আমরা যখন মিউনিখ থেকে আমাদের যাত্রা শুরু করলাম তখন মিউনিখের আকাশে সূর্য তার উজ্জল কিরন ছড়াচ্ছিল এবং মিউনিখের বাতাস ছিল গ্রীষ্মের আনন্দে পরিপূর্ন।
হোটেল ছেড়ে যাবার কিছুক্ষন আগে আমি যে হোটেলে রাত কাটিয়েছি সে হোটেলের মালিক হের্ ডেলব্রক আমাদের গাড়ির কাছে এসে দাড়াল এবং আমার যাত্রা শুভ হবার জন্য কামনা করলো। তারপর সে আমার গাড়ীর কোচোয়ানের কাছে গিয়ে দারালো এবং তাকে বললো ভুলে যেওনা আজকের রাতের কথা। তোমাকে কিন্তু আজকে রাত হবার আগেই ইংরেজ ভদ্রলোককে তার গন্তব্যে পৌছে দিয়ে ফেরত আসতে হবে। যদিও আকাশ আজ বেশ উজ্জল তার পরও উত্তরের বাতাসে যে কোন সময় ঝড় শুরু হতে পারে। কিন্তু তারপরও আমি নিশ্চিত তুমি রাত হবার পূর্বেই তাকে পৌছে দিয়ে এখানে ফেরত আসতে পারবে। তা ছাড়া তুমি তো জানোই আজকে রাতটা কিসের রাত।
আমার গাড়ীর কোচোয়ান যোহান তার হ্যাটটা একটু উচু করে জার্মান ভাষায় বললো “ যা মেন হের্।” যখন আমরা শহর ছেড়ে বের হয়ে আসলাম আমি যোহানকে থামতে বললাম। তারপর তাকে বললাম “ আজকের রাতের ব্যাপারটি কি যোহান?”
যোহান আমার দিকে তাকিয়ে বললো আজ ভালগার্সিসের রাত। তারপর সে তার পুরোনো বড় জার্মান ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে কি যেন একটু চিন্তা করলো তারপর আরো দ্রুত বেগে ঘোড়াগুলো ছোটালো। আমি বুঝলাম কোচোয়ান আসলে আমার সাথে কথা বলে যতটুকু সময় নষ্ট করেছে তার হিসাব করে সে সময় পোষানোর জন্য আরো দ্রুত বেগে ঘোড়া ছোটালো। এতে করে তার ঘোড়াগুলিও তার সাথে বিরুপ আচরন করতে থাকলো। আমি বুঝতে পারলাম কোচোয়ান কোনো কারনে ভয় পাচ্ছে। কিছুক্ষন পর আমরা দুই রাস্তার মোড়ে এসে উপস্থিত হলাম। আমি দেখলাম যে একটা রাস্তা উপত্যকার দিকে চলে গেছে। রাস্তাটা কিছুটা কালো, সেই সাথে বেশ সরুও। রাস্তাটা দেখেই আমি বুঝলাম এই রাস্তাটা খুব কমই ব্যবহার হয়েছে। এই রাস্তাটা আমাকে খুব আর্কষন করছিল। আমি যোহানকে গাড়ী থামাতে বললাম। সে গাড়ী থামালো। আমি তাকে ঐ ছোট রাস্তাটা ধরে যেতে বললাম। সে ঐ রাস্তা ধরে না যাবার জন্য বিভিন্ন বাহানা শুরু করলো। ফলে ঐ রাস্তা সম্পর্কে আমার আগ্রহ আরো বেরে গেল। আমি তাকে ঐ রাস্তা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন শুরু করলাম কিন্তু সে নানা ভাবে আমার প্রশ্নের উত্তর এরিয়ে যেতে চাইলো। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম দেখ যোহান আমি ঐ রাস্তা ধরে যেতে চাই। তুমি আমার সাথে যাও বা না যাও আমি তোমাকে আমার সাথে যেতে বলবো না। কিন্তু আমি জানতে চাই কেন তুমি ঐ রাস্তা ধরে যেতে চাচ্ছ না। আমার কথা শুনে সনে হলো যোহান আতকে উঠলো, সে তার আসন থেকে নেমে আসলো তারপর আমাকে হাতজোর করে ঐ রাস্তায় না যেতে বললো। সে তার জার্মান-ইংরেজি মিশিয়ে যা বললো তাতে তার সব কথা আমি বুঝতে না পারলেও একটুকু বুঝতে পারলাম যে সে আমাকে বললো ঐ রাস্তায় না যেতে কারন গেলে আমি বিপদে পরতে পারি। এবং সেই সাথে বললো আজ “ভালগার্সিস” এর রাত।
