দারোয়ান এসে দাঁত কেলাতে কেলাতে বললো,"বাড়িওয়ালা বাইধ্যা রাখতে কইসে,শেকলও পাঠায়ে দিসে!"
কত্ত বড় সাহস,বেঁধে রাখতে বলে,আবার শেকলও পাঠায়ে দিসে,রক্ত মাথায় উঠে গেল,আমার বোনরে আমি স্বাধীনভাবে রাখব তাতে তোর কি?
দাঁত মুখ খিচিয়ে বললাম,"রেখে যা"
আশ্চর্য তুই করে কেন বললাম,দারোয়ান লোকটা যথেষ্ট বুড়ো।অবশ্য নাম্বার ওয়ান ইব্লিশ,ইব্লিশও এর কাছে গ্যাদা বাচ্চা!দারোয়ানগিরি করা ছাড়া তার আরেকটা কাজ হচ্ছে আমার বোনের কাজ কাম লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে বাড়িওয়ালাকে রঙ চঙ মাখিয়ে বলা।এতে বাড়িওয়ালা যায় আরও গরম হয়ে।
বুড়ো দারোয়ান এখনো যায়নি,মুখ ভর্তি দাড়ি,মেহেদি লাগানো,লাল দাড়ি,মাথায় টুপি,আবার কেলায়ে বলল,"আমার সামনে বাঁধতে কইসে"
বাইঞ্চদের বাচ্চা। থাকবোই না এ বাড়ি।বাড়ি অবশ্য খুঁজছি,টাকা অনুযায়ী পাচ্ছি না।লোকে বলে টাকা হলে সব পাওয়া যায় কথাটা ঠিক,আমার টাকা নেই আমি কিছুই পাচ্ছি না,সামাণ্য বাড়িও না।অবশ্য বাড়িওয়ালাদের কাছে বোনের বর্তমান অবস্থা লুকিয়ে রাখতে হয়।এমন অবস্থা শুনলে ভাড়া দিবে না অবশ্যই।
চেয়ার ছেড়ে উঠলাম,আমি এখন বাঁধা মোটা শিকল দিয়ে,এ শিকল একটা জিনিসের মাধ্যমেই ছাড়া সম্ভব,আমার বোনের মৃত্যু!কিন্তু ও আমি চাই না।থাকুক হাত পায়ে শেকল বাঁধা,থাকুক গে।চাকরি করলে যেমন নিজের স্বাধীনতা থাকে না তেমনই আমারো এক-ই অবস্থা।
বোনের কাছে গেলাম,বয়স তেইশ হয়েছে সবে,বুকের দিক থেকে শাড়ি আলগা।সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, গভীর আগ্রহে দেয়াল ঘড়ি দেখছে,টিক টিক করে শব্দ হচ্ছে আর একটা কাটা ঘুরতেই আছে, ঘুরছে.. ঘুরছে.. বোধহয় অবাক হচ্ছে,থামছে না কেন?আমার জীবন থেমে গেল এই জিনিসটার জীবন থামে না কেন?বোনটা ত আর জানবে না থামার জন্য ওর জন্ম হয়নি,থামার জন্য আমাদের কাররই জন্ম হয়নি,যতক্ষণ না পর্যন্ত মৃত্যু মানুষটা এসে বলবে,"আসসালামুওয়ালাইকুম,চলুন যাওয়া যাক"ততক্ষন আমাদের দৌড়াতে হবে,অনেকটা পথ,অনেকটা,অনেকের ভাগ্য ভালো থাকলে পথ অনেক ভালো হতে পারে,আমেরিকার রাস্তার মতো আর আমার মত হলে বাংলাদেশের গ্রামের এবড়োখেবড়ো রাস্তার মতো হয়,প্রচুর কষ্ট এক কদম ফেলতে,আরেক কদম ফেলার আগেই মনে হয়,আগের মতোই ত সেই কষ্ট হবে, থাক না,বরং দাঁড়িয়ে যাও,যেয়ে লাভ কি?মৃত্যুর সাথে এখানেই হাই হেলো সেরে নাও।
বোনের কাছে যেয়ে বুকের কাছটাতে আঁচল টেনে দিলাম।বুড়ো দারোয়ান বোনের সমস্ত গা গিলে বসে বসে,বাড়িতে এক্টাকে গিলেও হচ্ছে না।আবার মাঝে মাঝেই বলে,"আল্লাহ রহম করো"বড়ই হাস্যকর মনে।হয়,ভেতরে নোংরা বাইরে ফিটফাট থাকার চেষ্টা।
আল্লাহ রহম করুক।
শিকল দিয়ে পা বাঁধলাম,টুঁ শব্দও করলো না ঘড়ির দিকেই নজর।তারপর ঘরের একটা পিলারের সাথে বেঁধে দিলাম।
কুত্তার বাচ্চা বুড়ো দাঁত বের করে বলল,"চাবিটা দ্যান।"
শুয়োরের বাচ্চা বাড়িওয়ালা।ভাবছে পরে ঠিক খুলে দেব তাই চাবিও নিতে পাঠাইসে,আমি চাবি দিয়ে দিলাম।
"যাই বুঝলেন"বুড়োটা বলে চলে গেল।
একটু পরেই বোনের অসহ্য লাগা শুরু কর।এমন বেঁধে আগে কখনও রাখিনি।পা দিয়ে খালি শিকল ঘষে,খুলতে পারে না যে।বারবার হাত দিয়ে টান দেয় একটু পর জোরে জোরে টানা শুরু করল,চিৎকার করা শুরু করলো।লোকে বলেছ পাগলা গারদে দিয়ে দিতে,কিন্তু আমার বোনটা তো পাগল না ওকে আমি ওই বিশ্রি জায়গায় পাঠাবো কেন?
