"ভাই, এইটা কোন জায়গা?"
লোকটা প্রথমে নিরুত্তর থাকে কারন তার চোখের শুন্যতা ততক্ষনে সম্প্রসারনের শেষ প্রান্তে এসে থিতু হয়ে গেছে এবং খানিক পরে সে বলে;
"বুঝতেছি না। আপনি জানেন?"
উত্তরে সে কাঁধ ঝাঁকায়, ঠোঁট ওল্টায় ও ভ্রু কোঁচকায় এবং এর সম্মিলনে যে শারীরিক ভাষার উৎপন্ন হয় এতে সন্তুস্ট না হয়ে সে বলে;
"ভাই আপনার কাছে আগুন হবে?"
লোকটা আগুন বিষয়ে উৎসাহি হয় না, বরং পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে ভাঁজ খোলে, একে একে সব কাগজ বের করে তাকে দেখায় এবং বলে;
"আমি কিছুই পড়তে পারছি না, অক্ষরগুলোও চিনতে পারছি না।"
ধুসরাক্রান্ত রাস্তায় গাড়িগুলো থেমে যাচ্ছে একে একে, শেষ গাড়িটার ব্রেকের কর্কশ শব্দটা জীবিত থাকে অনেকক্ষন তারপর সর্পিল বাতাসের নদীতে ভেসে চলে যায় অস্পস্টতায়। মানুষগুলো বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে, আড়মোড়া ভাংগে, কেউ হাই তোলে এবং উদ্দেশহীন ছড়িয়ে যায় এখানে সেখানে। অনেকগুলো বাচ্চা;একটা ছেলে দুটো মেয়ে, আরো একটা ছেলে তারা লুকোচুরি খেলছে গাড়িগুলোর আড়ালে আর মানুষগুলো পকেট থেকে কাগজ বা টাকা, ওয়ালেট, মোবাইল সব কিছু বের করে ফেলে দিচ্ছে। সব শব্দেরা হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে গাঢ় ধুসরের চোঁয়ালে। সবার চোখে লতিয়ে ওঠা শুন্যতা পরস্পরের হাত ধরাধরি করে ছড়িয়ে পড়ছে কোথায়, তার হদিশ পেতে কেউ আগ্রহী হয় না।
সে আগুনহীন সিগারেট ঠোঁটে চেপে সদ্য অক্ষরভোলা মানুষটিকে নিয়ে আর সবার সাথে যোগ দেয়। রাস্তার দু'পাশের দালানগুলো মোমের মতো মসৃন মনে হয় এবং সেই মসৃনতার ভেতর থেকে শুন্যচোখের আরো মানুষ বেরিয়ে আসে। কেউ একজন বলে;
"কোথায় যেন যাবো বলে বেরিয়েছিলাম, মনে করতে পারছি না, মনে হচ্ছে খুব তাড়া ছিল আমার! এখন একটুও তাড়া নেই, এই যে ধিরে ধিরে হাঁটতে পারছি আপনাদের সাথে!"
আর সবাই একমত হয় লোকটার সাথে এবং স্মৃতিহীনতায়-আক্রান্ত পরবর্তি বিষাদ উপভোগ্য হয়ে ওঠে সবার কাছে। বিলবোর্ড, দেয়াল, আকাশের কাছাকাছি দালানগুলোর নিরাভরন পেট, শপিংমলের প্রস্বস্ত কপাল এমনকি পাবলিক বাসের পোড়খাওয়া পাঁজরে লেখা সব কিছু ঝরে-গলে-ধুয়ে মিশে যাচ্ছে ধুসরে।
"আহ! আমার কোন নাম নাই! কেউ আমাকে ডাকছে না, ডাকবেও না!"
কেউ একজন এই কথা বললে, আরেকজন বলে ওঠে,
"আমাকে কোথাও যেতে হবে না! কোথাও না!"
লুকোচুরি খেলা বাচ্চাগুলো রাস্তার পাশের দোকান লুট করে ক্যান্ডি উড়াচ্ছে আকাশে। আধচোষা নগ্ন ক্যান্ডির মাধুর্য্য ভারি বাতাসে ভেসে থাকতে না পেরে ছুটে আসছে নিচে আর লোকগুলো তাদের জিভে প্রথমবারের মতো মিস্টতা জমতে দেখে রোমাঞ্চিত হয়, ক্যান্ডি খাওয়া শিখে তারা হেসে ওঠে। অক্ষরভোলা লোকটা কসরত করে মাড়ি আর মুখের চাতালে লেপটে থাকা ক্যান্ডি হাপিশ করার ফাঁকে বলে;
"আচ্ছা বলেন তো, এই বাচ্চাগুলোর মধ্যে কেউ যদি আমাকে বাবা বলে ডাকে তবে আমার কী করা উচিৎ? আমার কোন বাচ্চা ছিল বলে তো মনে পড়ে না....."
শিশু বিষয়ে সে কোন জবাব দেয় না বরং নির্মোহ রাস্তাটা কিভাবে প্রবাহিত করছে নির্লিপ্ত মানুষগুলোকে গন্তব্যহীন ধুসরে, সে এটা ভাবে। তার ভালো লাগে আগুনহীন সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে এই শুন্য চোখের মানুষগুলোর সাথে হাঁটতে। একটা পাখা গজানো খবরের কাগজ এইমাত্র ল্যান্ড করলো রাস্তায় থমকে যাওয়া গাড়ির ছাদে, একটা মেয়ে ঠোঁটে চকচকে লাল নিয়ে হাসছে সেখানে।
বাচ্চাগুলো এবার গান গাইছে। অস্ফুট ফুলের সুগন্ধি হৃৎপিন্ড, দুরাগত ঘন্টির রিনরিনে শেষ কম্পন আর প্রথম বৃস্টির আধখানা ফোঁটার মতো গান গ্রাস করলো সবাইকে। সবার শুন্য চোখের করিডরে মৃদু আলো জ্বেলে হেঁটে গেল গান, সবার কন্ঠ ছিঁড়ে উড়ে গেল অগুনিত দোয়েল গাঢ় এবং প্রার্থিত ধুসরের দিকে। ঠোঁটে আগুনহীন সিগারেট নিয়ে সে চাইলো আর সবার মতোই- এই গন্তব্যহীনতা অনন্তে বাঁধা পড়ুক। নিজের হানাদার নাম মনে পড়ে যাবার আগেই ঐ গাঢ় ধুসরে লীন হতে আরো দ্রুত পা চালায় সে!