"শাআ-লা! এতক্ষন কই ছিল এরা!"টুপটাপ কয়েকটা লাফে রাস্তাটা পেরুতে গেলে বেনো জলের তোড়ের মতো সিআনজি-বাস-লেগুনা-প্রাইভেট সব পোয়াতি মেঘের ধাওয়া খেয়ে আনিসকে আটকে ফেলে মাঝ রাস্তায়। শুকনো জিভ আর টাকরার ফাঁকে "শালা" গালিটা পুর্নতা পাওয়ার আগেই নিজেকে ডিভাইডারের উপরে টেনে তোলে আনিস, সিটি কর্পোরেশনের পোষা গাছ মাড়িয়ে ওপারের রাস্তাটা পেরুতে গেলে ভাটির টানে ভেসে যাওয়া ১টা সিএনজি আর ১টা প্রাইভেটের বেমাক্কা খিস্তির মাঝে পড়ে যায় আনিস, এর মধ্যে বৃস্টির বড়ো সড়ো একটা ফোঁটা তাতানো রাস্তাটাকে গেঁথে ফ্যালে। আনিস যখন নিজেকে প্রায় ঠিকঠাক মতো শাহিন কলেজের মার্কেটের চিলতে বারান্দায় নিয়ে আসে,ওর খানিক আগে বা পরে কিছু বৃস্টিবিদ্ধ মানুষ বন্ধ দোকানের সাটারে পিঠ ঠেকিয়ে ঠিক বোঝা যায়না এমন দৃস্টিতে বৃস্টি দেখে। রাস্তায় ওতপেতে থাকা ধুলো বৃস্টির প্রথম ছটপটানিতে থেঁতলে যায়, তারপর বেদম ঝাঁপিয়ে পড়লে শাহিন মার্কেটের চিলতে বারান্দায় দাঁড়ানো মানুষগুলোর চোখে ঘোর লাগে। আনিস এই ঘোর লাগা চোখগুলোর দখল নিয়ে সাটারে পিঠ ঠেকিয়ে রাস্তা পেটানো বৃস্টিতে ঠেলে দেয় নিজেকে। ২০ কি ২২ বছর নাকি বৃস্টির কুয়াশাময় চাদর সেটাকে আরো দুরবর্তি করে পঁচিশে ফেলে দেয়, আনিস ঠিক ঠাহর করতে পারেনা, শুধু দেখে পলেস্তারা খসা ইটের ছোট-ছোট দাঁত বের করা দেওয়ালের পটভুমিতে কালচে কাঠের বড়ো দরযা। কালচে? নাকি মরচে রংগা বুড়ো কাঠ রোদ আর বৃস্টির পেরেশানিতে রং বদলে ফেলেছে ঠিক বোঝা না গেলেও পাড়ার কোন ইঁচড়েপাকার বকুল + মিতুর খোদায় করা আলেখ্য ঠিকঠাক ধরা দেয়। দরজার ওপাশে উঠোনটা বৃস্টির ছানাপোনাদের দখলে টুপটাপ ফুটেই যাচ্ছে, আর দ্যাখো ৩টা, ৪টা নাকি ৫টা বাচ্চা ঠিক বোঝা যায়না তার মধ্যে আনিসও কি ছিলো নাকি ২০কি ২২কি ২৫ বছর পরের শাহিন মার্কেটের সামনে বৃস্টির ছাঁট ওকে ছিটকে ফেলেছিল ফুটন্ত উঠোনে। আনিস নাচুনে পাতাবাহারের ভেজা যুবতি পাতা ছলকে, বুড়ো মোরগ ঝুঁটির ডাঁটা টপকে উঁচু বারান্দাটার নাগাল পেতে চাই। ৫ ফুট ৭ কি সাড়ে সাতের আনিস বুড়ো আংগুলের কারসাজিতে আরো আধা ইন্চিখানেক বাগিয়ে নিলেও থই পায়না বারান্দার।
