অজগর আঁধার অনেক আগেই গিলে ফেলেছে আমাদের; এখন তার সর্পিল পেটে জারিত হচ্ছি। আমার ক্লায়েন্টের নার্ভের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে, ভোক্তা গবেষনার ফাইন্ডিংস থেকে বেরিয়ে আসা দানব; ক্লায়েন্টের মনোজগতের হাড়মাংশের ছিবড়ে বানিয়ে বিপুল খিদে নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ক্লায়ান্টের কাঁধে টোকা দিই আলতো। আমরা বাজারীরা ভালো করেই জানি, কোথায় টোকা দিলে বাজে ভালো।
"স্যার, এটাই কিন্ত ফাইনাল রাউন্ড, আপনি তৈরী?"
ক্লায়েন্ট দ্রুত মাথা ঝাঁকায়, যেন কাঁধ থেকে ছিড়ে ফেলতে পারলে বাঁচে। কালিগোলা অন্ধকার, পরিমিত আলোর কুচি আর এর সাথে পূর্বনির্ধারিত আবহ সংগিতের ফিউশন প্লে গ্রাউন্ডটাকে প্রত্যাশা মতো বিকট করে তুলেছে।
"স্যার সামনের বৃত্তটার দিকে চোখ রাখেন!"
কৃত্তিম গাছের গুড়ি নিচে অপ্রাকৃতিক গর্তে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছি আমরা। ক্লায়েন্টের হাতে প্রাচিন বো-গান, শরীরের সব রক্ত চোখে জমিয়ে তাকিয়ে আছেন বৃত্তের দিকে। কব্জির নিচে ঝুলে থাকা সময়ের চেপে ধরা টুঁটি ছেড়ে দিতেই কয়েক হাজার বুনো বাইসনের মতো ফেটে পড়লো চারদিক! ইভেন্ট এ্যাসিসটেন্টরা খেদিয়ে নিয়ে আসছে টার্গেট'টাকে। একটা নাচুনে আলোর বিম কৃত্তিম অরণ্যের পরিকল্পিত শরীর তছনছ করে শেষমেষ টার্গেট'টাকে গেঁথে ফেলে। যেন অতিকায় কালো পাহাড়, শরীরে অসংখ্য ক্ষ্যাপা সিংহ পুরে ছিটকে পড়ে নির্দিস্ট বৃত্তের ভেতর। ওর হাতের বর্শাটা হাস্যকর বিভ্রান্তি হয়ে বালখিল্যতায় ঝমকাচ্ছে খুব! চরকির মতো কয়েক পাক ঘুরে টার্গেট টা থিতু হতে চাইছে বৃত্তের কেন্দ্রে, যেন মৃত্যচুম্বনউদ্যত কেউটে! ছেঁড়া গেন্জির নিচে মোচড় খাচ্ছে অ্যানকোন্ডা পেশি, প্রায় ছ'ফুটের মতো লম্বা- টার্গেট হিসাবে প্রায় নিঁখুত। প্রান্তিক বিশ্ব থেকে বাছাই করা; সিমাহীন ঘৃনা, বিপুল ক্ষিদে আর গলাটিপে ধরা ভয়-এর পারফেক্ট মিশ্রনে টার্গেটটা হয়ে উঠেছে অনেকটায় পার্থক্যকৃত।
"এইবার!" চেঁচিয়ে উঠি আমি।
ক্লায়েন্ট এর বো-গানের প্রথম তির টার্গেটের উরু ফুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পথে হাড়ের বাৎসল্যে আটকে যায়। কিন্ত হতচ্ছাড়ার গলা চিরে প্রত্যাশিত চিৎকারটা না বেরুলে ক্লায়েন্ট খেপে ওঠেন।
"ওর চোখ বেঁধে দেওয়ার ব্যাবস্থা করেন!"
