somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের ৮ম পর্ব

২৬ শে জুন, ২০২০ সকাল ৮:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এর আগে ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাসের ৭টি পর্ব দিয়েছি। আজ দিচ্ছি ৮ম পর্বঃ
.
কন্সট্যান্স তখন তার তীক্ষ্ম, মর্মভেদী দৃষ্টিতে সন্ডার্সের দিকে তাকিয়েছিল। এক মুহুর্তের জন্য, সন্ডার্স ওই দৃষ্টির সামনে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। তার কাছে মনে হচ্ছিল, মেয়েটা যেন ওই তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে তার মনের সকল চিন্তা পড়ে নিচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই এই অস্বস্তিটা কাটিয়ে উঠলেন তিনি, এই ধারণাকে আপন মনে হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন। এই মেয়েটি বলতে গেলে এখনও একটা দুধের শিশু। বুনো বেড়ালের দুনিয়ায় একটা পুঁচকে ইঁদুর।
কিন্তু তারপরেও মেয়েটার চোখের ওই তীব্র দৃষ্টি তার মনকে অস্থির করে দিচ্ছিল। তিনি মনে মনে ভাবলেন, এই মেয়েকে দূরে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি ঠিক কাজটাই করছেন। জোর খাটিয়ে এই মেয়েটার শরীরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে ব্যাপারটা তিনি উপভোগই করতেন, কিন্তু সবকিছুর আগে হচ্ছে গিয়ে ব্যবসা। ওই বালকটির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এ যেন ওর বাবারই একটা প্রতিরূপঃ সেই একই রকম এলোমেলো লালচে চুল, একই রকম সুদর্শন চেহারা, শরীরের ছাঁচটাও বাবারই মতো। সে হয়তো এখন একটু বিপর্যস্ত। কিন্তু সন্ডার্স দেখতে পাচ্ছিলেন, ওর দেহটা খুব শক্তিশালী হয়ে বেড়ে উঠছে। সে হয়তো ভবিষ্যতে তার জন্য ভয়ংকর একজন দুশমন হয়ে দেখা দেবে। কে জানে!
হঠাৎ করে সন্ডার্সের চেহারায় একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু তিনি তাড়াতাড়ি করে সেই হাসিটা মুখ থেকে মুছে ফেলে সেখানে আন্তরিক উদ্বেগ ফুটিয়ে তুললেন। "প্রার্থনা করি, ঈশ্বর যেন তোমাদের সহায় হোন।"
******
গভর্নরের অফিস থেকে দশ মাইল দূরত্বে। রাস্তার ওপরে ভয়ানকভাবে ধুলাবালি উড়ছে। কারণ, ফরাসী সৈনিকেরা এক দল ষাঁড় দিয়ে তাদের কামানগুলো টানতে টানতে পানডিচেরির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশটা ভীষণ উত্তপ্ত। কিন্তু তারপরেও মহা-উৎসাহে গান গাইছিল ওরা। ওদের মনে তখন ভীষণ আনন্দ। ইংরেজদের মেরে ওদের গর্ব ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে ওরা। এবং এখন ওরা যখন ফিরে যাচ্ছে ওরা আগের চেয়ে আরও ধনী। এই হচ্ছে গিয়ে যুদ্ধের ভালো দিক। যুদ্ধটা আর আছে কী জন্য?
ধূলার মাঝ দিয়ে একটা কালচে ঘোড়াকে ছুটে আসতে দেখা গেল। দ্রুতবেগে ওদের দিকে ছুটে আসছিল এটি। এর আরোহীর পরনে একটি বৈশিষ্ট্যবিহীন ধুসর-রঙা কোট।
সৈনিকদের সারির সামনের দিকে দাঁড়িয়েছিল মেজর। সে রাস্তা থেকে একপাশে সরে দাঁড়াল যাতে তার কামানগুলো তাকে পেরিয়ে সামনে চলে যেতে পারে। সে ভাবল, প্যারিস থেকে তো নতুন একজন কমান্ডারকে এখানে পাঠানো হয়েছে, যার নাম মেজর জেনারেল করবেইল। সে চিন্তা করছিল এই ঘোড়সওয়ারের কাছে তার সম্পর্কিত কোনও সংবাদ আছে কিনা। মেজর জেনারেলের উদ্দেশ্যে যদি এই দারুণ লাভজনক বিজয়টা উৎসর্গ করা যায় তো তাহলে চমৎকার হয়। হয়তো এবার তার কপালে একটা প্রমোশন মিলে যাবে।
"কে তুমি?" সে ওই ঘোড়সওয়ারকে জিজ্ঞেস করল। "তোমার কাছে কি আমার জন্য কোনো বার্তা আছে?"