"অ বৌমা, পিচ্চি গুলার কান্ড দেখ!" ওর দাদার মেহেদি রাংগা দাড়ি গোঁফের ঠাস বুনোটে বলক উঠলে তা ছড়িয়ে যায় উঠোন ভর্তি বৃস্টির হুটোপুটিতে, আনিস মরিয়া হয়ে বারান্দার থই পেতে চেস্টা করে। কিন্ত বেয়াড়া বারান্দা পিঠে জলচৌকি আর তার পিঠে মেহেদি রাংগা দাড়ি গোঁফের ঠাস বুনোট নিয়ে আরো উঁচুতে উঠে যায়। শুধু দড়িতে ঝুলতে থাকা গামছা আনিসকে ভেংচি কেটে একটা লুংগি কি শাড়ির ফাঁকে লুকোচুরি খেলতে থাকে।
"ভাই, আগুন হবে?" ঠোঁটে সিগ্রেট, আগুন প্রত্যাশি লোকটার ভ্রু দুটো নিজেদের মুচড়ে আনিসকে ২০কি ২২কি ২৫ বছরের পুরোন বৃস্টি থেকে উপড়ে শাহিন মার্কেটের চিলতে বারান্দায় আছড়ে ফেলে। আনিস ঘোরের মধ্যে পকেটে হাত দিলে ওর মনে পড়ে যায় সিগ্রেট টা ওর পোড়ানো হয়নি কখনো। আনিস মাথা নাড়লে ঠোটে সিগ্রেট ঝোলান লোকটার ভ্রু দুটো বিযুক্ত হয়ে কপালে খরখরে ক'টা রেখার আকার নিয়ে ঝুলে থাকে, ঠোঁট দুটো অপেক্ষমান সিগ্রেটের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়লে সিগ্রেটটা দু'আংগুলের ফাঁকে সেধিয়ে পড়ে। এই ফাঁকে ভার মুক্ত ঠোঁটের মাঝ দিয়ে,"ধুর! বালের বৃস্টি!" ছিটকে যায় বৃস্টির চাদরে আবার বাড়ি খেয়ে ফিরে আসে শাহিন মার্কেটের বারান্দায়।
"আর বইলেননা ভাই, হালায় একটু পিচকারির মুতন বৃস্টি অইলো কি পুরা শহর ভাইংগা পড়ব, কুনো কিসু পাওয়া যাইবো না" সায় দেয় একজন, বৃস্টির তোড়ে উথলে ওঠা খোস পাচড়া খসখস চুলকিয়ে ফের ঢুকে যায় ঝুলে থাকা ছায়ার ভাজে। আনিস ডানে বাঁয়ে হাঁতড়ে সারিবদ্ধ ছায়া গুলোকে ঠাহর করার চেস্টা করে, আচমকা বৃস্টিতে শাহিন মার্কেটের বারান্দায় ঝুলে পড়লেও স্যাতসেতে বাতাসে কাঁপছে ছায়াগুলো আর আটকে পড়া মানুষগুলো আংগুল মটকে-গলা খাখারী দিয়ে-পাচড়া চুলকে হালকা করার চেস্টা করে খানিক কিন্ত ভেজা সোডিয়ামের কারসাজিতে আরো গাড় হয়ে জেঁকে বসে বারন্দায়। আনিস নিজেকে গুছিয়ে ফের ২০কি ২২কি ২৫ বছর আগের বৃস্টিতে ভেজার প্রস্ততি নেয়, উঁচু বারান্দায় সওয়ার মেহেদি রাংগা দাড়ি গোঁফের ঠাস বুনোটের নাগাল পেতে নিজেকে মরিয়া করে তুলতে চায়। হঠাৎ আনিসের মগজের কোন এক কোনে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু টক স্মৃতি গলি-ঘুপচি পেরিয়ে ঠিক পৌছে যায় মুখ অবধি,সেখানে প্রায় অর্ধেক একটা বাসি দিনের লালার সাথে মিশে থুতুর সংক্রমনে মনে পড়ে যায়, ওর শৈশব-কৈশর-প্রাক যৌবনের চৌহদ্দি এসওএস শিশু পল্লির লাল টালির নিচু ছাদ আর নাগাল পাওয়া যায়না এমন উঁচু দেয়ালের ঘেরাটোপ থেকে বেরুতে পারেনি কখনো। তো শালা মেহেদি রাংগা দাড়ি গোঁফের দাদা আসবে কোত্থেকে?
