somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের ৯ম পর্ব

২৭ শে জুন, ২০২০ সকাল ১১:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এর আগে ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাসের ৮টি পর্ব দিয়েছি। আজ দিচ্ছি ৯ম পর্বঃ
.
প্রতি রাতে, একই দুঃস্বপ্ন বারবার দেখে থিও... ওর বাবার হাত ওর কাছ থেকে ছুটে যাচ্ছে, গুঁড়ো গুঁড়ো ইটের ধূলিকণায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে ওর ফুসফুস। সে এর লজ্জা এবং অপমানে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওর বাবা-মায়ের নৃশংস মৃত্যুর কোনো বিচার পায়নি সে। এখন সে শুধু একটা জিনিসই চায়। এই অবিচারের প্রতিশোধ।
ওদেরকে বহনকারী নৌকাটি জাহাজ-ঘাটায় দুম করে আঘাত হানল। সিঁড়ির একদম শীর্ষভাগে পৌঁছাতেই জনতার হৈ-হট্টগোলে ওদের মাথাটা একদম খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হল। ব্যবসায়ী এবং স্বজনদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন আত্মীয়-স্বজনেরা জাহাজের যাত্রীদের কাছে নানান খবরাখবর জানতে চাইছিলেন। কুলি, হকার এবং একদল পতিতা তাদের সেবা নেয়ার জন্য সাধাসাধি করছে। পতিতাদের দেখে থিও ওর শরীরটাকে সংকুচিত করে কিছুটা পিছিয়ে গেল।
একজন মানুষ জনতার মাঝ দিয়ে ভিড় ঠেলতে ঠেলতে ওদের কাছে এগিয়ে এল। লোকটা লম্বা এবং সুদর্শন, এলেমেলো চুল, চলাফেরায় আত্মবিশ্বাস ফুটে বের হচ্ছে। চারপাশের সবাই একে অপরকে কনুই এং কাঁধ দিয়ে ক্রমাগত ধাক্কা মেরেই যাচ্ছে, কিন্তু এর মাঝেও সে এতটাই স্বচ্ছন্দ এবং চেহারাতেও নির্মল একটা হাসি মেখে রেখেছে, যেন এই পরিস্থিতিটা সে দারুণভাবে উপভোগ করছে। সে নিজের পথ করে নিয়ে সরাসরি থিও আর কন্সট্যান্সের কাছে চলে এল।
"হেই, কাজিন!" সে আনন্দিত ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠল। কন্সট্যান্সের গালে চুমু খেল সে এবং একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওর দিকে। তার চোখজোড়া হালকা বাদামী রঙয়ের, সবুজাভ কিছু বিন্দু আছে এবং ভারতীয় সূর্যের তলায় খুব বেশি পরিমাণে চলাফেরা করার কারণে চোখের প্রান্তগুলো কুঁচকে গেছে।
"আন্দাজ করছি, তুমিই আমাদের কাজিন জেরার্ড।" কন্সট্যান্স বলল।
"যেই পরিস্থিতিটা আমাদেরকে একত্র করেছে, বা, বলা যায়, আমরা একত্র হতে বাধ্য হয়েছি, জাস্ট মুখের কথায় আমি আমার মনের দুঃখ প্রকাশ করতে পারব না।" সে কোমল কণ্ঠে বলল, কিন্তু কথাটা এত জোর দিয়ে বলল যে, চারপাশের হৈ-হল্লার মাঝেও ওর বলা ওই কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে কানে বাজল। মনে হল ডেক-এর ওপরে যেন আর কেউ নেই, ওরা সেখানে একলা। কন্সট্যান্সের চোখে আপনা হতেই অশ্রু জমা হতে শুরু করল। চোখের পলক ফেলে অশ্রুটা মুছে ফেলার আগেই, জেরার্ড আলতো করে সেটাকে মুছে দিল। "আমি বুঝতে পারিনি যে, তুমি কতটা বড় হয়ে গিয়েছ," সে বলল। জেরার্ডের চোখজোড়া মনে হচ্ছিল যেন কন্সট্যান্সকে আলোর বন্যায় স্নান করিয়ে দিচ্ছে, যেটা কিনা সুর্যের আলোর মতোই উষ্ণ।
