সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠল মাসুদ। কলিং বেল টিপতেই ভিতর থেকে কে যেন দেখল ডোর ভিউ দিয়ে? কিছুক্ষণ পর দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেল। ছোট শব্দ করে জড়তার সাথে সালাম দিল সুমী। সালাম দিয়ে দরজার পাশে দাঁড়াল। আম্মু ভাইয়া এসেছে বলে ডাক দিল। আন্টি মনে হয় রান্না ঘরেই ছিল। এল কিছুক্ষণ পর। কুশলাদি জিজ্ঞেস করল মাসুদকে। আলাপ-আলোচনায় ঘন্টা দুয়েক কখন যে চলে গেল বুঝতে পারেনি। বিদায় নিয়ে সেদিনের মত চলে এল বাসায়।
দু’ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ছোট সাজানো সংসার আন্কেলদের। সাথে চলাচল অক্ষম বৃদ্ধ বাবা এবং কাজের মেয়ে রহীমা। আরো আছে দূরসম্পর্কের ভাতিজা রিপন। সন্নতানদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এরা এসেছেন ক’দিন হল। আঙ্কেল মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী। জীবন জীবিকার সন্ধানে ছুটে গেছেন সুদুর সৌদি আরবে রাসল (সা) এর স্মৃতি বিজড়িত হৃদয় তীর্থ মক্কা নগরীতে।
একদিন বসে আলাপ করছিল মাসুদ। আন্টি বলল, বুঝলে মাসুদ ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার দায়-দায়িত্ব এখন তোমাদের। তোমাদের আশায় শহরে আসা যখন যা করার প্রয়োজন নিশ্চিন্তে, নি:শঙ্কোচে বলবে। আন্টির কথায় অনুনয়ের সুর ভেসে উঠে। শুনে মাসুদ বলল, কি লাভ এত কষ্ট করে ছেলে-সন্তানদের লেখাপড়া করিয়ে? দু’দিন পর মেয়েকে চলে যেতে হবে পরের ঘরে। আর ছেলে হয়ে যাবে অবাধ্য। তার চেয়ে বরং এককাজ করুন, সুমীকে বিয়ে দিয়ে দিন একটা ভাল পাত্র দেখে এবং রাজুর জন্য একটি মেয়ে নিয়ে আসুন, আর রানা তো এখনো ছোট। ওর জন্য পরে ভাবলেও চলবে। কী বলুন, চমৎকার আইডিয়া না ? আজকাল ছেলেরা দেখছেন না কিভাবে মা-বাবাকে নিজ হাতে খুন করছে। এভাবে কষ্টের ঘানি টেনে কী লাভ?
ঠাট্টাচ্ছলে মাসুদের কথা শুনে আন্টির যেন আক্কেল গুড়ূম। বলল, দেখ ছেলের কথা ? সবাই হাসিতে ফেটে পড়লেও সুমীর ভাব লক্ষ্য করল মাসুদ। যেন ভেতরে প্রচন্ড রাগ। তার মুখের অভিব্যক্তি সেটা বলে দেয়। আসলে মাঝে মাঝে মাসুদ এমন কথা-বার্তা এবং কান্ড কারখানা করে নিজেও বুঝতে পারেনা। কিছুক্ষণ নীরবতার পর আন্টি বলল, তোমার িআঙ্কেল আজ ফোন করেছে। সুমী ও রাজুর কথা জানতে চেয়েছে।
-মাসুদ বলল, কাল সুমীকে কলেজ ভর্তি কোচিং-এ ভর্তি করে দেব এবং রাজুর কথা চিন্তা করছি এখনো। আন্টি বলল, রাত হয়ে গেছে। খেয়ে দেয়ে যেও। মাসুদ বলল, খেয়ে দেয়ে লাভ নেই। সে পরে দেখা যাবে।
রাজু ভর্তির ব্যবস্থা হল নগরীর একটি স্কুলে ৮ম শ্রেণীতে। সুমীকেও কোচিং সেন্টারে ভর্তি করা হল। সুমীর কোচিং ক্লাস হবে মাসুদের অফিস সংলগ্ল বিল্ডিং এর পাশে। তাতে বেশ সুবিধা হল বৈকি। নিয়মিত ক্লাস চলছে কিন্তু একদিন ঘটল বিপত্তি। কোচিং সেন্টারে পুলিশী হানা। কয়েকজন শিক্ষককেও পাঠদানরত অবস্থায় ধরে নিয়ে গেল পুলিশ বিনা অজুহাতে। বারান্দায় বের হয়ে মাসুদ দেখল শিক্ষার্থীদের হৈ চৈ। উপস্থিত কিছু অভিভাবকও। তারা যে যার মত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল, শহরে অনেক কোচিং সেন্টার আছে শুধু আমাদেরকে কেন বাধা দেবে? এটা মগের মুল্লুক নাকি? শিক্ষা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। এ অধিকার বাধা দেওয়ার অন্যায় আবদার কে দিল তাদেরকে ?
