(দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব) :
কল্পনা কলেজে যাওয়ার পরই কোন খবর ছাড়াই লীরা আসে বাসায়। লীরা কল্পনার কাজিন। রাতে শুয়ে আছে দু’জন। কল্পনার মোবাইলে বারবার মিস কল আসছে। লীরা এর কারণ জিজ্ঞেস করে হাসি হাসি ভাব নিয়ে। কীরে কোন্ নাগর এত মিস কল দেয়? তোর কিছু হয়ে গেছে বুঝি?
কই কি হবে? কি হওয়ার কথা? জানতে চায় কল্পনা।
দেখে তো মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানো না। তা ছেলেটা কি দুপুরে আন্টি বলছিল ওটা? ওর সাথে নাকি আগামী সপ্তাহে তোর এনগেজমেন্ট? শুধু তাই না ছেলে পক্ষ তাড়াতাড়ি শুভ কাজ সেওে ফেলতে চায় নাকি।
লীরার কথা শুনে বুকের মধ্যে ধপ করে উঠে? তোলপাড় শুরু। কার কথা বলেছে? নাবিল কি সবাই বলে দিছে রিয়াজের কথা। কেন যে ঐদিন নাবিলকে নিয়ে রিয়াজের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম?
কোন্ ছেলে? কি নাম বলেছে সবুজ না যেন কি ভুলে গেছি সবুজই মনে হয়।
সবুজ নামের কোন ছেলেকে তো কল্পনা চেনে না, কোন আতœীয়ও ঐ নামে নেই।
আমি ঠিক জানি না। বলে একেবারে থ বনে যায়। ভেতরে ঝড় তুফান শুরু।
কিরে চুপ মেরে গেলি যে? নাকি অন্য নাগর?
না ঠিক তা নয়। আমার ইংলিশের টিচার।
টিচার মানুষ ছাত্রীকে মিস দেবে কেন?
উনি নাকি সকল ছাত্র-ছাত্রীকে ঐ রকম মিস কল দিয়ে কোন সমস্যা আছে কিনা জানতে চায় চায়?
আজব চিজ তো। দেখি নম্বরটা?
লীরা নম্বর নিয়ে ওর মোবাইল থেকে দেয় কল ব্যাক।
ঐ শালা, তো কি খাইয়া দাইয়া আর কোন কাম নাই?
সম্্রাট রিং ধরে থতমত হয়ে যায়। বলে কি?
কে বলছেন?
কেউ না আমি তোর আম্মা?
জি।
জি না
ঘি।
বলে কেটে দেয় লাইন।
সম্্রাট ভাবে কি ব্যাপার। কয়েকজনকে মিস দিছি। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা না। কল ব্যাক করবে কি না ভাবতে থাকে। যাক ভাবা আর কাউকে মিস দেব না। কল ব্যাক করে সে। নম্বরটা দেখে লীরা হাসি আর ধরে না। এটেন্ড করে না সে। এভাবে কয়েকবার রিং দেয়।
রাতে কি তোকে কিছু বলেছে লীরা।
কি বলবে?
তোর বিয়ের কথা।
ভাল একটা ছেলে পাওয়া গেছে নাকি।
তোর আব্বার একসময়কার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছেলে। নাম সবুজ, থাকে লন্ডনে। বিয়ের পর তোকে নিয়ে পাড়ি দেবে রানী এলিজাবেথের দেশে। ওর আম্মা রসিকতা করলেও ভেতরে কেমন যেন লাগে।
আম্মা আমার পড়া এখন শেষ হয়েছে?
না।
তবে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে যে আমাকে নিয়ে।
কেন বিয়ের পর পড়তে পারবি।
তোমরা আমার মতামতও নিলে না।
ছেলে মেয়ের মঙ্গলই তো চায় মা-বাবা।
বিয়েটা দিতে পারলেই তোমাদের দায়িত্ব শেষ? তাই মনে করো? তুমি তো এ যুগের মেয়ে তাই না?
দায়িত্ব শেষ হবে কেন?
লীরা এসে পড়ে কথার মাঝখানে।
লীরাও সমবয়সী। অন্য কলেজে পড়ে।
কল্পনা আগে দেখ, ছেলে তোর পছন্দ হয় কিনা। তোকে কি জোর করে বিয়ে দিতে পারবে না নাকি?