এটা হয়তো উত্তাপের কারণে ঘটছে, অথবা বেশ কয়েক সপ্তাহ সমুদ্রের ওপরে ভেসে হঠাৎ মাটিতে পা ফেলার মানসিক ধাক্কার কারণে, অথবা, পরিবার এবং পুরনো জীবন হারিয়ে ফেলার ক্ষতি, যা পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব, সেই কারণে ঘটছে। কিন্তু কী কারণে কে জানে, হঠাৎ করেই কন্সট্যান্সের মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল। ওর চারপাশের দুনিয়াটা বনবন করে ঘুরতে লাগল, আঁধার ঘিরে ফেলতে চাইল ওর দৃষ্টিশক্তিকে, ওর কাছে মনে হচ্ছিল ও যেন জ্ঞান হারাবে।
জেরার্ড এরপরে কন্সট্যান্সের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে থিওর দিকে ঘুরল, আর তাতেই কন্সট্যান্সের দুনিয়াটা আবারও আগের জায়গায় ফেরত এল। মেঘগুলো সরে গেল এবং পায়ের তলার মাটিটা আবারও ফিরে এল স্থিতিশীল অবস্থায়।
"তুমি নিশ্চয়ই থিও।" জেরার্ড ওর সাথে হ্যান্ডশেক করল, জেরার্ড ওর সাথে দৃঢ়তার সাথে হ্যান্ডশেক করল। আনুষ্ঠানিক ভঙ্গিতেই করল কাজটা। "আমার সাথে আসো।"
ওদের বাক্স-পেটরা বহন করার জন্য দুই ডজন নেটিভ কুলি তখন ওদের পেছনেই ছিল। জেরার্ড কন্সট্যান্সকে সাধাসাধি করল একটা সেডান চেয়ার নেয়ার জন্য। কিন্তু কন্সট্যান্স চেহারায় একটা বিনয়ী হাসি মেখে জেরার্ডের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করল। "ওই জাহাজে এতদিন কাটানোর পর, এবার মানুষের ভিড়ের মাঝে হাঁটতে আমার কাছে ভালোই লাগবে।"
ওরা একত্রে মিলে হাঁটতে লাগল। থিও কলকাতা শহরটিকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। যদিও বয়স হিসেব করলে মাদ্রাজের তুলনায় এটি অনেক তরুণ, কিন্তু কলকাতা শহরটা এরিমাঝেই সবদিক দিয়ে মাদ্রাজের তুলনায় আরও বৃহৎ, আরও সমৃদ্ধ। ওখানকার চেয়ে এখানকার বাড়িগুলো আরও চমৎকার, বাগানগুলো আরও সম্প্রসারিত। এমনকি কলকাতার রাস্তাগুলোও মাদ্রাজের তুলনায় আরও ব্যস্ত, যেটা কিনা থিও আগে সম্ভব বলে ভাবেনি। থিও বুঝতে পারছে, এই শহরটা এখনও পুরোপুরি বিকাশ-লাভ করেনি। এটি এখনও একটি প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে। এখানে প্রচুর বিল্ডিং আছে, যেগুলো অর্ধনির্মিত বা এর অর্ধেকটা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে, যাতে নতুন করে আরও চমৎকার কোনো ডিজাইন দেয়া যায়। এই শহরটার মধ্যে একটা অস্থির, তারুণ্যসুলভ এনার্জি স্পন্দিত হচ্ছে, যেটা পরিণতবয়স্ক মাদ্রাজ বহু আগেই পেরিয়ে এসেছে।
জেরার্ড ওদেরকে চওড়া রাজপথের ওপরে অবস্থিত একটি বিশাল অট্টালিকায় নিয়ে এল। এই অট্টালিকা শহরের একপ্রান্তে অবস্থিত। গাঢ় লাল রঙয়ের পাগড়ি পরহিত একজন দারোয়ান, যার কোমরের এক পাশে তরবারি গুঁজে রাখা, সে খটাং শব্দ করে ভীষণ উঁচু দ্বৈত-দরজাটা খুলে ফেলল। তিনজন ভৃত্য হাজির হয়ে গেল সাথে সাথে, তারা প্রত্যেকে বহন করছে এক গ্লাস শরবত, অন্যদিকে বিভিন্ন খানসামা এবং খুচরা ফাইফরমাশ খাটা লোকেরা উর্ধ্বতনের নানান আদেশ-নিষেধ, হুকুম-ধাকুমের মাঝে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছোটাছুটি করছে।