ঘোড়ায় চড়া লোকটা কিছু বলল না। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেজরের দিকে চেয়ে রইল সে। লোকটা এরপর তার গ্লাভস পরা হাতটা উঁচিয়ে তার কোট থেকে ধূলা ঝাড়ল। যেই ধূলার স্তর লোকটার কোটের ওপরে পুরু হয়ে জমে ছিল, তা সরে গেল। মেজর দেখলেন, লোকটার কাপড় আসলে সাদা, ধূসর না। এবং হাতটা যখন ওই কাপড় পরিষ্কার করছিল, ধীরে ধীরে প্রকাশিত হল যে ওই কাপড়ে বিভিন্ন রকম নকশা করা এবং স্বর্ণের লেইস লাগানো। মেজর ওই ইউনিফর্ম দেখে আঁতকে উঠলেন। আরে, এটা তো কিং লুইস পঞ্চদশের আর্মির মেজর জেনারেলের ইউনিফর্ম।
মেজর ঢোক গিলে স্যালুট করলেন। "আমি দুঃখিত। মশিয়ে জেনারেল। আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।"
জেনারেল ওখানকার স্তম্ভাকারে সজ্জিত সৈন্যসারির দিকে ইশারা করলেন। "এসবের মানে কী?" প্রচণ্ড রাগে তার চেহারা অগ্নিশর্মা হয়ে আছে। "কেন তোমরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছু হঠছ?"
"পিছু হঠছি? এসব কী বলছেন, মশিয়ে? আমরা তো এই যুদ্ধে বিজয়লাভ করেছি।"
"না। এটা একটা পরাজয়।" জেনারেল মুখ দিয়ে থুতু ফেললেন। "কলংকজনক ব্যর্থতা... হেলায় হারানো সুযোগ। আমি যখন প্যারিসের উদ্দেশ্যে চিঠি লেখব, আমি দেখব তুমি যেন তোমার ক্যারিয়ারের বাকি সময়টা জ্বরাক্রান্ত দ্বীপগুলোর ল্যাট্রিন সাফ করে করে কাটাও। পুরো মাদ্রাজ ছিল তোমার দখলে, আর তুমি কিনা আরও বেশি সুবিধা আদায় করে নেয়ার জন্য ওদের ওপরে চাপ প্রয়োগ করোনি, হাহ?"
"দেখুন, মশিয়ে, আমরা ওদের কাছ থেকে সম্মান আদায় করে নিয়েছি। ছয়জন পুরুষ এবং একজন মহিলা... যার মাঝে আছে একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী এবং তার স্ত্রী, তারা আমাদের বোমা-বর্ষণে মারা গিয়েছে। আমরা যদি ওদেরকে আরও বেশি কষ্ট দিতাম, তাহলে সেটা ছোটলোকের মতো কাজ হত।"
কোনোরকম অগ্রিম সতর্কতা ছাড়াই, করবেইল সামনের দিকে ঝুঁকল এবং তার অশ্বচালনার চাবুক দিয়ে মেজরের গালে সাঁই করে চাবুক কষাল। "তোমার কী উচিৎ ছিল জানো? তোমার উচিৎ ছিল প্রতিটি ইংরেজ নারী, পুরুষ, শিশুকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে সাগর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া, এবং বেয়োনেটের ডগা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ওদেরকে হত্যা করতে থাকা, যতক্ষণ না ওদের রক্তে পুরো সমুদ্রটা রক্তের লাল রঙে রঞ্জিত হয়ে যাচ্ছে। তোমার উচিৎ ছিল বোমাবর্ষণ করতে করতে ওদের দেয়ালগুলোকে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেয়া, ওদের সব প্রাসাদ-অট্টালিকা পুড়িয়ে দেয়া এবং পুরো শহরটাকে একদম ধূলায় মিশিয়ে দেয়া।"
মেজর তার চেহারাটা হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। কিন্তু করবেইল আবারও তার অশ্বচালনার চাবুক দিয়ে ওকে জোরালো আঘাত করল। চাবুকের আঘাতে মেজরের আঙ্গুলের ওপরে সাদা-সাদা দাগ পড়ে গেল। "তোমার সাথে যখন কথা বলব, তখন আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। বুঝেছ?"
