হারালেন?
মাঝে মাঝে আমার নামটি ধরে ডাকবেন। মমতা জড়ানো কন্ঠে আপনার ডাকে সাড়া দেব। তপু ভাই, আপনি কথা রাখেননি, আমি রাখবো। কথা দিলাম.....
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১১:০১