বিজয়নগরের মোচড় খাওয়া রাস্তার কোমরে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো সাদা মাইক্রোর সামনের সিটে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা সাইদুরকে, প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে হইবারনেশন্ড মেটে গুই। ওর আধখোলা চোখে অনাগত বসন্তের চাপল্য থাকতে পারে বা এ সংক্রান্ত কোন ফ্যান্টাসির ফোরপ্লে। ড্রাইভিং সিটের ওম ছেড়ে চর্বি-শিকারি একজন বাংলাছবির পোস্টারে ঢুকে পড়েছে দুদ্দাড়। খসড়ার আঁকাআঁকি মোতাবেক ৫ ক্রিটিক্যাল পজিশনে বাকি ৫ ক্রিটিক্যাল রিসোর্স উৎপাদনের ভ্যালু চেইন মেইনটেইন করছে।
কালো পোশাকের দেবদুতের কালো চশমা ক্যামেরার ফ্ল্যাশে ঝলসে গেলে দেবদুত কিছুটা বিরক্ত হন, বিরক্তির কয়েক ফোঁটা তার ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে যায় অপেক্ষমান সাংবাদিকদের দিকে;
"দেখুন তথ্যপ্রযুক্তির যুগে দুস্কৃতিকারীরা এখন অনেক বেশি স্মার্ট। কালো পোসাকে বা এসব পোসাক পরিহিত পক্ষের নামে তারা এমন কিছু করছে কিনা সেদিকে আমরা তিক্ষ্ণ নজর রাখছি।"
দেবদুতের কালো পোসাকের পবিত্রতা নিশ্চিত হলে সাদা পোসাক পক্ষ নিজেদের শ্রেনী বৈষম্যের শিকার ভাবতে থাকে। তারা বরং রাস্ট্র ও ভোক্তা নিয়ন্ত্রিত বোকা বাক্সে গ্ল্যামারহীন স্বরাস্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য শোনে;
"দেশে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি বা ঘটলেও সেটা বিরোধীদলের ষড়যন্ত্র"
এই মনোটোনাস চরিত্রগুলোর ডায়ালোগ নতুন কোন বোতলে পুরলে পরিবেশনযোগ্য হবে কিনা সেটা যখন প্রশ্ন সাপেক্ষ হয়ে পড়ে তখন কাঁচাপাকা ও ঝাঁটা গোঁফের অধিকারি জনৈক মানবতাকর্মি, গুপ্তহত্যা বিষয়ে তার উৎকন্ঠা প্রকাশ করে, কিছুকাল পুর্বের এক অভাগা কিশোরের বিচ্ছিন্ন পা এবং কালো পোষাকের দেবদূতদের অলৌকিকত্ত নিয়ে বিবিধ মিডিয়ায় রোলপ্লে'র সাথে আরেকটি সাফল্যের পালকের স্পর্শ পান। অনাগত সাফল্যের সুবাতাসে তাঁর ঝাঁটা গোঁফে আরেক পোঁচ তুষারের ছোপ পড়ে এমনকি এই সুবাতাসে তার কোন এক জেলখানা পরিদর্শনে অপারগতার আক্ষেপ উড়ে যায়।
মেটে গুঁই সাইদুরের শীতনিদ্রায় সন্তরনরত ৩ জন টার্গেট চর্বি-শিকারী ড্রাইভার সহো বাকি ৫ জনের চোখেও ছড়িয়ে পড়বে, খসড়ার নিখুত আঁকাআঁকিতে নির্দিস্ট আছে তা। বদলে যাওয়া এবং বদলে দেওয়ার শপথ নেওয়া একটি দৈনিকে গুপ্তহত্যা শব্দটি বোল্ড ফন্টে ফিরে ফিরে আসলে পাঠকেরা মাসুদ রানা সিরিজের রুদ্ধস্বাষ সাসপেন্সের গন্ধ পায় এবং