ক'দিন আগে যেতে হয়েছিল রংপুর। ছিমছাম শহরটার নাগাল পেতে তখনো আধা ঘন্টার মতো বাকি। রাস্তার দু'ধারে এলায়িত সবুজ, আশ্চর্য আলস্যে চোখ মুঁদে আছে। একটা টং চা-শালা দেখে থামি, ইচ্ছে হাত-পায়ের খিল ছাড়াতে ছাড়াতে চুমুক দেব চায়ে। চা-শালার মহাজন পিচ্চিটা মহা চালু, ঝটপট চা বানিয়ে আমার হাতে তুলে দিয়ে হাসে, দেখি ওর সামনের পাটির একটা দাঁত নেই, ফোকলা। কাপে চুমুক দিতে দিতে চারপাশটা দেখি। আমার আশ-পাশে চা প্রত্যাশি জটলার দিকে তাকাতেই দেখি ঘন জোড়া ভ্রুর নিচে দুটো ঝকঝকে চোখে উপচানো হাসি, দু'হাতের মুঠোর কসরতে সিগারেট জ্বলে উঠবে বলে চেহারার পুরোটা দেখতে পারছি না। কিন্তু ঝকেঝকে চোখ উপচানো হাসিই বলে দেয়, একে আমি চিনি। একগাল ধোঁয়া উড়িয়ে সে আসে, বলে, "কি বে শালা, এইটা তুই? কত্তোদিন পরে দেখা!" এবার দেখি কোঁকড়া চুল কামড়ানো মাথা, গালের টোলে জমে থাকা হাসি....আর থুতনির ঢাল ঘেঁসে একটা কাটা দাগ, এগুলোর সমস্টি আমাকে হুট করে নিয়ে যায় অ-নে-ক আগের, প্রায় ভুলতে বসা স্কুলের হাফ প্যান্ট পরা দিনগুলোতে!
"তুই তো শালা এখনো কানায় থেকে গেছিস!" অনেক ছোট থেকে আমার নাকের উপর বসত গেড়ে বসা চশমা ভোল পালটিয়ে বুড়ো হয়েছে আরো। আমার মনে পড়ে যায় ঐ চশমার জন্যই স্কুলে আমার নাম হয়েছিল কানা! আমি হাসি, বলি, " তুই কি ব্যাটা আগের মতো বান্দরই আছিস?"
পুরো স্কুল খুঁজলেও ওর মতো ডানপিটে ছেলে পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ! মাস্টাররা বলতেন ল্যাজ কাটা বান্দর!
এ্যাতো দিন পর দুজনের দেখা, কৈশরের সেই সব মায়াবী বিভ্রান্তির রং দুজনের চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়লে রাস্তার দুধারের এলায়িত সবুজ আন্দোলিত হয়; আমরা দুচোখ ভরে দেখি। একে একে সব জ্যান্ত হয়ে ওঠে; লাস্ট বেন্চে খোদায় করা ছবি-ছড়া, কারো পকেটে লুকানো ছুরি, কারো ন্যাড়া মাথায় থুতু দিয়ে চাটি মারা, স্কুল পালিয়ে উপহারে দুপুরের শোয়ে ছবি দেখা, তিন গোয়েন্দা নিয়ে কাড়াকাড়ি, আট আনার আমড়া......সব কিছু আমাদের আরেক বার আচ্ছন্ন করে। শুধু আমি, কুন্ঠার সাথে দেখি, ওর নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না! কতো জনকে নিয়ে কথা হয়, হাবলা কাওসার, মাথামোটা মতিন, ট্যারা মাসুদ, তিন বোনের এক ভাই মানিক..সব...সবার নাম মনে পড়ে, আমরা দুজনা এগুলো নিয়ে জাবর কাটি, শুধু ওর নামটাই মনে পড়ছে না!
ও বলে, " কিরে তোকে যা সাইকেল চালানো শিখিয়েছিলাম, লাস্ট কবে সাইকেলে চেপেছিস?" ওর বড় ভাইয়ের সাইকেলে হাফ প্যাডেলে প্রথম হাতে খড়ি আমার। মেডিক্যাল কলেজের বিস্তৃত মাঠে আমাদের চাইতে উঁচু বেয়াড়া সাইকেলটাকে আমার দু'পায়ের মাঝে বশ মানিয়েছিল ও। আমি ডান দিকে কাত হয়ে পড়ে যেতে চাইতাম, ও ধমক-ধামক দিয়ে ধরে রাখতো। তারপর যেদিন আমি ওর সাহায্য ছাড়াই মেডিক্যাল কলেজ মাঠের বুক চিরে ছুটে গেলাম, বেয়াড়া সাইকেলটাও আমার কথায় দৌড়ালো, থামল; সেদিন কি খুশিই না হয়েছিল ও। এরপর নয় ক্লাশের সিঁড়িতে পা রাখতে না রাখতেই বাক্স-পেটরা বেঁধে ওর বাবার সরকারী চাকুরীর পিছু পিছু ও চলে গেল।
স্কুল পালিয়ে পদ্মায় সাঁতরানো, চরের বালিতে কুস্তি আর শিশুবনে দরগাপাড়ার বখাটে ছেলেদের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় বুঁদ হতে হতে আমি ওকে বলি হঠাৎ, "তোর নামটা আমার মনে নাই, ভুলে গেছি!"
ওর জোড়া ভ্রুর নিচে চকচকে চোখে হাসির ঢল নামে, ও আনমনে থুতনির ঢালে কাটা দাগটায় আংগুল ছোঁয়ায়। অনেক আগে, ক্রিকেট খেলায় আগে ব্যাট ধরার ঝগড়াতে আমার ব্যাট ওর থুতনির ঢালে যে ক্ষতের জন্ম দিয়েছিল, সেটা অভিযোগ নিয়ে তাকিয়ে থাকে যেন আমার দিকে।
"ভুলতেই পারিস, কতো দিন আগের কথা।" ও বলে। আবার হাসে কিন্তু নামটা বলে না।
"দেখি ব্যাটা, তুই মনে করতে পারিস কিনা!"
আমাকে এমন বিপন্নতার মাঝে ফেলে ও চলে যায়, শুধু ওর থুতনির ঢালে কাটা দাগটা জ্বলতে থাকে!