আড়মোড়া ভাংগাটা আমার কাছে একটা শিল্প মনে হয়। ঘাড়-কাঁধ-হাত-মাথা মুচড়ে দির্ঘ হায়ের সাথে গতো একদিনের জমানো ক্লান্তি আর ক্লেদের নির্যাস ছুঁড়ে দিয়ে নির্ভার হই। শুধু জনসন বারের উপচে পড়া হুইসকির ঝাঁজ আর নাচুনে মেয়েটার টলে ওঠা নিতম্বের কিছু অবসাদ চোখে ঝুলে আছে। থাক, যতো ইচ্ছে। এই ঘরের আট বাই বারোর চৌকষ বিস্তৃতি আমাকে চেপে-চুপে গুমোট করে রাখতে চাইলেও, ছোট্ট একটুকরো জানালা মাঝে সাঝে আমাকে সবুজ রাখতে চায়, বেদনা-বিধুর মেপল আর পাইনের সারি বাচ্চাদের আর্টখাতার আঁকিবুঁকি হয়ে ঝিমুচ্ছে অনেক দুরে। কে চাই বাল তোর সবুজ? তুষার-বাজিতে ঘোলা জানালাটাকে হঠাৎ করে অশ্লিল লাগে আমার। মাঝে সাঝে জানালা গলে নিচে তাকালে পিঁপড়ের মতো মানুষ আর গাড়িগুলো হাভাতের মতো ডাকাডাকি করে।
আহ! এক কাপ কফি নিয়ে কেউ যদি আসত!
কিচেন খুজঁতে মাথা মুচড়ে বায়ে তাকাতে নিস্পৃহ টেবিল ঘড়িটা চোখে পড়ে, শালা ঠান্ডা চোখে বলে দিচ্ছে আজকেও লেট। লং রোড কউন্টি রেস্টুরেন্টের হেঁসেল আজকের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে আমার জন্যে। হোক। মিচেল ফ্রস্ট, চুতিয়া তুমি মুড়ি ভিজায়ে খাও। আমি ব্ল্যাংকেটের ওমে আরো ঢুকে যায়, শুধু এক কাপ কফি হতচ্ছাড়ার মতো আমার ঠোঁট দুটো জমিয়ে দেয় শীতে।
আহ! এক কাপ কফি নিয়ে কেউ যদি আসত!
আমি ভাবতে থাকি, কে কে আসতে পারে এক কাপ কফি নিয়ে। এরকম ভাবনা ঠোঁট-জীভ জুড়ে ওমের ঢল নামায়, ক্যাফিনের কল্পনায় নিউরন গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। কে আসবে কফি নিয়ে?
প্রথমেই আজিমপুর গোরস্থান নিবাসি আমার বাপ বাতিল হয়ে যায়; আর আমার মা'ও পতিভক্তিতে গরম কফির হাতল ছেড়ে দেন। হুমম! আমার বোন? ন্নাহ! থাক, হাযার মাইল উড়ে এক কাপ কফি তাদের জন্য একটু বেশি ভারি হয়ে যাবে। একটা অসম্পুর্ন হাসির বলক ফুসফুস ছেড়ে বেরুতে যেয়ে কি মনে করে আটকে থাকে, মনে হয় বাইরের তুষার পতন ওদের ঠিকঠাক ফুটতে দেবে না এই ভয়ে।
হুমম! তাইলে কে? পাশের ঘরের কালো জেরোমী? ধরা যাক জেরোমী এক কাপ উত্তেজক কালো কফি হাতে আলতো নক করল আমার দরযায়। আমি বল্লাম, হাল্লো জেরম! আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম। কি কপাল দেখ আমার, এই ওয়েদারে কম্বলের তলা থেকে এক্টুও না বেরিয়েও এক কাপ কফি! তা জেরম ডিয়ার, আমার পশ্চাৎদ্দেশ তো এতো সুগঠিত নয়, যে তুমি এই ওয়েদারে এতোটা কস্ট করবে! আরে....যাচ্ছ কই, থামো না মিয়া। হাহ! অসম্পুর্ন হাসিটা আবার ফিরে আসে....জেরোমী বলছিল হোমলেস মানুষগুলো লংরোড কাউন্ট ক্রিকের ওপারে পরিত্যাক্ত একটা ফার্মহাউজে শেঁকড় গেড়েছে, দিনে একবার সরকারী খাবারের ভ্যান যায় ওখানে। এই জবটা হারালে জেরোমী নির্ঘাৎ ওখানে গিয়ে উঠবে, এটাও জানিয়েছিল ও। অথবা আগের পেশায় ফিরে যাবে; ড্রাগ ট্রাফিকিং বা বেশ্যার দালালিতে।
হুম, জেরমী বাতিল। ক্রিস্টি? উম, খদ্দের সামলে এক কাপ কফি তৈরীর ফুরসত কি হবে ক্রিস্টির? যদিও এই সময়টাতে ক্রিস্টির বাঁধা খদ্দেরদের পকেটের পেনির ঝাঁক উষ্ণ নারীমাংশের চাইতে পোর্কের ঠান্ডা মাংশের দিকেই বেশি দৌড়ুচ্ছে! ধরা যাক ক্রিস্টি কফি হাতে আমার দরযায় টোকা দিল.....