তারা এতে রগরগে পেপারব্যাকের বাকি উপাদানগুলো খুঁজে পেতে চোখ কুঁচকে সেঁধিয়ে যায় প্রতিদিনের কাগজে, কখনো আজন্ম বিবাদমান প্রধান দুই পক্ষের কারো এক দিকে রিপোর্টারের কলম ঝুলে গেলে পাঠকের প্রেসার বেড়ে যায়, ফলে তারা কোলস্টরেল সমৃদ্ধ দুপুরের খাবারে রাশ টানে। সব টার্গেট মার্কেট বিবেচ্য হয়ে ওঠে চতুর মিডিয়া মোঘলের কাছে, ফলে সব গোত্রের পাঠকের কাছেই মেদ-মাংশ নিয়ে উপাদেয় হয়ে ওঠে তা।
সাইদুর জনা দশেক টার্গেট পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা যাবে এমন কিছু নাইলনের দড়ি আর চোখ বাঁধার কালো কাপড় মুড়িয়ে রেখেছে বদলে যাওয়া এবং বদলে দেওয়ার শপথ নেওয়া সেই দৈনিকের কয়েকটি পৃস্ঠায় এবং সেগুলো এই মুহুর্তে নিস্পৃহ শুয়ে আছে ওর পায়ের নিচে। সে দেখে রাস্তার মোচড়ানো কোমরের ওপাশে এটিএম বুথের বাইরে দুইজন টার্গেট সিগারেট ফুঁকছে, সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে সাথে তাদের টুকটাক কথা আর হাসির কুচি উড়ে আসছে এইদিকে। এটিএমের গুহা ছেড়ে ৩ নম্বর বেরিয়ে আসলেই খসড়ার আঁকাআঁকি মোতাবেক বাকি ৫ জন আলগোছে ঘিরে ধরে, কী যেন বলে। সাইদুর আধখোলা চোখে অলস তাকিয়ে থাকে; তার কোন তাড়া নেই বরং পাশের শো-রুমের মোটা কাঁচ গলে ৪২ ইন্চি এলইডির নগ্ন ঢুকে পড়া দেখে অপেক্ষমান টোকাই-ঝালমুড়ি বিক্রেতা-কয়েকজন বিকলাংগ ভিখিরী-প্রায় একই রকম একঘেয়ে চেহারার শ্রেনীসংটাপন্ন যুবক; এদের সম্মিলিত ঘোলা চোখে।
"ক্রমহ্রাসমান ক্রশফায়ার আর ক্রমবৃদ্ধিমান গুপ্তহত্যার মধ্যে কেউ যদি উদ্বেগের কিছু খুঁজে না পায় তাহলে আমার বলার কিছু নেই। রাস্ট্র এই দায় কিভাবে এড়াতে পারে?"
৪২ ইন্চি এলইডি টিভির ঔজ্বল্য থেকে টকশো'র সুবেশি তার্কিক ঝাঁঝালো হয়ে সবার ঘোলা চোখে করকর করে উঠলে সাইদুর আড়মোড়া ভেংগে শীতনিদ্রার খোলস ছিড়ে বেরিয়ে আসে, মাইক্রোর পেট উদোম করে এবং চর্বি-শিকারী ড্রাইভারকে বাংলা বি-গ্রেড ছবির নায়িকার বিপুল স্তন থেকে উঠে আসতে তাগাদা দেয়। খসড়ার আঁকাআঁকি মোতাবেক ৩ জন টার্গেটের বিহ্বলতা, আতংক মিশ্রিত ঘন নিঃস্বাষ ও অস্ফুট অভিযোগ মাইক্রোর উদোম পেটে চালান করে দিয়ে সাইদুর সামনের সিটে বসে এবং আসন্ন বসন্তের ফোরপ্লে চোখে পুরে শীতনিদ্রার প্রস্তুতি নেয়। ১ নং টার্গেট যে কিনা টার্গেট ২ এবং ৩ এর চাচাতো ভাই, প্রায় শোনা যায় না এমন কন্ঠে বলে;
"ভাই, আমার ছুড ভাই সৌদি যাইবো তো হ্যারে পিলেনে তুইলা দিতে আসছিলাম। আমরারে কই নিতাছেন? আমরা কি করছি?"
