ঘুম থেকে উঠে দীর্ঘক্ষণ ধরে গোসল করল সানজানা। দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছিল। এখন বেশ ফ্রেশ লাগছে।
আজ তার ডিপার্টমেন্টের গেট-টুগেদার প্রোগ্রাম। ড্রেস হিসেবে আকাশি কালারের শাড়িটা চুজ করে রেখেছিল সে। কিন্তু এখন কেন যেন শাড়ি পড়তে ভাল লাগছে না। সালোয়ার-কামিজ পড়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়াল। শরীরটা মুটিয়ে যাচ্ছে ইদানিং। সেই সাথে মুখে বলিরেখার ছাপ স্পষ্ট। রাত জাগা, দুশ্চিন্তা, নিঃসঙ্গতা সবগুলোর সমন্বিত ফল। তা না হলে কতই বা বয়স হয়েছে তার! ৩০, সার্টিফিকেট অনুযায়ী ২৮।
মেয়েকে এক পলক দেখে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন মা, শায়লা বেগম। এইচ,এস,সি পাশ করার সাথে সাথে পরিবারের সকলের মত অনুযায়ী বিয়ে করতে বাধ্য হন ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলামকে। নিজের অপূর্ণ ইচ্ছে গুলো মেয়ের মাধ্যমে পূরণের চেষ্টায় মোটামোটি সফলই বলা যায় তাকে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ, এম,বি,এ করে একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করছে সানজানা। গান, কবিতা আবৃতি, উপস্থিত বক্তৃতা সব ক্ষেত্রেই তাঁর মেয়ের অগাধ বিচরণ।
কিন্তু দিন দিন কেন যেন দূরত্ব বাড়ছে। মা ন্যাওটা মেয়েটা হঠাৎ করে বড় হয়ে গেছে। তাকে নিজের মত করে বেড়ে উঠার যে সুযোগ তিনি দিয়েছেন তার প্রপার ইউজ মেয়ে করতে পারে নি। আধুনিকতার উচ্ছলতায় ভেসে গিয়েছে। হিমেলের সাথে অ্যাফেয়ার মেনে নিয়েছিলেন অবশেষে, কিন্তু সেই ছেলে তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। স্কলারশিপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গিয়েছে হিমেল।
হিমেলের সাথে উথাল পাথাল সম্পর্ক ক্যাম্পাসে ততদিনে কারও অজানা নেই। প্লেটোনিক প্রেম এর সীমারেখা অতিক্রম করে তা অনেক গভীরে চলে গিয়েছে। হিমেল ভাবল মাত্র কিছুদিন হল চেনে আমাকে, এতেই এত কিছু? এই মেয়ে তো চরিত্রহীন । সতীত্ব এর কাছে তেমন কোন ইস্যুই নয়। এই মেয়েকে বিয়ে করলে সর্বনাশ।
প্রেম করার জন্য ছেলেরা খোঁজে ‘লাস্যময়ী নারী’, কিন্তু বিয়ের জন্য ‘সতী-সাধ্বী’।
হিমেল কিছুই বুঝতে দিল না সানজানাকে। ধীরে ধীরে মিশল তার সঙ্গে, অবগাহন করল। তারপর ব্যবহৃত সিগারেটের ফিল্টারের মত ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সন্তর্পণে উড়াল দিল।
হিমেল থাকা অবস্থায় আবেগে ভাসছিল সানজানা। বাস্তব নিয়ে সে মোটেই চিন্তিত ছিল না। কিন্তু এখন চোখের পাতায় ভেসে উঠে নির্মম বাস্তবতা, যেটা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে অবিরত। চেনা মানুষগুলো একটু একটু করে অচেনা হতে শুরু করেছে। সবচেয়ে আপন মা-ই ইদানিং কেমন যেন চিরশত্রুর মত আচরণ করছে। কি করবে সে? আহত বোধ নিয়ে অভিমানের চাদরে জড়িয়ে নিজেকে ছুঁড়ে দিবে কয়েকটি ঘুম জাগানিয়া ওষুধের মাঝে?
সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগল। রুমের ভেতর একমনে পায়চারি করতে লাগল। নাহ, এসব সে কেন করবে? কি নেই তার? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বেশ কয়েকবার দেখল। আজও সে সুন্দরী, তন্বী । যে কোন পুরুষের চোখে অনন্যা। তাহলে কেন সে ভগ্নাংশ হয়ে জীবন অঙ্কের খাতায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে?