আমি তার সাথে তর্ক করতে চাইলাম কিন্তু ছিল অত্যন্ত কঠিন যখন ঐ ব্যাক্তিটি আমার ভাষা ঠিক মতো না জানে। কিছু ক্ষন পরপরই যোহান তার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। ঘোড়াগুলোও যেন কোন এক কারনে অস্থির হয়ে উঠছিল এবং বাতাসে লাফিয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল কোন কারনে এরা ভয় পাচ্ছে। অস্থির ভঙ্গিতে তারা চারদিকে তাকাচ্ছিল। হটাৎ ঘোড়াগুলো দৌড়ে প্রায় ২৫ ফুট দুরে চলে গেল। আমি তাকে তার এই আচরন সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম যে কেন সে ও তার ঘোড়াগুলো এ রকম আচরন করছে। তারপর সে রাস্তার এক পাশে এক কবর দেখিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বললো “ এই স্থানে যে শুয়ে আছে সে নিজেকে নিজে হত্যা করেছে।”
আমার তখন মনে পরলো অতীতে কেউ যদি আত্মহত্যা করতো তাকে রাস্তার মোড়ে কবর দেয়া হতো। “ওহ এই ব্যাপার। খুর কৌতুহল জনক। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না এর সাথে ঘোড়ার ভয় পাবার সম্পর্কটা কি।”
যখন আমরা কথা বলছিলাম তখন আমি শুনতে পেলাম নেকড়ের ডাক। এই ডাক ভেসে আসছিল অনেক দূরে থেকে। এই ডাক শোনার পর ঘোড়াগুলো আরো অস্থির হয়ে উঠলো। যোহান বললো এটা নেকড়ের ডাকের মত কিন্তু এই এলাকায় তো কোন নেকড়ে নেই।
“নেই?” আমি বললাম” তুমি কি সত্যই শহরের কাছে নেকড়ে দেখনি কিছু দিনের মাঝে।”
“না” যোহান বললো, ‘ বসন্তে ও গ্রীষ্মে এখানে নেকড়েরা থাকে না। শীতের সময় এদের দেখা পাওয়া যায় তাও অনেক কম।’
সে তারাতারি তার ঘোড়াগুলো শান্ত করার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো, সেসময় কালো মেঘ আকাশ ঘিরে ফেললো। সূর্য সেই কালো মেঘের তলে ঢাকা পড়ে গেল। কিছুক্ষন পরই আবার সূর্য হেসে উঠলো। আকাশে মেঘ দেখে যোহানের মুখে আরো ভয় স্পস্ট হয়ে উঠলো সে বুঝতে পারলো অচিরেই ঝড় আসছে।
“তুষার ঝড় আসছে”। সে আবার তার ঘড়ির দিকে তাকালো, ঘোড়াগুলো আগের মতই অস্থির চিত্তে মাথা ঝাকাচ্ছে, মাটিতে পা ঠুকছে। সে তার কোচোয়ানের আসনে উঠে বসলো।
আমি বুঝতে পারলামসে আর গাড়ী থেকে নামবে না।
নিচে দাড়িয়ে আমি তাকে বললাম ঐ স্থানের কথা যেখানে ঐ রাস্তাটা গিয়ে শেষ হয়েছে।
আবার সে আমার দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বললো ‘ঐ জায়গাটা অপবিত্র।’
“অপবিত্র জিনিসটা কি?” আমি তাকে প্রশ্ন করলাম।
‘একটা গ্রাম’
‘সেখানে একটা গ্রাম আছে’ আমি বললাম
‘না না’ লোকটা আর্তনাদ করে ওঠলো। ‘ এক সময় সেখানে একটা গ্রাম ছিল, কিন্তু গত তিনশত বছর ধরে কেউ সেখানে বাস করে না।’
‘সেখানে একটা গ্রাম ছিল।’
‘এখন সেটা কোথায়?’