খসড়ায় এই একঘেয়ে ডায়ালগের বিপরিতে "আপনাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিস্ট অভিযোগ আছে-মানিকগন্জের ডাবল মার্ডারের দিন আপনেরা ৩ জন কই ছিলেন-আদম ব্যবসায়ের নামে ৭৬ লক্ষ টাকা মাইরা দিছেন-অসুবিধা নাই, বড়ো সাহেবে একটু ইনফরমেশন নিবো-কাউন্সিলার ইলেকশনে কার পক্ষে কাজ করসেন-চান্দাবাজি চুদাইসেন-প্রতারনা করসেন-প্রতিপক্ষরে ফাঁসানোর লাইগা নিজের কলাগাছ কাইটা ফেলছেন-পুকুরে বিষ দিয়া অবলা মাছ মাইরা ফেলছেন" ব্লা ব্লা কিছু কমন ডায়ালোগ থাকতে পারে এবং সেটা শীতনিদ্রার চেস্টা রতো সাইদুর ও বাকি ৬ জনের কাছে খুব বেশি গুরুত্তে পুর্ন হতে না পেরে অব্যক্তই থেকে যায়। ৩ নং টার্গেট স্বল্প বয়সহেতু তাদের অকস্মাৎ আটকের কারন জানতে চেয়ে গলা চড়ালে সাইদুর পেপার মোড়া নাইলনের দড়ি ও কালো রুমাল পেছনে চালান করে দেয়, ফলে টার্গেটগুলো পিছমোড়া ও চোখ বাঁধা অবস্থায় সাদা মাইক্রোতে কালো শহরের পাকস্থলির অনির্দিস্ট নাড়ি-নক্ষত্র ছিড়ে-খুড়ে ঘুরে বেড়ায়। এদিকে ২ নং টার্গেট এর পেটে ঈশা খাঁ হোটেলের সামনে ফুটপাতের বাসি প্যাটিস, কনডেন্স মিল্কের কড়া মিস্টির চা আর খান তিনেক গোল্ডলিফের অপরিশোধিত ধোঁয়ার রসায়নে ঘনিভুত গ্যাস ক্রমশ নিম্নমুখি হলে সে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। অস্বস্তি ভোলার জন্য সে কালো রুমাল বাঁধা চোখের পটভুমিতে একে একে আঁকতে থাকে; বৌ-বাচ্চা-পোয়াতি গরু-কয়দিন আগে হারানো চাইনা মোবাইল সেট-মৃত বাবা মার কবর-মুদির দোকানে ২ টাকা প্রতি মিনিট আর ফ্লেক্সির সুযোগ ইত্যাদি ইত্যাদি।
শহরের অধিকাংশ মানুষ পতংগে পরিনত হলে সাদা মাইক্রো একটা প্রাচীন উপাসনালয়ের পাশে দাঁড়ায় বেমাক্কা অলৌকিক ডাক শুনে। মাথায় মখমলের টুপি পরিহিত দুইজন পতংগ ঈশ্বরতন্ত্রে পন্ঞ্চবার্ষিকী পরিবর্তনের কথা বলে, ঈশ্বর প্রেরিত এলিট দেবদুতদের কথা বলে, দানব শিকারী দেবদুতদের মহান শিশ্নের কথা বলে এবং ঈশ্বরতন্ত্রের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই মহান শিশ্নের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনের পারস্পরিক সম্পর্কের কথাও বলে। তাদের পতংগ জীবনের সুরক্ষায় দেবদুতদের কালো বর্ম ও মহান শিশ্নের অবদানের কথা ভেবে তারা পাশ্চাদ্দেশে সুখের মতো ব্যাথা অনুভব করে এবং উপসনালয়ে যাওয়ার কথা ভুলে দেবদুতদের সাস্থ্য পানের উদ্দেশ্যে ভাটিখানার দিকে পা বাড়ায়।
১ নং টার্গেট বেমাক্কা অলৌকিক ডাক ও সাদা মাইক্রোর থেমে যাওয়া এই দুয়ের মধ্যে একটা সংযোগ স্থাপন করে কেঁদে ওঠে এবং বলে;
"ভাই, আল্লাহর দোহায় লাগে আমাগো ছাইড়া দেন, আমাগো কাছে যা আছে তা নিয়া ছাইড়া দেন, আপনের পায়ে পড়ি।" পিছমোড়া বাঁধা হাতে সাইদুরদের পা ছোঁয়া যাবে না এই আক্ষেপে ১ নং এর ডুকরে ওঠা ফোঁপড়ানিতে পরিনত হলে কম বয়সি ৩ নং বলে;
"ভাই কি করছি আমরা? আমাগো কই নিতাছেন?" ওরা নিরুত্তর থাকে।