-দাদা ভাই, আস্ সালামু আলাইকুম। কি খবর ? ভাল আছেন?
-কে কে মাসুদ নাকি? নাতি কোন রকমে বেঁচে আছি এ আর কি?
-মাসুদ বলল, দাদা আপনার বড় ভাই এসেছে।
-কোথায়?
-এই তো আপনার সামনে দাঁড়িয়ে। বলতেই হেসে দিল।
-দাদা বলল, আমার সাথে ঠাট্টা-তামাশা করছ। হাউ ডেয়ার ইউ? চট্টগ্রাম শহরের অলিগলিতে খবর নিয়ে দেখ আমি কে? কি ছিলাম? তারপর জানতে পারবে।
-মাসুদ বলল, আরে আপনাদের দিন শেষ। আমার খবর শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারা বাংলাদেশের লোকেরাই আগামীতে জানবে। সুতরাং এখন আমাদের দিন শুরু। এভাবে দাদা-নাতি মাঝে মধ্যে দু’চার কথা হয়। পরক্ষনেই আন্টির গলা শুনতে পেল মাসুদ। বলল, তোমার ফোন এসেছে কথা বল। সেখান থেকে চলে আসতেই বলল, মিথ্যা বলেছি, তোমাকে নাস্তা দেয়া হয়েছে। ঐ বুড়ার সাথে কম কথা বলবে। এ রুমে আসার দরকার নেই। আমাকে দিন রাত জ্বালিয়ে মারল। আসলে ফোন এসেছে বলে কৌশলে মাসুদকে ওখান থেকে নিয়ে এল। যদি দাদা মাসুদকে নেগেটিভ কিছু বলে। তাতে যদি আবার মাইন্ড করে।
নাস্তা শেষ হতে আন্টি বলল, সুমী ও রাজুকে একটু দেখ।
-মাসুদ বলল, কি দেখব?
-তাদের পড়ালেখা কেমন চলছে এই আর কি?
মাসুদ বলল, জীবনের পঁচিশটি বৎসর শুধু লেখাপড়া করেই কেটে গেল। এখন পড়ালেখা শেষ। বাকী জীবনে আর পড়ালেখা নাম নেব না। অনেক দিন পর যেন ভীষণ কঠিন একটি জিনিসের হাত থেকে রেহাই পেলাম লেখাপড়া শেষ হওয়ায়। লেখাপড়া নাম শুনলে মাথা ব্যথা শুরু হয়। থাক পড়ালেখা! আসলে মাসুদ ঠাট্টা করে বলছিল একথা। মাথা ব্যথা যে শুরু হয় তার প্রমান পেল দু’একদিন পর। সুমী বলল, ভাইয়া এই অংকটা সঠিক হয়েছে, কিন্তু কোচিং সেন্টারের ভাইয়ারা কোন নম্বর দিল না।
-মাসুদ বলল, দেখি, কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর বলল দাও খাতা কলম। আমি করে দেখি। আসলে অংকটি কঠিন ছিল না, কিন্তু তারপরও সমাধান করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হল। দেখলাম উত্তর সঠিক আছে। বলল, নম্বর দেয় নি তাতে অসুবিধা কি? অংকটা সঠিক হয়েছে এটাই বড় কথা না?