যোহান তখন তার জার্মান ইংরেজি মিশিয়ে বললো যদিও তার বেশির ভাগই আমি বুঝতে পারলাম না, তবুও যা যা বুঝলাম তা হলো; প্রায় তিনশত বছর পূর্বে এক লোক মারা গেলে তাকে গ্রামের গোরস্থানে কবর দেয়া হয়। কবর দেয়ার পর আসে পাসের মানুষ কবরের ভিতর থেকে শব্দ শুনতে পায়। তখন গ্রামের সবাই মিলে কবরটা আবার খোলে তখন তারা দেখতে পায় লাসের মুখে টকটকা লাল রক্ত। এবং তখন গ্রামের লোকেরা তাদের জীবন ও আত্মা বাঁচাবার জন্য গ্রাম ছেড়ে অন্য স্থানে চলে যায়। যেখানে জীবিতরা জীবিত, মৃতরা মৃত- অন্য কিছু নয়। শেষ কথাটা সে খুব ভীত ভাবে বললো। আমি বুঝতে পারলাম যোহান নিজের সাথে যুদ্ধ করছে এই স্থান ছাড়ার জন্য। কিন্তু আমার জন্য পারছে না।
সে আর সহ্য করতে পারলো না। চিৎকার করে বললো আজ ‘ভালগার্সিস’ এর রাত।
‘এই রাতের মাহাত্ম কি যোহান?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘এই রাতে সব প্রত্মাত্বা পৃথিবীর বুকে নেমে আসে। এই রাতে তারা মেতে উঠে বিভৎস সব আনন্দে।’
‘তুমি খুব ভীতু যোহান। তুমি বাড়ি চলে যাও। আমি একণাই যেতে পারবো। এখানে হাটা আমি খুব উপভোগ করবো।’ তারপর আমি গাড়ীর দরজা খুললাম আমার লাঠিটা হাতে নিলাম যা আমি সব সময় ছুটির দিনে হাঁটার সময় সাথে রাখি। তারপর দরজা বন্ধ করলাম। মিউনিখের দিকে ইসারা করে বললাম ‘বাড়ি যাও যোহান; ভালগার্সিসের রাত এক জন ইংরেজকে কিছুই করতে পারবে না।
ঘোড়া গুলো আরো উত্তেজিত হয়ে উঠলো এবং যোহান সেগুলোকে ধরে রাখতে চেষ্টা করলো। সে আমাকে আবার ও অনুরোধ করলো আমি যেন বোকার মতো এ জায়গায় না থাকি। আমি তার দিকে করুনার দৃষ্টিতে তাকালাম। সে তার জার্মান মিশ্রিত ইংরেজিতে আমাকে বললো তাহলে তাই হোক। আমি চলে যাচ্ছি। এই বলে সে তার গাড়ীটাকে মিউনিখের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। এবং সে দিকে যেতে ঘোড়াগুলোকে ইংঙ্গিত করলো। সে ধীরে ধীরে ঘোড়াগুলোকে যেতে বললো, ঘোড়াগুলো যখন ঐ মোড়ের কাছে এসে পৌছালো তখন ঘোড়াগুলো যেন কোন কিছু দেখে ভয়ে লাফিয়ে উঠলো এবং পাগলের মতো মিউনিখের দিকে ছুটলো। এবার আর যোহান ঘোড়াগুলো বাধা দিলো না। দেখতে না দেখতেই তারা আমার চোখের আড়াল হয়ে গেল। আমি ঐ স্থানে দারিয়ে রইলাম এবং বুঝলাম যোহান চলে গেছে।
এই ভীতু জার্মানটার ব্যবহার আমাকে খুব বিরক্ত করলো। ঠিক করলাম আবার কখনো জার্মানীতে আসলে এ রকম কুসংস্কার গ্রস্থ দের নিয়ে কোথাও যাবো না।
দিনের আলো আস্তে আস্তে কমে আসছিল। আমি সেই রাস্তা ধরে উপত্যকার দিকে চলতে শুরু করলাম। প্রায় দুই ঘন্টার মতো উপত্যকার আশে পাশে ঘুরাঘূরি করলাম। এই সময়ের মাঝে আমার সাথে কোন মানুষের দেখা হলো না এমনকি একটা ঘোড়া বা গরুর দেখাও পেলাম না। আমি বুঝলাম এখান থেকে গ্রামটা অনেক দুরে। এবং আমি এও বুঝতে পারলাম আমি রাস্তাটা হারিয়ে ফেলেছি। বনের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে আমি এক সময় বনের এক প্রান্তে বড় বড় গাছের কাছে চলে এলাম।