ক্রিস্টিকে আমি হপ্তায় দু'তিনবার কল্পনায় যেভাবে দেখে থাকি অথবা বলা ভালো যেভাবে চেখে থাকি, সেরকম গনগনে হয়ে এক কাপ কফি হাতে আমার আওতার ভেতর এসে দাঁড়ালো। বাইরে তাপমাত্রা যতোই শুন্যের নিচে দাপাদাপি করুক আমার আট বাই বারোর ঘুপচিতে ক্রিস্টির প্ররোচনায় সেটা তরতরিয়ে বাড়তে থাকে।
"হাল্লো ক্রিস"
"তোমাকে না বলেছি, আমাকে ক্রিস ডাকবে না"
"ক্রিস, দেখেছ আজকের ওয়েদারটা কি সুন্দর!"
ক্রিস্টির চিকন ভ্রু জোড়া, যাদের মাঝে মাঝে লংরোড কাউন্টির একমাত্র ক্রিকের বাঁকের মতো মনে হয়, সেই ভ্রু জোড়া বিরক্তিতে কতটুকু ভেংগে চুরে যেতে পারে তা দেখার প্রত্যাশায় আমি মাস ছয়েক দুরের বসন্তকে লংরোডে তুলে আনি।
"কফিটা নাও, আহম্মক। আশা করি রাতের হ্যাংওভার কেটে যাবে, তাতেও না হলে ন্যাংটো হয়ে রাস্তায় নেমে যাও।"
হাহ, ক্রিস্টি আসবে না। এক কাপ কফি তৈরীর সময়টুকু খদ্দেরদের পেইড সময়ের চাইতে লাভের হিসাবে নেহায়েতই অনুৎপাদনশীল! আমি ক্রিসটির সোনালি চুলের বছরখানেকের ছেলেটার কথা ভাবি। মাস খানেক আগে; ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে কাবার্ডে রেখে খদ্দেরের জিপার খুলছিল সে। মাঝপথে বাচ্চাটার ঘুম ভেংগে সে এক বিচ্ছিরি অবস্থা; পুলিশ, সোশ্যাল সিকিউরিটির লোকজন এবং সোনালীচুলো বাচ্চাটাকে নিয়ে গেল ওরা।
কফি প্রত্যাশিত জিভ দ্রুত শীতার্ত হতে হতে একসময় আড়স্ঠ হয়ে পড়লে ফুসফুসের মধ্যে যে আধখানা হাসি সম্পুর্ন হতে চাইছিল, সেটা মিইয়ে যাবার আগেই আমি ওঠার প্রয়াশ পেলাম।
"থাকিতে হস্ত, কেন হইব অন্যের দারস্থ?"
ঘরে ঘোলা আঁধার, কিচেনের দরজা আবছা খোলা। হিহি কাঁপতে কাঁপতে গতো কয়দিনের জন্জাল জমা কিচেনে কফি মেকারটা কোথাই ঘাপটি মেরে আছে খুঁজতে যেয়ে মনে পড়ল শালার কফি ফুরিয়েছে দুদিন হলো। কেমন যেন অসহায় লাগে, নুয়ে পড়া কাঁধ নিয়ে জানালার কাছে আসি। হীম কাঁচে নাক ঠেকিয়ে নিচে তাকাই, দেখি ছোট্ট ছোট্ট তুষারমাখা মেঘ ল্যান্ড করছে অনেক নিচে। এতো উঁচু থেকে রাস্তাটা খুব রোগা দেখাচ্ছে, মাঝে মাঝে মনে হয় জানালা গলে টুপ করে যদি পড়ে যায়, তাহলে কী কী ঘটতে পারে?
কান-মাথা ঢাকা গরম জাম্পারের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে ভাবছিলাম আমি। লাফ দেওয়ার কতক্ষনের মধ্যে লংরোডের রোগা রাস্তাটা আমাকে আপন করে পাবে? এমন কি হতে পারে ভাসতে থাকলাম মাধ্যাকর্ষন শক্তিকে কাঁচকলা দেখিয়ে?