ছোটবেলার সেই বোন,কত ঝগড়া কত খুনসুটি।ওকে লজেন্স দিলে আমারে কেন দিলে না?মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করা,এই মা-বাবা তোরে বেশি ভালোবাসে না আমারে।বড় হলে যখন বোন বুঝতে শিখল তখন অবশ্য বলতো,আরে বাবা তোকেই বেশি ভালোবাসে,এমন গাল ফুলিয়ে আছিস কেন?
সেই বোনটাকেই একদিন বিয়ের অধ্যায়ে ঢুকতে হলো,বংশ খানদানি,টাকা পয়সা ওয়ালা, বাইরের দিকটা দেখা হলেও বাবা ভেতরটা দেখতে ভুলে গিয়েছিলেন বোধহয়।মা হারা একটা মেয়ের সুখের চিন্তাটাই প্রধান।তারপরে আমার বোনটার যে কি হল।স্বামী নেষা করে বাড়ি আসে,বেশ্যাপল্লিতে যারে এক নামে চেনে,রাতের কাজ সারা হয়ে গেলেই আমার বোনটার দায়িত্ব শেষ হতো,কোন কোনদিন অসুস্থ থাকলে রাতের কাজ করতে না পারলে সে কি গালি,কি মারটাই না মারতো,মা মরা বোন,খুবই আদরের।বাবা কবে আমাদের দুজনের গায়ে হাত দিয়েছেন আমার মনে পড়ে না।সেই বোনটাকেই কি না একজন লোক মারবে?গালি দিবে?কে যে মানুষ না?নারী বলেই তার এত্ত অবহেলা?এত্ত অপমান?তবুও বোনটা আমার দাঁত চেপেই ছিল,শুধুমাত্র বাবা আর আমার কথা ভেবে,কারণ আমার বিয়ে বাকি,বড় বোন যদি ডিভোর্সি হয় তাইলে নিশ্চয়ই ভায়ের বিয়ে দিতে সমস্যা হবে।আর বাবা?মরেই যাবা নিশ্চয়।কিন্তু আমি কেমন করে সহ্য করবো?চোখের সামনে সব দেখেও চুপ করে থাকব শুধুমাত্র মেয়ে পক্ষ বলে?ছাড়িয়ে আনলাম,এর পরে প্রেসার পড়লো বাবার,চায়ের আড্ডায় বন্ধুদের টিটকিরি পাড়ার ছেলেদের ব্যাঙ্গ করে শিস বাজানো,পাড়ার মহিলাদের নানা রকম আজেবাজে কথা বার্তা, বাবা নিতে পারেনি,মৃত্যু বাবাজি এসে সাইনবোর্ড টানিয়ে দিল
"স্ট্রোক"যাও তোমার পথ এখানেই শেষ,এত স্ট্রেস আর নিতে হবেনা,স্বর্গে সুখ কর।
বাবা হয়তো বলেছি,কিন্তু আমার দুইটা ছেলে মেয়ে?ওরা কি করবে?একা কিভাবে থাকবে এই জীবনে?
মৃত্যু হয়তো বলেছিল,সে দায়িত্ব আমার,একদিন আমিও আসবো ওদের সামনে।চলো দেরি করো না,ব্যাগ পাতি নিছ নাকি?ওমা ওসব রেখে যাও,ওসব নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই।
"এটা আমাদের এক্টাই ফ্যামিলি ফটো,আমরা তিনজন একসাথে,এটা অন্তত নেয়া যায় না?এই ছবিটা দেখেই আমি এতটা পথ এসেছি।"
"না ভাই,বেশি কথা বলবেন না তো,বলেছি না খালিহাতে যেতে হবে, রাখুন ওসব,স্বর্গে যেয়ে আপনার বউয়ের সাথে দেখা কইরেন"
আচ্ছা ডিভোর্স হওয়ার পর সব দায় কেন মেয়ের?কেন সব যন্ত্রনা সব টিটকিরি,পাড়ার মহিলাদের টিটকিরি সব মেয়েরা সহ্য করবে?কেন মেয়েটা কুঁড়ে কুঁড়ে মরবে, যেমন আমার বোন,মরে নি,মাথা খারাপ হয়ে গেছে,এসবের জন্য দায়ি আমরা সবাই,আমিও,বাবাও পাড়ার প্রতিটা মহিলা,প্রতিটা বখাটে চেইন স্মোকার ছেলে।তারা এখন কোথায়?তারা কি জানে তাদের সামান্য টিটকিরিতে আমার বোনটা শেষ হয়ে গেল?তারা কি জানে আমাদের পরিবারটা শেষ হয়ে গেল?কোথায় তারা?
বাবা মা,সত্যিই আমি আর পারছি না।এত বড় দায়িত্ব আমার উপরে দিয়ে বিন্দাস স্বর্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ না?আমার কথা একবারো ভাবলে না?মৃত্যু,কোথায় ভাই আপনি?সবাইকেই ত নিচ্ছেন প্রতিদিন,কত মানুষ্কে নিচ্ছেন,আমার বোন আর আমকে নিবেন?না না স্বর্গে না দিলেও চলবে,স্বর্গে যাওয়ার মতো নামায কালামের সার্টিফিকেট আমার নেই,আমার ত খালি বোনটাই আছে।নিন না ভাই,পা ধরছি।প্রতিটা মুহূর্তে যা ঘটছে তাতে আমার প্রতিটা কোষ,শিরা,ধমনী বিষিয়ে উঠছে আমি সত্যিই আর পারছি না সত্যিই না।
পৃথিবী তুমি খুব বিষিয়ে গেছ গো,মানুষ তোমাকে বিষিয়ে ফেলেছে।