"আমার বাসগৃহে তোমাকে স্বাগতম," জেরার্ড বলল। কন্সট্যান্সের হাতটা নিজের হাতে তুলে নিল সে। "আশা করছি তুমি আমার এই বাসাটিকে নিজের বাসার মতোই আপন করে নেবে।"
"আমি তোমার পরিবারের লোকদের সাথে দেখা করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।" কন্সট্যান্স বলল।
এই কথায় জেরার্ডের চেহারা যন্ত্রণাকাতর হয়ে উঠল। "দুঃখিত। তোমাকে নিরাশ করতে হচ্ছে। আমার মা কয়েক বছর আগে গত হয়েছেন। আর, আমার বাবা, তোমরা হয়তো জানো, তিনি লন্ডনে গিয়ে লর্ডসে তার আসনগ্রহণ করেছেন। আমার দুটো বোন আছে, কিন্তু ওদের বিয়ে হয়ে গেছে এবং ওরা অনেক দূরে থাকে।"
"তুমি একলা একলা এত বড় বাড়িতে থাকো?" থিও বিস্মিত।
"এখনও পর্যন্ত আমি একলাই থাকি।"
"তোমার বয়স কত?"
জেরার্ড উচ্চস্বরে হাসল। "পঁচিশ। তুমি ভাবছ এত বড় এস্টেট সামলানোর জন্য আমার বয়সটা অনেক কম হয়ে যায়। হয়তো তোমার ভাবনা ঠিক। কিন্তু এই শহরে জীবনটা অনেক দ্রুতগতিতে বয়ে চলে। সময় এত সংক্ষিপ্ত যে অন্য কিছু করার সুযোগ নেই। এক লহমার মধ্যে তুমি প্রচুর পরিমাণে ধন-দৌলত অর্জন করতে পারো, আবার সেটা খুইয়েও বসতে পারো।"
"তা এখানে কোনো মিসেস কোর্টনি নেই?" কন্সট্যান্স অনুসন্ধিৎসু ভঙ্গিতে জানতে চাইল।
"হায়, ঈশ্বর। না, নেই।"
"আর তোমার প্রেমিকা বা গোপন পরিণয় করা হয়, এমন কোনো মেয়ে নেই তো, যে কিনা আমাদেরকে সব সময় চাপের মাঝে রাখবে?" মেয়েটি প্রশ্ন করল। "কারণ, আমাদেরকে যদি তোমাদের বাড়ির ছাদের তলায় থাকতেই হয়, আমাদের জানতে হবে, আমরা কোনো কুখ্যাত লম্পটের ডেরায় পা দিয়ে ফেললাম কিনা।" কন্সট্যান্সের চোখজোড়া দুষ্টুমিতে ঝিকমিক করে উঠল।
জেরার্ড দাঁত বের করে একটা হাসি দিল, কৌতুকটাকে সে নিজেও অংশ নিচ্ছে। "যদি তুমি আশা করে থাকো, আমার ব্যাপারে একটা নারীঘটিত স্ক্যান্ডাল উদঘাটন করে ফেলবে, আমার মনে হয় তোমাকে নিরাশ হতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণ সামাজিক মর্যাদা আছে, এরকম উপযুক্ত-বয়স্কা ইংরেজ লেডি কলকাতায় আছে হাতেগোনা অল্প কয়েকজন। কিন্তু ব্যবসার কাজে আমাকে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে, গায়ে স্যুট চাপানোর মতন সময়ই আমি বের করতে পারি না।" জেরার্ড চমৎকারভাবে ডিজাইন করা সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উঠতে শুরু করল, সিঁড়ির পাশের দেয়ালে তার পূর্বপুরুষদের পোর্ট্রেট লাইন ধরে ঝুলিয়ে রাখা। "বিয়ে করার জন্য আমার কোনো তাড়া নেই। সত্যিকারের ভালোবাসা আমায় খুঁজে নেবে, সেই অপেক্ষাতেই দিন গুজরান করছি আমি।"
সে একটা দরজা খুলল। দেখা গেল, তিনজন দাসী নতজানু হয়ে নমস্কার করার ভঙ্গিতে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। "তো, কন্সট্যান্স, এই হচ্ছে তোমার রুম। আমি তোমার অনুমতি না নিয়েই তোমার জন্য কয়েকজন দাসী নিয়োগ দিয়েছি, সেজন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে, ওদের কাজে তুমি যদি সন্তুষ্ট না হও, আমি তোমার জন্য অন্য দাসীর ব্যবস্থা করব।"