পাশের আ্যাপার্টমেন্ট-এ রুথ নামের ৮০/৯০ বছরের এক বুড়ি থাকে, সবাই এড়িয়ে চলে ওকে। যাকে পাবে তাকে পাকড়াও করে ওর নিখোঁজ পোষা কুকুর টেরির কথা জনাতে চাইবে; "তোমরা টেরিকে কেউ দেখেছো, বাছা? না বাছা, কোন ভয়ংকর হাউন্ড নয় টেরি, এই এত্বটুকু কিউট একটা পুডল। হ্যা, হ্যা, আমি লংরোডের সবকটি দেয়ালে ওর ছবি সেঁটে দিয়েছি। বলছো ওকে খুঁজে পাবো? ঈশ্বর তোমার মংগল করুন বাছা!"
তো, দরজাটা লক করে, পা টিপে টিপে বুড়ি রুথের সিমানা পার হতে যাবো; এমন সময় ধরলো ক্যাঁক করে।
"কে রিড্রো নাকি বাছা?"
"রিড্রো না রুথ, রুদ্র।" ভাবলাম ধরা যখন পড়েই গেছি, বুড়ির কাছ থেকে ওর কুকুর হারানোর গল্প শোনা বাবদ কফিটা বাগিয়ে নেব কিনা?
"হ্যা, হ্যা রিড্রো। বাছা তুমি টেরিকে দেখেছো?" তারপর শুরু হয়ে গেল তার কুকুর বন্দনা।
"রুথ" কন্ঠে বিরক্তি না ঢেকেই বলি আমি," টেরি হারিয়েছে তা প্রায় ২ বছর হতে চললো, এখনো খুঁজছো ওকে?"
"না বাছা, ভুল করছো তুমি। গতো রাতেও তো টেরি ছিল আমার সাথে, গাল-নাক চেটে দিয়ে শুয়ে পড়েছিল আমার সাথে। ঐ দ্যাখো, ডগ ফিডারে এখনো খাবার পড়ে আছে ওর।"
"রুথ, তুমি আরেকটা কুকুর নাও না কেন? টেরির মতো, পুডল?" পুডল আমি দুচোখে দেখতে পারি না, তারপরেও বল্লাম ওকে। বিরক্ত হলো রুথ, মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, "টেরির মতো আর একটিও কুকুর নেই পৃথিবীতে, রিড্রো!"
হাহ, কুকুর নিয়ে এদের আদিখ্যেতা দেখলে গা জ্বলে আমার! আরে বেটি জানিস, বাংলাদেশ-মেক্সিকো থেকে প্রতিবছর কতো মেয়ে হারিয়ে যায়? খুঁজে দেখ মধ্যপ্রাচ্য অথবা স্টেটস এর কোন ব্রোথেলে। খেলাম না তোর কুকুরের গন্ধওয়ালা কফি! গজগজ করতে করতে বিল্ডিং এর লক্কড়-ঝক্কড় লিফ্টে সেঁধিয়ে যাই।এই কংক্রিটের খাঁচার একমাত্র এই অংশটিই আমার ভালো লাগে। প্রতিটি ফ্লোরে নামছে-উঠছে, কতো মানুষের মানচিত্র এঁকে উঠছে লিফ্টের একরত্তি এই স্পেসে! ১৮ তলায় উঠলো পিংক ফ্লয়েড প্রবাহিত লালচুলের এক তরুন। দুবছর ধরে প্রতিদিন দুবার করে দেখছি, লিফ্টের মধ্যে দেয়ালে ইটের পর ইট সাজিয়েই যাচ্ছে সে! ১৭ তে উঠবে চেক শার্ট নীল পুলওভার পরা টেকো এক লোক, লিফ্টের নির্দিস্ট একটা অংশে বাঁ কাঁধটা ঠেসে দিয়ে শাপ-শাপান্ত করবে ওবামা প্রশাষনকে। ১৬ তে উঠবে মধ্য হলদে মুখো এক ইমিগ্র্যান্ট, লিফ্টে যাকেই পাবে তাকে বলবে। "ওয়ার্ল্ড ইজ আ ফাকিং ক্রেজি প্লেস, ড্যুড, ইজ ইনট?" কেউ যদি ভুল করে সাড়া দেয় তাহলে সে বলবে, "দেন হোয়াই আর ইউ ফাকিং আ্যারাউন্ড হেয়ার?!" কিন্তু আজকে তেমন কাউকে দেখলাম না, শুধু চেক শার্ট-নীল পুলওভার চকচকে মাথা নাড়তে নাড়তে লিফ্টে উঠে বাঁ কাঁধটা ঠেস দিয়ে মৃদু নড করলো আমাকে, তারপর নিজের মনেই শুরু করে দিল ট্যাক্স ক্যালকুলেশন এরপর ওবামা এবং বুশ প্রশাষন কে শাপ-শাপান্ত শুরু করলো।