কিন্ত এমনি হচ্ছে আজকাল,গতো শুক্রবারে আনিস মোহাম্মদপুরে রন্জুদের মেসে তাস পেটানোর জন্য আর দুপুরে ব্রয়লারের এক-আধ টুকরা মাংশের টানে যেই না তাজমহল রোডের লেজে পা ফেলেছে,কোত্থেকে ঘন লাল সুরুয়ার মাঝে হাবুডুবু খাওয়া বড় চিংড়ির ধেয়ে আসা গন্ধ ওকে ছুঁড়ে ফেলে গতজন্মের এক হেঁসেলে। আনিস লবন-মরিচ-ধোনা-জিরার কৌটার ফাঁক-ফোঁকর হাতড়ে ছড়ানো পেঁয়াজ কুচি আর পেটচেরা পটলের লালচে-সবুজ বিচি মাড়িয়ে বলক ওঠা কড়াই, খুন্তি ছুঁয়ে দিব্বি ৫ফিট ৭ কি সাড়ে সাতের শরীর নিয়ে সেধিয়ে পড়ল অধরা ওমের কোলে,
"মা, আমাকে এক্ষুনি চিংড়ি দ্যাও একটা, খোসা ছাড়ায়ে দিবা"
"শয়তান,তোর দুপুরের ভাগ থেকে একটা কমে গেল, আর চাবিনা"
আনিস মরিয়া হয়ে মুখে খোসা ছাড়ানো সাদা চিংড়ির অস্বস্তি নিয়ে গতজন্মের হেঁসেলে অধরা ওমের মালিককে তালাশ করে কিন্ত তাজমহল রোডের ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়া রিকশার ঘন্টি আর ছিবড়ে মানষগুলো নিমিষে ঘন লাল সুরুয়ার মাঝে হাবুডুবু খাওয়া বড় চিংড়ি লোপাট করে ওকে বিপন্ন করে ফেলে চলে যায়। আনিস শুকনো জিভের চড়ায় লাল সুরুয়া আর খোসা ছাড়ানো চিংড়ির স্বাদ জিইয়ে রাখার খাতিরে রন্জুর মেসের মুরগির টুকরো-টাকরায় সাড়া দিতে পারে না এমনকি ওর ঘোর লাগা চোখের সাথে জুতসই আঁতাতে ব্যার্থ হয়ে টেক্কা কি সাহেব কি বিবিরা দিশেহারা বোধ করে।
"বালের বৃস্টি" আগুন প্রত্যাশি লোকটার আংগুলের ফাকে সিগ্রেট জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় নেতিয়ে পড়লে লোকটা ফের বৃস্টিকে গাল দেয়। আনিস তখন ঝিম ধরে থাকা বোকা ল্যাম্পোস্ট গুলোকে দেখছিল, ওরা অনুযোগহীন একটানা ভিজে যাচ্ছে; পরস্পরের হাত ধরে বাঁকা হয়ে ফ্লাইওভারের ওপর মাথাহেট করে আছে আর নোংরা হলদে আলো বৃস্টির ছাটে শাহিন মার্কেটের চিলতে বারান্দা অবধি পৌছাতে না পারার আক্ষেপে বোধহয় আরেকটু বেশি ভিজছে। খানিক বাদে হলদে আলোর ঘুর্নি পাতাহীন কদমের রুপ নিয়ে ল্যাম্পোস্টে ঝুলে পড়লে আনিস একটু ধাতস্ত হয়।
"চিন্তা করেন, হালায় দু'ফোট চিরিক বিরিসটি হইলো কি আমাগো মহল্লার তামাম ড্রেন-উন উপচায়া হাঁটুত গিয়া ঠেকব। আবার বাড়ি যায়া দেখব পানি নায়..."