"তুমি মানুষ হিসেবে খুবই দয়ালু," কন্সট্যান্স অস্ফুটস্বরে বলল। সে বিশালাকৃতির রুমটিতে প্রবেশ করল। রুমটির মেঝে আবৃত হয়ে আছে দামী কার্পেট দিয়ে, এছাড়াও আছে সেগুন কাঠ-নির্মিত আসবাবপত্র। দেয়ালে ঝুলছে ঘরের শোভাবর্ধন করে এমন সব জিনিসপাতি। ঘরের মধ্যে যাতে প্রচুর পরিমাণে বাতাস খেলা করে, তার জন্য উঁচু উঁচু জানালা লাগানো হয়েছে। ওই জানালার গায়ে আবার চন্দনকাঠ খোদাই করে বানানো পর্দাও আছে। টানা কয়েক সপ্তাহ একটা খুপরি ঘরের মধ্যে ক্ষুদ্রাকৃতির বিছানায় ঘুমানোর পরে, কন্সট্যান্সের কাছে এই ঘরটিকে মনে হচ্ছিল যেন ফুটবলের মাঠের সমান বড়সড় কিছু। শুধু ওই বিছানাতেই তো চারজন মানুষ অনায়াসে পাশাপাশি শুয়ে থাকতে পারবে।
"আমার রুমটা কোথায়?" থিও জিজ্ঞেস করল।
জেরার্ড ওর হাতটা থিওর কাঁধে রাখল। "দুঃখিত। তুমি এখানে থাকছ না।"
"কিন্ত..."
"আমি গভর্নরের সাথে কথা বলে তোমার জন্য বিশেষ বন্দোবস্ত করেছি। তুমি কোম্পানির একজন কেরানী হিসেবে চাকরি করবে। তোমার যা বয়স, তাতে এটা কিছুটা নিয়মবিরুদ্ধ, কিন্তু তোমার বর্তমান পরিস্থিতি এবং পরিবারের সুনামের কারণে, আমি ওদেরকে তোমার বিষয়টা বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। এই দুর্গের ভেতরেই কেরানীদের থাকার কেবিন আছে। সেখানেই তুমি অন্যান্য ব্লু-কোটধারী ছেলেদের সাথে থাকবে।"
"কিন্তু আমি এখানেই থাকতে চাই," থিও ওর কণ্ঠে জেদ নিয়ে বলল। "আমি কনির সাথে থাকতে চাই।" সে চোখে মিনতিপূর্ণ দৃষ্টি ফুটিয়ে বড় বোনের দিকে তাকাল।
"থিও, আমাদের কাজিন যা বলছে সেটাই তোর কথা উচিৎ।" কন্সট্যান্স বলল। "এতেই সবচেয়ে ভালো হবে।"
জেরার্ড থিওর চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে ওগুলোকে এলোমেলো করে দিল। "আমি জানি তোমার অনেক বুদ্ধি। তুমি যদি তোমার ব্যবসায়িক বুদ্ধিকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারো, আমি নিশ্চিত তুমি খুব শীঘ্রই এমন একটা বিলাসবহুল বাড়ি বানাতে পারবে, যেটার সামনে দাঁড়ালে আমার এই বাড়িটাকে স্রেফ একটা কুঁড়েঘর বলে মনে হবে।"
"কিন্তু আমি তো এখানে থেকেই দুর্গের ভেতরে কাজ করতে পারি। তাই না? এটা তো তেমন কোনো দূরত্বই না।" জানালার মাঝ দিয়ে, সে গ্রীক স্টাইলে নির্মিত গভর্নরের বাড়ির সম্মুখভাগ দেখতে পাচ্ছিল। ওই বাড়িটা বলতে গেলে এখান থেকে প্রায় ঢিল ছোঁড়ার দূরত্বে।
"দেখো, থিও। এটা স্রেফ কাজ শেখার ব্যাপার না। অন্যসব কেরানীদের সাথে একত্রে থাকলে তুমি ওদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে পারবে। তুমি ওদের সাথে সম্পর্ক এবং বন্ধুত্ব করতে পারবে, যা পরবর্তীতে তোমার ক্যারিয়ারে এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে দেখা দেবে।"