আমি বিশ্রামের জন্য গাছের তলায় বসলাম। চারদিকে তাকালাম। হটাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলাম আকাশের মেঘ গুলো দ্রুত গতিতে উত্তর থেকে দক্ষিনে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারলাম অচিরেই আমি তুষার ঝড়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। আমি দ্রুত উঠে দাড়ালাম। আশ্রয়ের খোজে হাটতে শুরু করলাম।
আমি রাস্তা ধরে হাটছিলাম আমি খেয়াল করলাম যে রাস্তা ধরে আমি হাটছি সে স্থানটা অনেক সুন্দর। অনেক বেশি সুন্দর। যায়গাটা অনেক বেশি নিরব কিন্তু অদ্ভূত সৌন্দর্য মন্ডিত। আমি দ্রুত পায়ে রাস্তা ধরে হাটছিলাম একটু আশ্রয়ের আশায়। দিনের উজ্জলতা আস্তে আস্তে কমে আসছিল। বাতাস এখন আগের থেকে অনেক শীতল রুপ ধারন করেছে। বাতাস আস্তে আস্তে আরো জোড়ে বইতে শুরু করলো এবং এর ফলে চারপাশ থেকে বিভিন্ন ভীতিকর শব্দ ভেসে আসতে শুরু করলো। এই শব্দ গুলো আমাকে ভয় পায়িয়ে দিচ্ছিল নেকড়ের ডাকের মতো করে। আমি যোহানের বর্নীত সেই গ্রামটাকে খুজতে লাগলাম। আমি হাটতে হাটতে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে দাড়ালাম। আমি দেখলাম জায়গাটা বড় বড় গাছ দিয়ে ঘেড়া। আমি সেই রাস্তাটাকে দেখলাম যেটা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম।
আমি দেখলাম আস্তে আস্তে তুষার পাত শুরু হয়ে গেছে। মাইলের পর মাইল হেটে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম একটু আশ্রয়ের আশায়। আকাশ ধীরে ধীরে কালো থেকে আরো কালো হচ্ছে। আমার চারদিকে তুষার পরে ধীরে ধীরে আরো সাদা হয়ে উঠলো আমার চারপাশ। আমি সেই রাস্তা ধরে দৌড়াতে শুরু করলাম। রাস্তাটা ভালো দেখালেও রাস্তাটা ছিল গর্তে পরিপূর্ন। কয়েকবার আমি রাস্তার উপর পড়ে গেলাম। ধীরে ধীরে বাতাস আরো রূদ্র রূপ ধারন করলো। বরফ ঠান্ডা বাতাসে আমি একেবারে অসহায় হয়ে। বাতাস ও তুষারের কারনে আমি আমার চোখ খুলতে পারছিলাম না। মাঝে মাঝে বজ্র পাতের কারনে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আমি এক বিশাল সাইপ্রেসের বনের মাঝ দিয়ে হেটে চলছি।
আমি একটা বড় গাছের গোড়ায় আশ্রয় নিলাম। সেখানে ছিল এক অদ্ভুত নিরবতা। শুধু শোনা যাচ্ছিল ঝড়ের তান্ডব। কিছু ক্ষন পরই ঝঢ়ের আওয়াজ ছাপিয়ে আমি ধুনতে পেলাম নেকড়ের ডাক। এই ডাক শুনে আমার মেরুদন্ড বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত নেমে গেল। আমার মনে হলো নেকড়ে গুলো আমার আশে পাশেই কোথাও ডাকছে।