৫ জনের দু'জন উপাসনালয়ে যায়, চর্বি-শিকারি দেয়ালে বাংলা ছবির পোস্টার খোঁজে আর সাইদুর উপাসনালয়ের দেয়াল ঘেসে ছ্যাড়ছেড়িয়ে পেচ্ছাব করে। চার রাস্তার মোড়ে শীতার্তেরা পরনের কাপড় খুলে আগুন জ্বালাচ্ছে, তাই দেখে বামপন্থি একজন প্যান্টের জিপারে হাত দেয়, মেনোপজ আক্রান্ত একজন স্থুলকায়া গাড়ির জানালা খুলে ছুঁড়ে দেয় স্যানিটারি ন্যাপকিনের হ্যাল্যুসিনেশন এবং এদের সম্মিলিত প্রচেস্টায় আগুনের কুন্ড বড়ো হলে শহরের পতংগরা ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে। সাইদুররা ঐ আগুনের কুন্ডলি থেকে সিগারেট ধরিয়ে সাদা মইক্রোটাকে আবার কালো শহরের পাকস্থলির জটপাকানো ল্যাবিরিন্থে ছেড়ে দেয়।
ভোক্তা নিয়ন্ত্রিত বোকা বাক্সে মাইগ্রেটেড ডেইলি সোপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে এক উঠতি অভিনেত্রী প্রকাশ্যে "গুপ্তহত্যা" বিষয়ে বিষদগার করে এবং তার প্রত্যক্ষনে বিগত ব্রোথেলের দিনলিপি হানা দেয়। যদিও টকশো'র প্রযোজক এটাকে আমলে নেন না এবং তিনি প্রধান দুই বিরোধী পক্ষের সুবক্তা দুই জনের সাথে নপুংশক একজন বুদ্ধিজীবির ত্রিসাম রতিক্রিয়ার লাইভ টেলিকাস্টের ব্যাবস্থা করেন। এ বিষয়ে শীর্ষ কর্পোরেটের লগ্নি নিয়ে দরকষাকষি হয় এবং চতুর প্রোযোজক যমুনা নদীতে ভেসে ওঠা ৩ টি পিছমোড়া লাশের খরচও লগ্নির অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে।
"হ্যালো দর্শক, আপনার নামটি বলে প্রশ্ন করুন।"
"অপারেশন ক্লিন হার্ট, ক্রশফায়ার, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনে মৃত্য আর এর পর গুপ্তহত্যা!! আপনারা কি জানেন বাইরে আমাদের ভাবমুর্তি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? আমার মেয়ে ইউকে তে ব্যরিস্টার এ্যাট ল পড়ছে, বেচারী লজ্জায় ওখানকার কম্যিউনিটিতে মুখ দেখাতে পারছে না........."
"যান্ত্রিক গোলযোগে লাইনটি কেটে গেল, আমরা যাচ্ছি আপনার কাছে দর্শকের প্রশ্নটি নিয়ে।"
"গুপ্তহত্যা কার আমলে শুরু হয়েছিল? কারা আমাদের নেতা কর্মিদের দমনের জন্য এলিট ফোর্স গঠন করেছিল? জাতি এই সব প্রশ্নের উত্তর জানে। আমি আপনার এই অনুস্ঠানের মাধ্যমে জাতিকে জানাতে চাই ....."
দর্শককে এটা জানার জন্য মিনিট বিশেক অপেক্ষা করতে হয় কারন হুড়মুড়িয়ে মোবাইল কোম্পানি-তেল-সাবান-বোটানিক এ্যারোমা-কন্ডম-ফ্ল্যাট-প্লট সব কিছু পর্দায় ঝাপিয়ে পড়ে এবং দর্শক আটকানো দম ছাড়ার ফুরসত পায়।
লাশের পকেট হাতড়ে পরিচয় অংকিত কোন আলামত না পেয়ে পচে ফুলে ওঠা মাংশে নাক ডুবিয়ে দেয় প্রায়ান্ধ দুই বৃদ্ধা। পচা মাংশ ঠেলে শৈশবের দুধগন্ধ তাদের নাকে হামা দিয়ে মগজে পৌঁছালে তারা সুর করে বিলাপ করে। আর কম বয়েসি সুন্দরী মেয়েটার অচেতন শরীর ও ফুলে ওঠা লাশের কম্বিনেশন ক্যামেরার ফোকাসে নিয়ে আসার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।
সাদা মাইক্রোটা নদীর কাঁধে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। নদীর তলানি নিংড়ানো আদ্রতা সাইদুরের শীতনিদ্রায় প্রলেপ দিলে ওর চোখে অনাগত বসন্তের ফোরপ্লে হাত-পা নিয়ে ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে উঠলেও ৩ নং টার্গেটের হঠাৎ অনুরোধ প্রি-ম্যাচিউর ইজ্যাকুলেশন এর কারন হয়।
"ভাই মানিব্যাগে আমার বউ এর ফটু আছে একটা। ম্যানি ব্যাগটা পকেটে রাইখা দিয়েন, দোহাই লাগে আপনের, লাশটা য্যান চিনবার পারে....."