"কিন্তু স্যার, টার্গেট এর চোখ বাঁধার বিষয়টা এগ্রিমেন্টে ছিল না, তাছাড়া এটা কিন্তু খেলার উত্তেজনাকে অনেকটায় কমিয়ে দেবে।"
"য়্যু মাদাফাকা! এগ্রিমেন্ট কপচাবেন না আমার সাথে, লাগে আরো কিছু ইউনিট চার্জ করে নিয়েন। আর হ্যা, আমার একটা বেসবল ব্যাটও লাগবে।"
"কাস্টমার ইজ দ্য কিং" এই প্রাচীন আপ্ত বাক্যটা এখনো সমান কার্যকর, তাই ঠোঁটের হাসিটাকে ঝুলে পড়তে দিই না আমি, তা ছাড়া অতিরিক্ত ইউনিটও এক্ষেত্রে নিয়ামকের ভুমিকা নিয়ে নেয়। আর প্রতিযোগিতমুলক পরিস্থিতিতে আপনাকে সব সময় কিছু অলটারনেটিভ অপশান রাখতেই হবে।
"জ্বী স্যার, আপনি যেমন বলবেন।"
এরপর ইভেন্ট ম্যানাজারের সাথে যোগাযোগ করে খেলার মডালিটিতে কিন্চিৎ পরিবর্তন করা হলো, বৈদ্যুতিক বন্দুকের পরিমিত আঘাতে টার্গেটের চোখে কালো পট্টি বেঁধে ফাইনালি ক্লায়েন্টের হাতে বেস বল ব্যাট ধরিয়ে হাঁফ ছাড়ি আমি।
বাঁধা চোখে আচমকা অন্ধত্ব ভর করায় টার্গেট কিছুটা বিহ্বল, বর্শটা হাত বদল করে অস্বস্তি নিয়ে ঘুরছে সে। ক্লায়েন্ট ব্যাট নাচিয়ে সয়ংক্রিয় বলয়ের চারপাশে ঘুরছেন এবং ঘুরছেন, খানিক আগের সব উত্তেজনা বেমালুম গিলে খেয়ে আশ্চর্য শান্ত হয়ে গেছেন তিনি। হয় এমনটা, চুড়ান্ত মুহূর্তের আগে অনেকরই এমনটা দেখেছি আমি। প্রথম আঘাতটা হাঁটুর একটু নিচে, হাড় এবং ব্যাটের সাংঘর্ষিক সম্পর্কটা বিকট চিৎকার হয়ে ছিটকে আসে টার্গেট এর গলা ছিড়ে। এক পায়ের গোড়ালির উপর ভর দিয়ে টার্গেট তার বর্শটা চর্কির মতো ঘুরাচ্ছে চারপাশে, ওটা দিয়ে একটা ইঁদুর মারাও সম্ভব নয়। সেফটি ফার্স্ট।
ব্যাটটা এবার টার্গেটের কালো চামড়ার নিচে দ্রুত সন্চারনশীল পেশিগুলো থ্যাঁতলাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লে আমি একটা সিগার ধরায়, টার্গেটের চিৎকার পুর্বনির্ধারিত আবহ সংগীতে নতুন দ্যোতনার সৃস্টি করে। ক্লায়েন্ট টার্গেটের হাঁ হয়ে থাকা মুখে টর্পেডো গতিতে ব্যাটটা ছুঁড়ে দিলে আমি দেখি এক ঝাঁক রক্ত-ডোবানো দাঁত উড়ে যাচ্ছে উপরে, যেন নিপুন এ্যাক্রব্যাট। ভালান্টিয়ারকে ইশারায় নতুন অস্ত্রটা দিতে বলি, কাঁটা খচিত হালকা মুগুর। কাটথ্রট প্রতিযোগিতায় আপনাকে টিকে থাকতে হলে ভোক্তার নীডটা সঠিক ভাবে শনাক্ত করতে হবে। তাই এগ্রিমেন্টের সাথে সাথে আমরা ক্লায়েন্টের সাইকোমেট্রিক প্রোফাইলিংটা সেরে ফেলি, যেমন এই ক্লায়েন্ট কিছুটা স্যাডিস্ট এবং আমি বুঝতে পারছি; উনার কাছে বেস বলের ব্যাটটি উপযোগিতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। টার্গেটর দ্বীতিয় পা'টা ভেংগে ফেললে আমি কাঁটাযুক্ত হালকা মুগুরটা ক্লায়েন্টের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলি;
"স্যার, আপনি নিশ্চিৎ এইটা পছন্দ করবেন এবার।"
টার্গেটকে পুরো কিমা বানানো না পর্যন্ত ক্লায়েন্ট থামলেন না। মুগুরটার প্রতিটি কাঁটায় ল্যাপটানো মাংশ-চর্বি-চুল আমাকে ইংগিত দিচ্ছে আরেকটি সফল ক্লোজিং এর।
"স্যার, আপনি নিশ্চয় চাইবেন দারুন এই সময়টুকু ধরে রাখতে? আমরা পুরো ভিডিওটি আপনাকে পাঠিয়ে দেব।"
ক্লায়েন্ট অল্প হাঁপাচ্ছেন, রক্ত -ডোবানো একটা হাত আমার কাঁধে রেখে বললেন;
"ক্যুড য়্যু ডু মি আ ফেভার? আমি ঐটার উপর প্রস্বাব করতে চাই।"
"স্যার, আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত, আমাদের সার্ভিস অফারিংয়ে এই বিষয়টি নেই।"
তাঁর নিঃস্বাষ ঘন হয়, প্রায় বুঁজে যাওয়া গলায় বলেন;
"হিসাবের বাইরে কিছু নগদ ইউনিট পাবেন আপনি, অংকটা নেহায়েৎ ফেলনা না।"
তো আমাকে রাজি হতেই হয়, এবং আগেও বলেছি ইউনিট অনেক সময় সব কিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে পারে।
"স্যার, দুই মিনিটের জন্য সেট অন্ধকার হয়ে যাবে। এর মধ্যে আপনাকে সারতে হবে।"
"ওকে, প্যাকআপ! লাইট বন্ধ!"
আমার চিৎকারে ইভেন্ট এ্যাসিসটেন্টদের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি পড়ে যায়। হাড়-মাংশ-চর্বি-ঘিলুর স্তুপে আছড়ে পড়া ধোঁয়া ওঠা প্রস্বাবের ঝাঁজ আমার নাকের সুড়ং দখল নিয়ে হানাদারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে মাথায়, আমি আরো লম্বা করে শ্বাষ নিই।
(আগামি পর্বে সমাপ্য....)