মেঘের ফাক দিয়ে মাঝে মাঝেই চাঁদের আলো বের হয়ে আসছিল। এসময় আমি দেখলাম আমি সাইপ্রেস গাছের বনের এক ধারে এসে দাড়িয়েছি। আমার চারদিকে তুষারের স্তুপ জমে গেছে। আমি একটু মাথা গোজার আশ্রয়ের জন্য চারদিকে খোজ করতে লাগলাম। গ্রামটাতে কোন জনমানুষের চিন্হ দেখলাম না আমি। চারদিকে ভাঙ্গাচোড়া ঘর বাড়ি সময়ের সাথে যুদ্ধ করে দাড়িয়ে রয়েছে। এক সময় আমি একটা নিচু দেয়াল খুজে পেলাম। মনে মনে আসস্থ হলাম যে শেষ পর্যন্ত একটা আশ্রয় তাহলে পেলাম। দেয়াল ধরে ধরে আমি বাড়ীটার প্রবেশ মুখের সামনে এসে পড়লাম। আমি দেখলাম এর দরজাটা খোলা। আমি বাড়ীটাতে ঢুকে পড়লাম। অন্ধকারের ভীতর আমি কিছু দেখতে পারছিলাম না। যেতে যেতে অবশেষে আমি একটা দরজা খুজে পেলাম। আমি দরজায় হেলান দিয়ে দাড়ালাম। সেই সময় আমি চাঁদের আলৌতে দেখতে পেলাম আমি একটা কবরস্থানের ভীতরে দাড়িয়ে আছি। কবরস্থানটা মার্বেল পাথরের স্মৃতি ফলক দিয়ে ভরা। সাদা তুষারের মাঝে আমার মনে হলো এগুলো কবরস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাতাসের একটা ঝাটটা আমার উপরে এসে পড়লো। আমি মার্বেল পাথনে মোড়া স্মৃতিসৌধের কাছে গেলাম। স্মৃতিসৌধের দেয়াল ঘেষে দাড়ালাম। আমি খুব কাছেই নেকড়ের ডাকের শব্দ পেলাম। আমি খুব ভয় পেলাম। নেকড়ের ডাকের ভয় কবরের ভয় থেকে বেশি মনে হলো আমার। আমি কবরটার কাছে চলে গেলাম। দেখলাম স্মৃতিসৌধের দরজার ফলকে জার্মান ভায়ায় লেখা আছে
স্টাইরিয়ার গ্রাৎসের কাউন্টেস ডলিংগান তার প্রার্থীত মৃত্যুকে পেয়েছেন ১৮০১ সালে।
একটু দূরে এসে আবার স্মৃতি সৌধের উপরে দেখলাম একটা বিশাল পাথরের তৃশুল দিয়ে কবরটাকে চাপা দেয়া হয়েছে। ওই জায়গায় দেখলাম লেখা আছে
মৃতরা দ্রুত চলে
আমার মনে হলো এখানে এমন কিছু আছে যা আমার ভাবার বাইরে। এবং জিনিসটা খুবই আতঙ্কজনক। এবার আমার মনে হলো যোহানের উপদেশটা গ্রহন করলে খারাপ হতো না। এখানে আমি প্রচন্ড ভয় পাচ্ছি। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমার চারপাশে সব আতঙ্কজনক জিনিস ঘোরা ফেরা করছে। আমি ভাবলাম আজ ভালগার্সিসের রাত।
ভালগার্সিসের রাতে মানুষ মনে করে এই রাতে পৃথিবীর সব কবরের দরজা খুলে যায়। মৃতরা কবর থেকে উঠে আসে। তারা পৃথিবীতে হাচে, নৃত্য করে। শয়তানে ভরপুর হয়ে যায় পুরো পৃথিবী। তারা মেতে উঠে বিভৎস আনন্দে। আমি আস্তে আস্তে ভয় পেতে শুরু করলাম। খেয়াল করলাম আমি যে স্থানে দ্বারিয়ে আছি তা জন মানব শুন্য। এখানকার শেষ মানুষটিও এ স্থান ত্যাগ করেছে ১০০ বছর পূর্বে। আমার সামনে আছে একটা স্মৃতিসৌধের সামনে যার বাসিন্দা একজন আত্মহত্যা কারী। এরকম একটা স্থানে আমি দ্বারিয়ে আছে একা, চারপাশে সাদা তুষার মাঝে। এই সময় তার যুক্তিবাদী মন আমার নাথে প্রতিবাদ করে উঠলো। সব ভয় কে তাড়াতে চেষ্টা করলাম।