"তোর ওখানেই যাওয়া উচিৎ, থিও।" কন্সট্যান্স বলল। সে খুব আগ্রহের সাথে চাইছে, ওর ভাই যেন নিজের ক্যারিয়ারকে সামনে এগিয়ে নেয়ার এই সুযোগটাকে গ্রহণ করে। "আর তুই যেমনটা বললি, এটা তো তেমন কোনো দূরত্বই না। নিশ্চিতভাবেই, আমাদের মধ্যে এত ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ হবে যেন আমরা একই বাড়িতে থাকি।"
থিওর চেহারায় আঁধার নেমে এল। অন্যদিকে মুখ ঘোরাল সে। ওর চিন্তা-ভাবনা সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সে দরজার ফ্রেমে লাথি মারল, চেষ্টা করছে নিজের মাথার মধ্যে প্রচণ্ড ক্রোধে তর্জন-গর্জন করতে থাকা দানবটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে। সে চায় কনির সাথে থাকতে। সে বাবাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে সে ওর বোনকে সবসময় বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবে এবং ওর বোন-ও ওকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে সে কখনও ভাইকে ছেড়ে যাবে না। কিন্তু এখন এটা কী হল? থিওর মনে রাগ দানা বাঁধতে শুরু করল। ওর বাবা এবং মাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিশোধের নেশায় পুড়ছে ওর হৃদয়। একজন কেরানী হিসেবে জীবনযাপন করার আইডিয়াটিকে ওর কাছে বিদ্রুপ বলে মনে হচ্ছিল।
"ঠিক আছে। তাহলে আমি আর্মিতে যোগ দেব।" সে বলল।
"ওটা করতে যেয়ো না। ওটা একজন ভদ্রলোকের ছেলের জন্য উপযুক্ত জায়গা না।" জেরার্ড ওকে সতর্ক করল।
"অন্য মানুষের দৃষ্টিতে ভদ্রলোক হওয়া না হওয়ায় আমার কিছু যায় আসে না। আমি ফরাসীদের সাথে লড়াই করতে চাই।"
"আমি যা যা বলব, তুমি তাই তাই করবে," জেরার্ডের বন্ধুত্বপূর্ণ হাবভাব হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল। ওর কণ্ঠস্বর এখন রূঢ় এবং কর্কশ।
কিন্তু থিও হার মেনে নিল না। "তুমি আমাকে কিছুতেই থামাতে পারবে না।"
"তুমি এখন আমার হেফাজতে। আমার কথা তোমাকে মেনে চলতেই হবে।"
"আমি ওখানে গিয়ে স্বেচ্ছায় সৈনিক হব।"
"আর্মির কমান্ডার হচ্ছে কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট," জেরার্ড বলল, ওর চেহারায় নির্মম হাসি। "সে তোমাকে আর্মিতে নিতে রাজী হবে না।"
থিও কন্সট্যান্সের দিকে তাকাল। ওর বোনটা কিভাবে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে? হাতপাখা দিয়ে নিজেকে ক্রমাগত বাতাস করেই যাচ্ছে, আর অন্যদিকে ওদের কাজিন ওকে এভাবে শাসিয়েই যাচ্ছে। "আমি তাহলে এখান থেকে পালিয়ে দূরে কোথাও চলে যাব।"
"না। তুমি যাবে না।" জেরার্ড বলল। ওর কণ্ঠস্বর এখন সত্যিকার অর্থেই ভীতি-জাগানিয়া। "কার কাছে যাবে তুমি? পালিয়ে যাবেটা কোথায়? তুমি এখন একজন এতিম। আমার তত্ত্বাবধানে আছ তুমি। আর তোমার কারণে আমাকে যদি অন্য মানুষের কাছে বিব্রত হতে হয়, আমি শপথ করে বলছি, তোমাকে এর জন্য এমন একটা মূল্য চুকাতে হবে, যেটা দেয়ার সামর্থ্য তোমার নেই। তুমি অবশ্যই কোম্পানিতে চাকুরে হিসেবে যোগ দেবে, এবং তোমাকে যেই দায়িত্ব দেয়া হবে, তা ঠিকঠাকমতো পালন করবে। আমার কথা কি তোমার কাছে পরিষ্কার?"