"শুনেছ, র্যান্ডল তো এক কান্ড করে ফেলেছে?" চেক শার্ট শুধালো আমাকে। র্যান্ডলের কান্ডের চাইতে কফি তৃস্নার প্রাবাল্য আমাকে অধিকতর নাড়া দেয়। আমি মাথা নাড়ি। সে কথার খেই ধরে," র্যান্ডল ছাদের কার্নিশে দাড়িয়ে আছে, লাফিয়ে পড়বে এক্ষুনি, বাইরে হুলস্থুল পড়ে গেছে। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস সে এক এলাহি ব্যাপার!" চেক শার্ট ওবামা প্রশাষনের উপর এর দায় চাপিয়ে শাপ-শাপন্তের ফোয়ার খুলে দেয়। হঠাৎ করে নিম্নগামি লিফ্ট টাকে খুব ধির মনে হয় আমার। র্যান্ডল কে আমি চিনি না কিন্ত ওর আত্মখুনের প্রস্তুতি ও তা ঘিরে ঘনিভুত চান্চল্য নাড়া দেয় আমাকে। পুলিশ কর্ডনের ওপাশে, মৃদু তুষারপাত নাকচ করে ওপরে তাকালে দেখি আমাদের বিল্ডিং এর ছাদের কার্নিশে ছায়া-ছায়া র্যান্ডল। লংরোড কাউন্টির সব মানুষ ভেংগে পড়েছে এখানে, এই পতন্মুখ তুষারের সাথে র্যান্ডলের নাটকিয় আলিংগনের জন্য সবার ত্রস্ত অপেক্ষা। অপেক্ষমান মানুষগুলোর সেলফোনের ক্যামেরায় দুদ্দাড় ঢুখে পড়ছে ছায়া-ছায়া র্যান্ডল। সবার কী রুদ্ধশ্বাষ প্রতিক্ষা। একজ চিৎকার করে বললো, "ফাকঅফ ম্যান, জাম্প জাম্প!!" মন্দার এই সময়ে র্যান্ডলই প্রথম নয় লংরোডে, গতো ১৫ দিনে অনন্ত ৩ জনের খবর জানি আমি। আহা, র্যান্ডল, তুমি কী জবলেস, তোমার ক্রেডিট কার্ডের প্রহেলিকা অস্তমিত, বাচ্চাটার স্কুল ছাড়িয়ে দিয়েছ, বউ এক্সট্রা ইনকামের জন্য হতে যাচ্ছে পর্নস্টার, নাকি তুমি চেখে নিয়েছ সেই অমল রোদ্দুর; আর কিছু দেখার বাকি নেয় তোমার? আমি জানি না। এই প্রবল শীতে র্যান্ডলকে একা ফেলে কফি শপের দিকে যেতে হয় আমাকে। কিন্ত র্যান্ডলের আত্মখুনের দৃশ্যশিকারে কফিশপের মালিকও সামিল হলে আমি হতাশায় ভেংগে পড়ি এবং বলি;"ফাক ইউ র্যান্ডল!"
কফিশপের পাশের গলিতে, "গড সেভ আ্যমেরিকা" লেখা দেয়ালে হেলান দিয়ে ক'জন হোমলেস বুড়ো, তোবড়ানো ড্রামে আগুন জ্বেলে ওম ভাগাভাগি করে নিচ্ছে ওরা। আমাকে দেখে ডাকলো সস্নেহে। "এসো বাছা, এই শীতে একটু গরম হয়ে নাও।" আমি ওদের সাথে ঘনিস্ট হয়ে দাঁড়ায়, বাতিল ড্রামের আগুন আমাকে নিয়ে যায় অনেক আগের কুড়িগ্রাম কি ভুরুংগামারিতে।
ওদের মধ্যে একজন, সস্তা মদে চুর, আমাকে শুধায়,"বাছা, ছেলেটা কি লাফিয়ে পড়তে পেরেছে?"
আমি মাথা নাড়ি। ওদের মধ্যে একজন আমার হাতে হাতলহীন তোবড়ানো একটা কাপ ধরিয়ে দেয়; "ব্ল্যাক কফি।একটু খাও, চাংগা বোধ হবে।"