সুমীটার এমন চাপাস্বভাবের যে সহজ ভাবে কথা বলতে চায় না। কোন সমস্যা থাকলে তা -ও বলে না। সারাক্ষণ আশে পাশে ঘুর ঘুর করে। যেন কী বলতে এই ভাব। অলক্ষ্যে তার হাব ভাব দেখি। আসলে সে ভীষণ লাজুক টাইপের। তারপরও এমন, স্নিগ্ধ, শান্ত অবয়ব নজর কাড়া চাহনি বড়ই মায়া লাগে।
সামান্য পরিচয়ের একজন অতিথি পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে সেদিন বাসায় থেকে গেল। রিপন ভাই থাকাতে রাত্রে নিশ্চিন্ত মনে চলে এল মাসুদ। আরেকদিন ঐ অতিথি আবার নাস্তাসহ হাজির। খুবই বিরক্তি বোধ করল সকলেই। দাদার রুমে গিয়ে গল্প জুড়ে দিল। রাত্রে খাওয়া-দাওয়া করল। মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে কি করা যায়? শহরে এসেছে এরা নতুন। অপরিচিত লোক, নাম ধাম কিছুই জানিনা। মনে কিছুটা শংকা জেগে উঠে। রিপন ভাই গ্রামে গেছে বাসায় মাত্র ছোট দু’জন ছেলে। আন্টি বলল, আজ বাসায় থেকে যাও।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর মাসুদ বলল, ঠিক আছে, আগে বাসা থেকে আসি। মাকে বলে খাওয়া দাওয়া করে বের হল। রিক্সা করে যাচিছ। মনে মনে চিন্তা করল আন্টি আজ কয়েকটি কঠিন কথা শুনাতে হবে। যথাসময়ে বাসায় পৌঁছাল। সবাই ড্রইং রুমে বসে, সবাই মুখের দিকে তাকাল। সোফায় বসে বলল, সবাই চলে যাও, থেকে গেল আন্টি আর সুমী।
কোন কিছু না ভেবে বলল, পৃথিবীতে সুখী হওয়ার অন্যতম উপায় হল কাউকে বিশ্বাস না করা এবং প্রশ্রয় না দেয়া। এরা হতচকিত হল, বলে কী এই ছেলে। হ্যাঁ, বিশ্বাস না করা প্রথমে আমার থেকে শুরু করুন। কেন শুধু শুধু মানুষকে বড় বেশি বিশ্বাস করেন? কীসের ভিত্তিতে বিশ্বাস? একজন অপরিচিত লোক কেমন করে দু’রাত থেকে যেতে পারে? এরা মাসুদের কথায় প্রচণ্ড ঘাবড়াল। বিষয়টা বুঝতে পেরে বলল, এই ধরনের ভুল আর হবে না।
-মাসুদ বলল, ফের যদি এ ধরনের আর হয় তবে তোমাদের মধ্যে আমি নেই। কোন সমস্যা যদি হয়ে যায় আমাকে বলতে পারবেন না। আন্কেল ফোন করলে সব বলে দেব।
-আন্টি আতঙ্কিত স্বরে বলল, তোমার দোহাই লাগে, তোমার আঙ্কেল কিছু বলো না। আমাকে ঘর থেকে বের করে দেবে।
সুমন ভাই প্রায়ই ঢাকা থাকেন। অফিসিয়াল ব্যস্ততা বড্ড বেশী। সপ্তাহ দু’একদিনের জন্য চট্টগ্রাম আসে। মাসুদের বড় ভাই সুমন। প্রায়ই দুপুরে অফিস থেকে সোজা আন্কেলের বাসায় আসে। ডিনারের পর চলে যায়। মাসুদকে আন্টি প্রায় খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে। মাসুদ বলে, প্লীজ প্রতিদিন ঐ এক কথা আর বলবেন না। আমার ইচেছ হলে আপনাকে বলতে হবে না। আমার যখন ইচছ এখানে আসব খাব এবং চলে যাব তা নিয়ে কারো চিন্তা করতে হবে না। শুনে আন্টি বলল, আসলে সব কিছুতে তুমি একটু বেশী বুঝ।
-ঠাট্টা করে বলি, আমি সবজান্তা মসের না?
কয়েকদিনের মধ্যে সুমীর পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। এ নিয়ে বাসায় আলাপ চলছিল। সিড়ি দিয়ে নিচে নামছিল মাসুদ চলে যাবার উদ্দেশ্যে। নীচে নামল। তিন তলা থেকে রানার চিৎকার শুনতে পেল। রানাকে দেখা যাচেছ পাশের আড়ালে সম্ভবত সুমী ছিল। ইদানীং রানার দুষ্টুমীও বেড়ে গেছে। সুমীর শিখিয়ে দেয়া বুলি আওড়ায়। রানা বলছে, ভাইয়া কালকে মিষ্টি নিয়ে আসবেন। কয়েক সেকেন্ড বাদে আবারও বলল, ভুলবেন না কিন্তু। চিন্তা করল মাসুদ, কে শিখিয়ে দিল সুমী না রাজু। পরদিন একটা কৌশল অবলম্বন করল মাসুদ। আন্টিকে বলল,আন্টি মাঝে মধ্যে রাজু আমার সাথে বেয়াদবি করে।
-আন্টি বলল, কি করেছে সে ?