প্রচণ্ড ক্রোধে থিওর ভেতরটা টগবগ করে ফুটছিল। সে নিজের ভেতরে দুর্বার একটা তাড়না অনুভব করছিল জেরার্ডের ওপরে হামলে পড়ার জন্য। সে চাইছিল মারতে মারতে জেরার্ডের ওই অহংকারী চেহারাটাকে রক্তাক্ত করে দিতে। কিন্তু এরপরেই কন্সট্যান্সের কথাটা মনে পড়ে গেল ওর। ওর বোন জেরার্ডের বাড়িতে থাকবে। কন্সট্যান্সের তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে, জেরার্ড কন্সট্যান্সের চলাফেরার ওপরে পূর্ণ-ক্ষমতা ভোগ করবে। থিও জেরার্ডকে যতটা অপমান করবে, জেরার্ড ইচ্ছে করলে তার দশগুণ অপমান কন্সট্যান্সকে করতে পারবে। জেরার্ড কি একটু আগে ঠিক এটাই বুঝাতে চেয়েছিল? যখন সে বলেছিল, "তোমাকে এমন একটা মূল্য দিতে হবে, যেটা দেয়ার সামর্থ্য তোমার নেই।"
কোনো কথা না বলে, থিও ওখান থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল এবং সিঁড়িতে পা ঠুকে ঠুকে নিচে নেমে যেতে লাগল।
"তুমি ওকে অতটা খারাপভাবে নিও না।" কন্সট্যান্স বলল। "এই কয়দিনে যেই পরিমাণ কষ্ট আমাদেরকে সহ্য করতে হয়েছে, সে মানসিকভাবে খুব দুর্বল হয়ে আছে।"
"আরে, না। আমি কিছু মনে করিনি।" জেরার্ড হাসল। "দেখতে পাচ্ছি, সে তোমার প্রতি খুবই বিশ্বস্ত।"
কন্সট্যান্স হাসল। "ভাই হিসেবে ওর দায়িত্বটা ও খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে। সে সবসময় ভাবে যে, আমাকে রক্ষা করাটা ওর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।"
"তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না যে তোমাকে কারুর কাছ থেকে রক্ষা করার দরকার আছে।" জেরার্ড বলল, দুষ্টুমি করার ভঙ্গিতে চোখ টিপল একবার। "কিন্তু এতে করে থিওর ভালোই হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে সে এবং দুনিয়ায় নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নেবে। এই কাজে ব্যস্ত থাকলে ওর অতীতের দুঃখজনক স্মৃতিটা ও ভুলে থাকতে পারবে। আমায় ক্ষমা কর, তুমি হয়তো আমাকে অনুভূতিহীন বলে ভাবছ। কিন্তু, আমাদের দুনিয়ায় ব্যাপারটা এভাবেই কাজ করে।"
"না। আমি তোমাকে মোটেও অনুভূতিহীন বলে ভাবছি না। আমার মনে হয়, তুমি মানুষ হিসেবে খুবই উদারমনা।"
"তুমি এখানে আসায় আমি খুব খুশি," সে কোমল কণ্ঠে বলল। "আমার বাবা খুবই কঠোর মনোভাবসম্পন্ন লোক, এবং যখন থেকে তিনি এই জায়গা ছেড়ে চলে গেছেন আমি অন্য সব কাজ নিয়ে অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছি। এখন এই বাড়িটা মেয়েলি স্পর্শ পেলে ভালোই হবে। আমার জন্য জীবনটা এখন থেকে আরও উপভোগ্য হয়ে উঠবে।"
কন্সট্যান্স তুলোয় ঠাসা ম্যাট্রেসটা আঙ্গুল দিয়ে টিপতে লাগল। হঠাৎ করেই, দুনিয়ার আর সব সমস্যার ভুলে গেল ও। এই তুলোয় ঠাসা ম্যাট্রেসে শরীর ডুবিয়ে দেয়ার চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল ওর মন। "আমিও সেরকমটাই আশা করছি। আমার এই কথায় তুমি হয়তো আমাকে স্বার্থপর ভাববে, কিন্তু আমার মনে হয় জীবনে কিছুটা সুখ এখন আমার প্রাপ্য।"
****

