অনেক অনেক দিন পর কেন জানিনা, আমার ল্যাজ ঝোলা ফিংগে কৈশর আর নাড়ি-পোতা ভিটে শেকড় ওপড়ানো ডাক দেয়। কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি, কাউকে কিচ্ছুটি না বলে। পথে একটা ইলশে নদী, গলুইয়ে পিঠ, জলজ ঢাকের ছন্দ..আহ!! তারপর সর্ষে সোনা মাঠ পেরুতেই দাদু বাড়ি। আশি বছরের ঝড়-ঝাপটায় নোয়ানো আমার বাবার বাবা, বলিরেখায় কয়েক দশকের কালস্রোত। আমি যখন বললাম, বুড়ো..তোমার সুপারী কাটা জাঁতি টা দেবে? বুড়ো হাসে। পেয়ে গেলাম আমার প্রথম রত্ন। আমার বিধবা ফুপি, সেই যে লোকটা পোড়া দেশটার জন্যে কেমন হন্যে হয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে; আমার ফুপিটা পুড়ল ৩৬ টা বছর। একটা টিপদানী ছিল ফুপির- মমতার আগুনে পোড়ানো, কড়ে আংগুলের নির্ভরতায় আঁকা জাদুর টিপ পরানো হতো সবাইকে যেন বালাইসাট মাথাকুটে মরে আমাদের ছুতে না পারার আক্ষেপে। টিপদানীটা যখন চাইলাম, ফুপি হাসে, বলে..পাগল তুই চাইলে একটা চোখ দিয়ে দেব..আর একটা পচা টিপদানী দেবনা? পেয়ে যায় আমার দ্বীতিয় রত্ন, বাজি ধরতে পারি রাজা সলোমন এর ভান্ডারেও ছিলনা এমন দামি কিছু। বড় চাচা, একটা বট বৃক্ষ, যে আমাকে টম সয়্যর আর হাকফিনের সাথে একই নৌকোয় ভাসিয়েছিল মিসিসিপীর দামাল ঢেউয়ে। চাচ্চু, তোমার দেওয়া "ফুলের গন্ধে ঘুম আসেনা"র চাইতে বড় রত্ন কি হ্য়? ছোট চাচা, আমাকে চিনিয়েছিল কোন গর্তে থাকে শেয়াল ছানা, শিখিয়েছিল বনবিড়ালকে বোকা বানানোর ফাঁদ আর গুলতি দিয়ে পাখি শিকারের হাতেখড়ি। আমার পকেটে সেই অমুল্য গুলতি, স্প্যানিস ডাবলুনের চাইতেও মোহময়। স্মৃতিকাতর মেঠোপথ দিয়ে যখন ফিরে আসছিলাম, আমি জানি আমার মতো তোমরাও ছায়াচ্ছন্ন হয়েছিলে।
আমাদের বাড়িতে কাজ করতো মতি খালা, তার ছেলে ফজলু, আমার ছোট বেলার হিরো। ফজলুটা টোকা মেরে বলে দিত কবে পাকবে তরমুজ, অলৌকিক লাট্টুবাজ আর মারবেল খেলায় এ গ্রহে ওর মতো আর কেউ জন্মাবেনা। ওর সেই শিকারী লাট্টুটা; ক্ষ্যাপা, দুর্বিনীত, আর অপরাজেয়....আছে আমার সংগ্রহে। কী, হিংসে হচ্ছে আমাকে? হু হু আরো আছে....
আমার বাবার পার্কার কলম আর চামড়ার মলাটে বাধানো ডায়েরী। ঋদ্ধ কলমটা কি নিপুন আঁকিয়ে; ডায়েরী হলদেটে পাতায় অঘ্রাত কিশোরীর মতো মফস্বল, তার বিবর্তন, সময়ের চোরা স্রোত, মধ্যবিক্তের চিরায়ত বোধ....কি অবলিলায় এঁকে গেছে বর্নমালার ছোপে!
সেই বালকবেলায় কতো রত্ন জমেছিল বুকে, ট্রেনের চাকার নিচে চ্যাপটা আধুলি, বাবুই বাসা, কুমড়ো লতার সিগ্রেট, ম্যাচের খোলে ডাই পিপড়ে; কতো কী!
(চলবে....)