-মাসুদ বলল, গতকাল রানাকে গতকাল মিষ্টি আনতে শিখিয়ে দিল। এই যা-তা।
আন্টি বলল, এই তোর ভাইয়া থেকে মাফ চাও। রাজু রেগে গিয়ে বলল, আমি বলি নাই। পর পর সে অস্বীকার করল।
রানা দৌড়ে গিয়ে তার আপু সুমীকে হাত ধরে নিয়ে এল। অবস্থা বেগতিক দেখে সুমী বলল, আম্মু আমি শিখিয়ে দিয়েছি রানাকে। আন্টি কটমট করে সুমীর দিকে তাকাল।
মাসুদ বলল, যাক আন্টি বাদ দেন। বলাতে ঝড় থামল।
অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে প্রায়ই মাসুদ আন্টির বাসায় উঠে। একদিন যদি এর ব্যতয় ঘটে, তুল কালাম কান্ড। নীচে এসে সরাসরি ডায়াল। অবশ্য ইতিমধ্যে বাসায় ফোন এসেছে বিধায় নিচে নামতে হয় না। কি ব্যাপার, আজকে আসেননি কেন? কোন অসুখ বিসুখ হয়েছে নাকি? মনে হয় এক স্নেহময়ী মায়ের মমতা ঝরে পড়ে।
-মাসুদ বলল, এত সহজে আমার অসুখ হয় না? হয়তো জীবনে একবারেই হবে তখন আর সময় থাকবে না। এই পৃথিবী ছেড়ে .... এ কথায় আন্টি মৃদু ভৎসর্না করে। এ কথা মুখে আনতে নেই। আরও কত কি ?
আমাদের জন্য আন্টির স্নেহ-ভালবাসা তুলনাহীন। যেজন্য তিনি অনেক নিকট জনকে পরিত্যাগ করেছেন। কম শত্রুতারও মুখোমুখি হননি। প্রবাস থেকে ছোট এই সংসারকে সাজাতে কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন। সুমীকে কী রকম ভালবাসে তা কোন লিখনীর মাধ্যমে লেখা অসম্ভব বৈকি। সুমী হচেছ তার কলিজার টুকরা, নয়নের কাজল। সমস্ত পৃথিবী একদিকে আর অন্য দিকে একাই সুমী। পরীক্ষাকালীন যে মেয়ের জন্য তার বাবা নফল রোজা রাখতে পারে সে ভালবাসার পরিমাপ কতটুকু গভীর তা সহজেই অনুমেয়।
দিন যায় রাত আসে, সময় গড়ায়। আঙ্কেল করে নিয়মিত। সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় গাইডেন্স দেয়। সবাই আঙ্কেলের নির্দেশ অলংঙ্গনীয় ভাবে মেনে চলে। এই সংসারের জন্য রিপন ভাইয়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আঙ্কেলের ছেলে মেয়েদের জন্য কী যে গভীর দরদ। কত কিছুই নীরবে সহ্য করা যায়!
মাসুদ ভাবে এই পৃথিবী, এই মায়ার সংসার চিরস্থায়ী নয়। মানুষ বাচে, বাঁচার জন্য সংগ্রাম করে। স্বপ্ন দেখে, সোনালী স্বপ্ন সুন্দর ভবিষ্যতের। যে যার মত সংসারকে রাঙ্গাতে চায় সাধ্যমত। মানুষ ভালবাসে মানুষকে, ভুল বুঝে আবার সে ভুল ভাঙে। পর¯পরের জন্য কতই না মায়া। সুখী হওয়ার জন্য মানুষ কত কিছুই না করে। কেউ হয় কেউ হয় না। আঙ্কেলের ছোট্ট ঘরখানা খুশী আনন্দে ভরে তুলতে নি:স্বার্থ ভাবে কত কিছুই না আবর্তিত। স্বপ্নের সিড়ি বেয়ে এভাবে এগিয়ে চলে তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ সাত সমুদ্রের নাবিকেরা। এভাবে চলছে দিনের পর দিন।
=====
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:১৪