সহসা আমার উপর একটা ঘুর্নি বার্তা এসে পড়লো। আমার কাছে মনে হলো অনেকগুলো ঘোড়ার খুড়ের আঘাতে পৃথিবী কেপে উঠছে। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় আমি কেপে উঠলাম। ছাইপ্রেস গাছের তলে কিছুক্ষন দাড়ালাম কিন্তু সেখানে বেশিক্ষন দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। আমার কাছে মনে হলো সেখান অপেক্ষা কবরস্থানের মাঝে ঐ স্মৃতিসৌধের ঘরটাতেই আশ্রয় নেয়াই নিরাপদ। ভারি ব্রোঞ্জের তৈরি দরজার সামনে গিয়ে দাড়ালাম আমি। ওটাতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইলাম।
আমি দরজাতে হেলান দিয়ে দারানোর ফলে দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল। ঘরটা যেন আমাকে আমন্ত্রন জানাচ্ছিল ভেতরে প্রবেশ করারজন্য এবং আমি ঘরটার ভিতরে প্রবেশ করলাম ঠিক সেই সময় বিদ্যু চমকে উঠলে ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠলো। আমি দেখলাম ঘরের মাঝে পাথর দ্বারা চাপা দেওয়া এক সুন্দরী যুবতী শুয়ে আছে, যুবতীর মুখের দুই দিকে দুটি তীক্ষ্ন দাত বের হয়ে রয়েছে এবু তার ঠোঁট রক্তের মতো লাল হয়ে আছে। সেই সময় ঝড়ো বাতাসে দরজাটা খুলে গেল এবং আমাকে ঘরের ভেতর আছড়ে ফেললো। আমি আহত হলাম এবং সেই সাথে আমার ভয়টাও আস্তে আস্তে ফিরে আসতে থাকলো। আমি অনুভব করলাম ঘরে আমি ছাড়াও আরো কেউ আছে। আমি আবার সেই যুবতীর দিকে তাকালাশ। সে সেই ভাবেই শুয়ে আছে। সেই সময় একটা বজ্রপাত হলো ঘরটার ছাদে আটকানো ত্রিশুলটা তে। বজ্রপাতের বিদ্যু ত্রিশুল বেয়ে যুবতীর উপরের পাথরের উপর আঘাত হানলো যার ফলে ঐ পাথরটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল এবং সেই মৃত যুবতীটি চিৎকার করে উঠলো। আমি বুঝতে পারলাম আমি ঞ্জান হারাতে চলছি আবং ঞ্জান হারানোর আগ মূহূর্তে আমার মনে হলো কি যেন আমার গলার উপর ঘসছে। সেটা উষ্ণ ও ধারালো।
কিছুক্ষন পরই আমি ঞ্জান ফিরে পেলাম। আমি প্রথমে কিছুই মনে করতে পারলাম না। আমি ধীরে ধীরে সব মনে করতে পারলাম। আমি আমার পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম এবং পা নাড়াতে পারলাম না। আমি আমার পিঠের নিচে তুষারের অস্তিত্ব খুজে পেলাম। এবং সেই সাথে এটাও বুঝলাম আমার শরীরের উপর ওজনদার একটা কিছুর উপস্থিতি। যার কারনে আমি শ্বাষ নিতে পারছিলাম না। আমার কাছে এটাকে একটা বেশ বড় নেকড়ে মনে হলো। আমার গলায় নেকড়েটার জিহ্বা অনুভব করলাম। এর লালা আমার গলা বেয়ে পড়ছে। আমি আবার ঞ্জান হারালাম। মেঘ আবার আকাশের চাঁদকে ঢেকে দিলো। আমি বুঝতে পারলাম আমি নরকের দিকে যাত্রা করছি।
এমন সময় আমি দুরে থেকে মানুয়ের আওয়াজ শুনলাম। তারা হৈ হৈ করতে করতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি মাথা তুলে তাদের দেখতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কবরের ফলক আমার দৃষ্টির মাঝে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। নেকড়েটা আমার গলা চেটেই যাচ্ছে। যখন মানুষের গলার আওয়াজ কাছে এসে পরলো তখন নেকড়েটা আরো দ্রুত আমার গলা চাটতে লাগলো। এমন সময় সাইপ্রেস গাছের আড়াল থেকে লাইট হাতে এক ঘোড়সওয়ার উদয় হলো। নেকড়েটা লাফিয়ে আমার বুক থেকে সরে গেল। কবর ফলকের উপর দিয়ে লাফিয়ে সে বনের দিকে ছুটলো। ঘোরসওয়ার(পরে জেনেছি সৈন্য) তার হাতের তীর তুলে নেকড়েটাকে উদ্টদেশ্য করে তীর ছুড়লো। কিন্তু তা নেকড়েটাকে আঘাত করতে ব্যর্থ হলো। নেকড়েটা সাইপ্রেস গাছের বনের মাঝে হারিয়ে গেল।