আগুন প্রত্যাশির কালচে বেগুনি গালে বসন্তের ফাটল যুগপত ঘাম-বৃস্টির সংগমে পুর্ন হয়ে চুলকানির উদ্রেক হলে তিরতির কাঁপে, লোকটা না-ধরানো সিগ্রটের ধোঁয়ার আড়াল নিতে চোখ কোঁচকায়। আনিস লোকটার ছুড়ে দেওয়া আলাপচারিতার ছুতো এড়িয়ে গেলেও মহল্লার পাঁজর তুবড়ে ধেয়ে যাওয়া বৃস্টি আর ড্রেন উপচানো মানুষ কি কুকুরের গু,একটা মরা ইদুর, কনডোমের খোসা, প্রায় সচল দু'টাকার নোট ইত্যাদির গন্তব্যের হদিস এড়াতে পারে না, শুধু মাথাটা ঝাঁকায় । গাড়ি গুলো ল্যামপোস্টে ঝোলা কদম লুটে নিয়ে হুস-হাস করে পেরিয়ে যাচ্ছে, আনিস শুধু দেখে, দেখতে দেখতে জানালার শিকে গাল চেপে একটা ফড়িং এর পিছু নেয় আনিস আর বিছানার আলস্যে ভাঁজ খোলা পেপার, পেপারের আড়ালে চশমার আধবোঁজা চোখ;
"আনিসের মা,কাঁচা মরিচ দিয়া মুড়ি মাখায়া দ্যাও না!"
এই লোকটা যে কিনা আনিসের মাকে দুধ সাদা মুচমুচে মুড়ির পাহাড়ে কাঁচা লংকা বুনে দেওয়ার আবদার করছিল,সরষের তেল আর কুচানো পেঁয়াজও হয়তো উহ্য ছিল তাতে, এই লোকটা হিসেব মতে ওর বাবা না হয়ে পারে না! আনিস এই লোকটাকে দেখার জন্য ঘাড় ফেরাতে চাইলে ফড়িংটা দিব্যি ওর চোখ দুটো নিয়ে প্রাচিরের উপর বসে পড়ে। এরপর প্রাচিরের ফাটলে পিঁপড়ে কলোনীর ব্যাস্ততায় চোখ দুটো সেধিয়ে পড়লে, আনিসের আর বাবাকে দেখা হয়না। কিংবা পিঁপড়ে গুলো ওকে টেনে হিচড়ে এসওএস শিশুপল্লীর লাল টালির নিচু ছাদ আর নাগাল পাওয়া যায়না এমন উঁচু দেয়ালের ঘেরাটোপে এনে ফেললে এ যাত্রা বাবাকে দেখাটা বাদ দিতে হয় আনিসকে।
"ঢাকা শহরে আবার বৃস্টি?" আগুন প্রত্যাশি লোকটা বলে,"বুঝলেন ভাই, বিরিসটি দেখসি আমাগো গাঁয়ে। নৌকায় কইরা যাইতেসিলাম মামার বাড়ি, বিমার আসিল আমার মামা। মাঝ নদী পাইসি কি পাইনি, ফকফকা জোসনার মইধ্যে দেহি বিরিসটি শুরু হয়া গেল! কি তামশা! উথাল-পাথাল ঢেউগুলা মনে হইতাসিল বিরিসটির ঠাপে দাড়াইবার পারতাসেনা, চিন্তা করেন এইরম বিরিসটিতে তিন-চাইর ঘন্টা আটকায়া সিলাম!"
আগুন প্রত্যাশির ভাংগাচোরা কন্ঠের চড়াই-উৎরায় বেয়ে জোস্না গলা বৃস্টি আচ্ছন্ন করতে চাইলে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘোর কাটানোর চেস্টা করে আনিস। আগুন প্রত্যাশির সাথে অলৌকীক নৌকা ভ্রমনে পাছে ওর মা-বাবা-মেহেদি রাংগা দাড়ি গোঁফের ঠাস বুনোটের বুড়ো ফাঁকি দিয়ে অদেখা নদীর উজানে ভেসে যায়, এই ভয়ে আনিস নিজেকে শাহিন মার্কেটের চিলতে বারান্দা থেকে ঠেলে দেয় বৃস্টি বন্দি রাস্তায়। ফ্লাইওভার চিরে ছুটে যাওয়া পাতাহীন কদম আর ক্রমশ পাতলা হয়ে আসা করোটির ছাদে বৃস্টির মাতম যদি মা-বাবা-মেহেদি রাংগা দাড়ি গোঁফের ঠাস বুনোটের বুড়োর কোন হদিস দেয় এই আশায় বৃস্টির সাথে নিজেকে ছড়িয়ে দেয় আনিস।