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের প্রথম পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/photo.php?fbid=2985829594796406&id=100001081832019&set=a.422627021116689&source=56

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের দ্বিতীয় পর্বঃ Click This Link

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের তৃতীয় পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3211705148875515&id=100001081832019&_ft_=mf_story_key.3211705148875515:top_level_post_id.3211705148875515:tl_objid.3211705148875515:content_owner_id_new.100001081832019:throwback_story_fbid.3211705148875515:photo_id.3211705005542196:story_location.4:story_attachment_style.photo:thid.100001081832019:306061129499414:2:0:1593586799:5167009495212656913&__tn__=*s-R

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের চতুর্থ পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3213814051997958&id=100001081832019&_ft_=mf_story_key.3213814051997958:top_level_post_id.3213814051997958:tl_objid.3213814051997958:content_owner_id_new.100001081832019:throwback_story_fbid.3213814051997958:photo_id.3213813895331307:story_location.4:story_attachment_style.photo:thid.100001081832019:306061129499414:2:0:1593586799:2041402156577410201&__tn__=*s-R

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের পঞ্চম পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3220982584614438&id=100001081832019&_ft_=mf_story_key.3220982584614438:top_level_post_id.3220982584614438:tl_objid.3220982584614438:content_owner_id_new.100001081832019:throwback_story_fbid.3220982584614438:photo_id.3220982351281128:story_location.4:story_attachment_style.photo:thid.100001081832019:306061129499414:2:0:1593586799:-6887371295566324405&__tn__=*s-R

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের ষষ্ঠ পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3230524416993588&id=100001081832019&refid=17&__tn__=*s-R

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের সপ্তম পর্বঃ

https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3232644440114919&id=100001081832019&refid=17&_ft_=mf_story_key.3232644440114919:top_level_post_id.3232644440114919:tl_objid.3232644440114919:content_owner_id_new.100001081832019:throwback_story_fbid.3232644440114919:photo_id.3232644223448274:story_location.4:story_attachment_style.photo:thid.100001081832019:306061129499414:2:0:1593586799:9210059653702672880&__tn__=*s-R

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের ৮ম পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3238324336213596&id=100001081832019&refid=17&_ft_=mf_story_key.3238324336213596:top_level_post_id.3238324336213596:tl_objid.3238324336213596:content_owner_id_new.100001081832019:throwback_story_fbid.3238324336213596:photo_id.3238324129546950:story_location.4:story_attachment_style.photo:thid.100001081832019:306061129499414:2:0:1593586799:9222106177324709616&__tn__=*s-R


Image may contain: text and outdoor

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০২০ সকাল ১১:০৫
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দেশনায়ক তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে  

লিখেছেন এম টি উল্লাহ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৮


আগেই বলেছি ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং আওয়ামীলীগের যবনায় জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পৌনে একশ মামলা হলেও মূলত অভিযোগ দুইটি। প্রথমত, ওই সময়ে এই প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল দেশনায়ক তারেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পকে নিয়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****

ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ

লিখেছেন সরলপাঠ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠেলার নাম বাবাজী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩১

এক গ্রামীণ কৃষক জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাবে। লোকটি ছিলো ঠোটকাটা যখন তখন বেফাস কথা বা অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে ক্যাচাল বাধিয়ে ফেলতে সে ছিলো মহাউস্তাদ। এ জন্য তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×