আমি আবার ঞ্জান হারালাম। দুইজন সৈন্য আমার পাশে এসে দাড়ালো। একজন তারমাথা আমার বুকে ঠেকিয়ে আমার হৃদস্পন্দন শোনার চেষ্টা করলো। সে চিৎকার করে বললো, ভাল সংবাদ কমরেডস। সে এখনো বেঁচে আছে। আধার আর আলোর খেলা চলছে চারদিকে। আমি আস্তে আস্তে ঞ্জান ফিরে পাচ্ছিলাম। আমি শুনতে পেলাম আক জন আরেক জনকে প্রশ্ন করছে নেকড়েটার ব্যাপারে। তারপর তারা আমার কাছে এসে দাড়াল। ক্যাপ্টেন সৈনিককে প্রশ্ন করলো নেকড়েটাকে পাওয়া গেছে নাকি। সৈনিক বললো, না পাওয়া যায় নি। এর পর সৈনিক বললো স্যার, এখান থেকে দ্রুত চলে যাই চলুন। এই রাতে এখানে থাকা ঠিক হবে না।
এক সৈনিক বললো ওটা কি আসলেই নেকড়ে ছিল নাকি অন্য কিছু।
ক্যাপ্টেন বললও, হ্যা ওটা নেকড়েই ছিল। শুধুই নেকড়ে অন্য কিছু না।
এরপর যে সৈনিক সবার আগে এসে উপন্থিত সে বললো, নেকড়েটা ভদ্রলোকের উপরে বসে তার গলা থেকে রক্ত চুসছিল। দেখুন তো ওখানে কোন ক্ষত আছে কিনা।
একজন সৈনিক আগিয়ে এসে আমার গলা পরীক্ষা করে বললো না, এখানে কোন ক্ষত নেই।
ক্যাপ্টেন সব সৈনিকদের উদ্দৈশ্য করে বললো, অবশেষে আমরা তাকে উদ্ধার করেছি। তার গলায় কোন কামড়ের দাগ নেই। সে সম্পূর্ন সুস্থ আছে।
কিন্তু আমরা তো তাকে নেকড়ের নিচে থেকে উদ্ধার করেছি। এক সৈনিক বললো।
ক্যাপ্টেন বললো সেটা কোন বিষয় না। সে নেকড়ে দ্বারা আহত না এবং তাকে উদ্ধার করার জন্য আমরা বিশেষ উপহার পেয়েছি। তাই এটা কোন ব্যাপার না।
ক্যাপ্টেন সৈনিকদের আদেশ করলো ভদ্রলোককে গাড়িতে তোলো এবং দ্রুত এই অভিসপ্ত স্থান পরিত্যাগ করো।
তারা আমাকে দ্রুত ঘোড়াতে তুলে নিলো, এবং ঝড়ের বেগে মিউনিখের নিকে ছুটে চললো। আমার পিছনে সা্ইপ্রেসের বন পড়ে রইলো।
সৈনিকরা আমাকে দ্রুত তাদের ব্যারাকে নিয়ে গেল।
সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গে। সেখানে আমার তেমন কিছু মনে পরছিল না। আমার ঘুম ভাঙ্গার পর সৈনিক দলের ক্যাপ্টেন আমার সাথে দেখা করে। আধো জার্মান আধো ইংরেজিতে সে আমার বর্তমান শরীরের অবস্থা জিঞ্জাসা করে। আমি ইতিবাচক উত্তর দেই। আস্তে আস্তে কালকের রাতের প্রসঙ্গে কথা বলি আমরা। আমি প্রথমে বলি আমি কুকুরের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। কিন্তু ক্যাপ্টেনের সাথে থাকা এক সৈনিক বললো, না সেটা কুকুর না। সে উত্তেজিত হয়ে বললো সেটা ছিল একটা নেকড়ে।
ক্যাপ্টেন সৈনিককে ধমক মেরে বলল্র, না ওটা নেকড়ে না, ওটা কুকুর।
সৈনিক একটু প্রতিবাদের স্বরে বলতে চাইলো না স্যার ওটা নেকড়ে।