নিজের সাহসিকতায় নিজেই চমকে উঠে। এই ত্রিশ বছরের জীবনে এত সাহস সে কোথায় পেল? বাস্তবতাই তাকে সাহসী করেছে। মনে শত শত প্রশ্ন বাসা বাঁধে তার। হাসিখুশি মেয়েটার গতিপথ এলোমেলো করে দিল কে? প্রেমের উন্মত্ততা? জীবনটাকে উপভোগের নেশা? নাকি নিয়মের বেড়াজালকে দুহাত দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা?
নির্ধারিত সময়ের কিছুটা পড়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে সে। সিনিয়র জুনিয়র মিলে প্রায় শখানেক লোকের উপস্থিতি। উদ্দেশ্য একাকীত্বের যন্ত্রণা লাঘব। সেই সাথে সময়ের চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের সাথে পুনর্মিলন।
সানজানা জানে সামনে যতই সুন্দর সুন্দর কথা বলুক, পিছনে অনেকেই সমালোচনা করে তাকে নিয়ে। কিন্তু কি করবে সে? এখন সে অনেক সাবধানী। সব কিছুতেই ভয় হয় তার। ভয়টা এখন যেন মজ্জাগত, যেমন ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। হিমেলের পরে অনেক পুরুষই আসতে চেয়েছে তার জীবনে। কিন্তু তাদের চোখের লোলুপ দৃষ্টি দেখে পিছিয়ে এসেছে সে। এখন তার দরকার দৃঢ় অবলম্বন, আবেগে ভাসার মত বয়স কিংবা সময় কোনটিই তার নেই।
তার ব্যাচমেট মায়া এসেছে হাজবেন্ডকে সাথে নিয়ে। সেই সাথে ফুটফুটে একটি শিশু। শিশুটিকে নিয়ে অনেকেই ব্যস্ত। সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে মায়ার বিয়ে হয়ে যায়। স্টাডি কন্টিনিউ করতে পারবে না বলে মায়ার সে কি কান্না। এই সব লোয়ার ক্লাস ম্যাটার(ফেচফেচানি) সানজানা সহ্য করতে পারে না। তাই সে অ্যাভয়েড করেছিল। এসব কি মনে রেখেছে মায়া? মায়ার চোখেমুখে শান্তির স্নিগ্ধ একটা ছাপ। মুখ জুড়ে প্রসন্ন হাসি, যে হাসি লেগে থাকে শুধুমাত্র একজন ছেলে সন্তানের মায়ের মুখে। অথচ সানজানার দুচোখের কোলে কেমন যেন একটা শূন্যতার আকাশ। মায়াকে দেখে এখন কেন যেন কিছুই ভাল লাগছে না তার। কেবলই মনে হচ্ছে জীবন যুদ্ধে সে এক পরাজিত পলাতক সৈনিক। মায়া নামক লোয়ার মিডল ক্লাস মেয়েটি তাকে হারিয়ে দিয়েছে।
শরীর খারাপের এক্সকিউজ দেখিয়ে গাড়িতে উঠল। শরীর খারাপের কথা সহজেই প্রকাশ করা যায়। কিন্তু মন খারাপটা মনেরই অতল গহ্বরে চাপা পড়ে থাকে। ঘুনপোকার মত কুঁড়ে কুঁড়ে খায় হৃদয়।
কিছুদূর এসে জানালার কাঁচ নামিয়ে দিল। ড্রাইভারকে লো ভলিউমে রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে দিতে বলল।
চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।
অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে।।
ধরায় যখন দাও না ধরা
হৃদয় তখন তোমায় ভরা,
এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহি রে।।
জানালার কাঁচ বেয়ে নেমে আসছে বৃষ্টি। অসময়ের বৃষ্টিতে কেমন যেন মন খারাপের স্পর্শ আছে। দু এক ফোঁটা জলের ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। ইদানিং তার চোখ জুড়ে মেঘ করে না। দু’চোখ জুড়ে এখন শুধুই রিক্ত পথিক শীতের আনাগোনা। মনের আকাশে যতদূর চোখ যায় কেবল ধুসর বিষন্নতা। তবে আজ অনেকদিন পর চোখ ভিজছে নিজস্ব বৃষ্টিতে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:০১