কল্পনা সেখান থেকে চলে যায়। ভাবতে থাকে সে, ওর আব্বাকে ভীষণ ভয় করে। কোন কথায় না বলা যায় না। এক কথার মানুষ। যা বলে তাই করে। রিয়াজের এখন পরীক্ষা চলছে, এনগেজমেন্টের কথা বললে রেজাল্ট খারাপ হতে পারে। কি করণীয় বুঝতে পারে না। লীরাও কোন সৎপরামর্শ দিতে পারছে না। যদি না করা হয় তবু কাজ হবে না। ছেলের পক্ষ মেয়ে দেখার জন্য দিনক্ষণও ঠিক করে ফেলেছে। লীরা বলে যা ই করবে, কিন্তু বাবা-মার অবাধ্য হসনে। লীরার সিনিয়র এক বান্ধবী রেশমী ঘটনার কথা কল্পনাকে বলে। গার্ডিয়ানের অমতে বিয়ে, পালিয়ে যাওয়া, আতœীয়দের সাথে সম্পর্ক বিনষ্ট, প্রায় ১০ বৎসর নিঃসন্তান থাকা, আর্থিক টানা পোড়েন, প্রেমের বিয়ের অন্তর্বিরোধ, বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি বলে বাস্তববাদী হতে বলে।
সবুজের হাতে সময়ও একদম নেই। মাস খানের মধ্যেই বিয়ের সমস্ত ঝামেলা শেষ করতে হবে। আজ কল্পনাদের বাসায় যাওয়ার ডেট। ওর আব্বা সকাল থেকেই রেডি। কল্পনার আব্বাকে ফোনে জানিয়ে দেয় আসার কথা। ঊভয়পক্ষ দারুণ ব্যস্ত। অবাক করার মত ব্যাপার কল্পনাদের বাসায় আসার সময় শুধু আংটি পড়ানো নয়, শুভ আকদ্ এর জন্যও প্রস্তুতি নিয়ে আসে। কিন্তু কল্পনা পরিবার তা জানে না। কল্পনার গার্ডিয়ানরাও অমত করেনি। কিন্তু কল্পনা বেঁকে বসে, শুধু এনগেজমেন্টের জন্য সে রাজি হয়। পরবর্তী শুক্রবার বিয়ের দিন ধার্য্য করে বিদায় নেন সবুজ পরিবার।
রিয়াজ পরীক্ষা শেষে গ্রামের বাড়ী চলে যায়। কল্পনাকে বললে হয়তো দেখা করতে চাইবে তখন বাড়ী যাওয়া নাও হতে পারে,তাই ফোন করেনি। কল্পনা শত চেষ্টা করেও নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না রিয়াজের। মাঝে মধ্যে পেলেও কথা পরিষ্কার না। টেনশনে কাহিল সে। কি হতে যাচ্ছে ভেবে কুল পাচ্ছে না। রিয়াজ গ্রামের বাড়ী গেছে বন্ধু রাজিন থেকে জানতে পারে। গ্রামে তো কেউ নেই রিয়াজকে খবর দেওয়া যায়।
কুশল বিনিময় শেষে রিয়াজ পুকুরে গিয়ে দেয় ডুব। আহা! অনেক দিন পর মনের মত করে গোসল করা। ভাত পাতে মা বড় মাছে মাথাটা তুলে দেয়। বছর খানেক পূর্বের করা পাসর্ফোট কোথায় জানতে চায় মা। রিয়াজের মা বলে গত কয়েকদিন আগে তোর ছোট মামা তোর পরীক্ষা শেষ হয়েছে কিনা জানতে চেয়েছে। তোর মামা দুবাইতে আরেকটা দোকান নিয়েছে। তোকে একমাসের মধ্যে নিয়ে যেতে চায়। তোকে বলেছে পাসফোর্টের একটা কি যেন একটা বলেছে। হাসি তুই বলনা?
ভাইয়া, ই-মেইল করে করে দিতে বলেছে।
খাওয়ার মধ্যে ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায়। অনার্স তো শেষ মাস্টার্সটা কি শেষ করতে পারব না। মা তুমি বলে দিও আর এক বছর পর, এখন না।
মায়ের মনটা মলিন হয়ে যায়। তুই আমার কথাটা রাখ বাবা।
দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। একদিকে মায়ের আদেশ অন্যদিকে ভবিষ্যত। ঠিক আছে মা কি করা যায় আগামী কাল বলব।
তোর মামাকে কি বলব?
আমি ফোনে জানাব।
তুই আবার না করিস না। দেশে পড়া লেখা করে চাকরি করে ঘানি টানবি, কিন্তু অবস্থা সম্পন্ন হতে পারবি না। দেখলি না তোর মামার অনেক বিদেশে নিয়ে গেছে সবাই মাসে মাসে টাকা পাঠাচ্ছে। অনেকে জায়গা জমি কিনছে। তোর বন্ধু রকিবের বাবা বলছে ছেলে নাকি ফোনে বলেছে পাকা দালান করবে, এর পর রকিবের জন্য বউ আনবে। তুই আর একবছর পড়বি, কবে চাকরি পাবি। চাকরি পেতে আবার মামা চাচা লাগে, পয়সা লাগে। সে অনেক দেরী।
কি দেরী মা?