ক্যাপ্টেন বললো আমি বলছি ওটা কুকুর।
সৈনিক অনেকটা বাধ্যের মতো মাথা নাড়ালো।
ক্যাপ্টেন রুম থেকে সবাইকে বের হয়ে যেতে বললো, সবাই বেড় হয়ে গেলে রুমে শুধু আমি আর ক্যাপ্টেন রইলাম। ক্যাপ্টেন আমাকে জানালো যে, কাল রাতে আমার গাড়ি চালক যোহান রাতে পাগলের মতো ঘোড়ার গাড়ি ছুটিয়ে মিউনিখে যেয়ে আপনি যে হোটেলে ছিলেন সে হোটেলের মালিক হের্ ডেলব্রককে রিপোর্ট করে। সেখান থেকে হের্ ডেলব্রক বেরাকে খবর পেয়ে সৈনিকরা আমাকে উদ্ধার করে।
এর পর ক্যাপ্টেন আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমাকে উদ্ধার করার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ জানালাম।
এরপর রুমে প্রবেশ করলেন মিউনিখে আমি যে হোটেলে ছিলাম সেই হোটেলের মালিক হের্ ডেলব্রক।
প্রথমে সে আমার কুষুল জিঞ্জাসা করলো। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম সে আমার অবস্থান কিভাবে বুঝতে পারলো। আর কিভাবেই সে সৈনিকদের আমার অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারনা দিতে পারলো।
সে হেসে বললো, যোহানের কাছ থেকে খবর পেয়ে আমি বুঝতে পারি আপনি বিপদে পরেছেন, তাই সে অনুযায়ী আমি মিউনিখ রেজিমেন্টের সদরে রিপোর্ট করি এবং সৈনিকদের সেখানে পাঠাই।
কিন্তু আপনি কিভাবে বুঝলেন যে আমি পথ হারিয়েছি? আমি প্রশ্ন করলাম।
কিন্তু সে এর কোন সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললো, আমি অনুমান করেছিলাম।
কিন্তু এই অনুমানে আপনি তো ব্যারাক থেকে সৈন্য পাঠাতে পারেন না আর সেটা সম্ভবও নয়।
সে বললো, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু যোহান পৌছানোর পর আপনি যির অতিথি ছিলেন তসে আমাকে একটা টেলিগ্রাম পাঠায় আপনার বিপদ সম্পর্কে। সেটা এখনোও আমার পকেটে আছে। এই যে সে টেলিগ্রাম।
ডেলব্রক,
আমার অতিথি সম্পর্কে তোমার আরো যত্নবান হওয়া উচিত ছিল। তার নিরাপত্তা আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ন। তার যদি কোন ক্ষতি হয় তা হলে আমার কাছে সে জন্য তুমি দায়ী থাকবে। যেহেতু সে ইংরেজ, তাই সে একতটু অভিযান প্রিয়ও বটে। তাই সে তুষার আর নেকড়ের মাঝে বিপদে পড়েছে। এক মুহুর্ত দেরী না করে তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করো, যদি তুমি ব্যর্থ হও তা হলে সে জন্য তুমি ব্যক্তিগত ভাবে দায়ী থাকবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে তোমাকে শাস্তি দিব।
কাউন্ট ড্রাকুলা
আমি টেলিগ্রামটা পড়ে হতবাগ হয়ে গেলাম। আমার মনে হলো বেরাকের এই রুমটা আমার চারদিক থেকে ছোট হয়ে আসছে। আমার মনে হলো আমি কোন অতল খাদে পড়ে যাচ্ছি। আমার মনে হলো এখানে এমন কিছু রয়েছে যা অনেক ভীতকর, বিপদজনক এবং আমাদের জানাশোনা পৃথিবীর বাইরে।
(ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলাস গেস্টের অনুবাদ)