কেন তোকে বিয়ে করাতে হবে না?
রিয়াজ লজ্জা পেয়ে বেরিয়ে যায়, মা আমি একটু ঘুরে আসি।
বেশী দূরে যাসনে। এলাকার পরিস্থিতি ভাল না।
বিয়ের কথা বলায় চিন্তা মাথায় এলো, কল্পনাকে ফোন করা হল না। কাজটা কি ঠিক হয়েছে, বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে? বিবেক না বোধক বলে। যাক, একেবারে সারপ্রাইজ দেওয়া হবে। এদিকে রিয়াজের জন্য আরো বড় সারপ্রাইজ যে অপেক্ষা করছে সেটা যদি জানত তবে কি একমুহুর্তও কি গ্রামে পড়ে থাকা যেত?
সবুজ-কল্পনার বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। কল্পনাও ভাগ্যকে মেনে নিয়ে সঁেপ দেয় নিজেকে। নিউমার্কেট মোড়,বিয়ের বাজার শেষে সবুজ পরিবার গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ বিকট আওয়াজ, বোমা বিস্ফোরণ। মানুষের ছুটাছুটি। ভয়-বিহ্বল, সবাই আতœরক্ষায় ব্যস্ত। নিথর কয়েকটা দেহ পড়ে রয়েছে। দুইটা লাশ, সবুজও তার মধ্যে। সবুজের পিতার হুঁশ আসল কে কোথায়? পুলিশ লাশ নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু সবুজের বাবা হাউমাউ করে কেঁেদ দেয়। লোকজন ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কল্পনার বাবা খবর পেয়ে ছুটে গেছে হাসপাতালে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে কল্পনার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে। শোকে যেন পাথর।
আজ শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল রিয়াজ। ডায়াল দিল কল্পনাকে। রিসিভ করে না, একবার, দুইবার, অনেকবার...কি ব্যাপার কল্পনা বিবি ফোন রিসিভ করে না কেন? রিক্তাকে ফোন করে, না কোন সাড়া নেই। কলেজে পৌঁছে গেল। কেমন গুমোট হাওয়া, পরিস্থিতি থমথমে। ভেতরে ডুকে না, একটা লোক পেছন থেকে ডাক দিল। কই যান ভাই? দেখেন সামনে পুলিশ। পুলিশ লক্ষ্য করে সামনে। মেসে চলে আসে রিয়াজ। শাহীনের ল্যাপটপটা অন করে। দেখি কিছুক্ষণ টেপাটিপি করে। রিক্তার ফোন এসেছে। রিয়াজ একটা ঝারি মারে রিক্তাকে। ভাইয়া বলে চুপ করে থাকে।
কি ব্যাপার নীরব কেন?
বলতে থাকে রিক্তা একে এক সব ঘটনা। রিয়াজ যেন স্বপ্নের ঘোরে আছে। হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যায়। এভাবে অনেকক্ষণ ঝিম মেরে থাকে। বিকেলে কল্পনাকে আবার ট্রাই করে, ধরে না। রিক্তার মাধ্যমেও বলে কোন খবর নাই। ম্যাসেজ পাঠায় কয়েকটা। রিপ্লাই নেই। শাহীনকে বলে দোস্ত মেইলটা একটু চেক করব। ধর বলে ল্যাপটপটা এগিয়ে দেয়। মামার মেইল। লেখা আছে আজের্ন্ট চলে এসো, ভিসার সাথে কনর্ফাম করা টিকিটও পাঠালাম ২০ তারিখের। হাতে ৫দিন বাকী। মনে মনে ধাক্কা খেলেও ভাল লাগে। প্রস্তুতি শুরু, পরিচিতদের সকলের নম্বর একটা কাগজে লিখে নেয়।
গাড়ীতে এয়ারপোর্টের কাছাকাছি রিয়াজ। কল্পনাকে একটা মেসেজ এবং রিক্তাকে কল করে। মানসপটে একে একে সকল স্মৃতি উম্ভাসিত হতে থাকে। নিয়তি টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে জীবিকার সন্ধানে। বিদায় নিয়ে সবার কাছ থেকে ভেতরে ডুকে যায়। মা চোখে চোখ রাখতেই অশ্রু গড়িয়ে যায়। ইমিগ্রেশন পার হয়ে এখন লাউঞ্জে অপেক্ষমান। ফ্লাইটটা সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পর যাত্রী নিয়ে উড়াল দেবে দুবাইর উদ্দেশ্যে।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১২:৪৭