মেজরের হাত তার গাল থেকে সরে গেল। ওই হাত তখন রক্ত আর ধূলায় আঠালো হয়ে আছে। সে মুখব্যাদান করে জেনারেলের দিকে চেয়ে রইল। "কিন্তু, মশিয়ে, আপনি কি ইউরোপ থেকে আসা সংবাদ শুনতে পাননি? ওখানে কোনো যুদ্ধ নেই। আমাদের সরকার লন্ডনের সাথে আলোচনা শুরু করে দিয়েছে, যাতে অস্ত্র ব্যবহার না করেই উত্তর আমেরিকার সাথে চলমান যুদ্ধের সমাধান করা যায়।"
মেজর তার জামার হাতা দিয়ে নিজের গাল মুছল। এতে করে তার সাদা রঙের কাপড়ে লাল রঙের ডোরাকাটা দাগ পড়ে গেল। আঘাতের ধাক্কাটা থিতিয়ে আসতেই, রাগ এবং ঘৃণায় ভরে উঠল তার অন্তরটা। সে ইংরেজদেরকে অপদস্থ করেছে, ফরাসিদের জন্য পনেরো লাখ গোল্ড প্যাগোডা অর্জন করেছে, এবং এর পুরোটাই এমন একটা যুদ্ধে অর্জন করেছে যেটা কিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণাই করা হয়নি। সে একজন হিরো। সম্মান তার প্রাপ্য। তার অবশ্যই এখন জেনারেলকে ডুয়েলে আহ্বান করা উচিৎ, যাতে এই অপমানের প্রতিশোধ এবং নিজের সম্মান পুনরুদ্ধার করা যায়।
কিন্তু সে যখনই জেনারেলের নিষ্ঠুর চোখজোড়ার দিকে তাকাল, তার মনের সাহস সব উবে গেল। নিজের সম্মান রক্ষা করাটাকে তখন আর অত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হল না। "মশিয়ে জেনারেল, যদি আমাকে কিছুক্ষণের জন্য অব্যাহতি দেন, আমাকে এবার আমার লোকদেরকে চালিত করতে হবে।" স্তম্ভাকারে সজ্জিত সৈন্যরা তখন থেমে গিয়েছে। তাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার উত্তপ্ত বাদানুবাদ দেখে কিছুটা বিনোদন-ও পেয়েছে তারা। মেজর গরুর গাড়ি চালকদের একজনের কাছ থেকে চাবুক ছিনিয়ে নিলেন এবং তার লোকদেরকে কষাঘাত করা শুরু করলেন। উন্মাদের মতো গালির ফোয়ারা ছুটাতে লাগলেন। "চলতে থাকো। কোনো থামাথামি নাই। যদি তোমরা আজ সন্ধ্যার মধ্যে পানডিচেরিতে পৌঁছাতে না পারো, আমি চাবকে তোমাদের পিঠ থেকে সব হাড়-মাংস আলাদা করে ফেলব। আমি তোমাদের সামনে আছি। আমাকে অনুসরণ কর।"
সে ধীর কদমে সৈন্য-স্তম্ভের সামনে অবস্থান নিল। অন্যদিকে, সৈন্যরা আবারও থপথপিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করল। করবেইল রাস্তার পাশ থেকে ওদেরকে দেখতে লাগল। তার ঠোঁটে একটা হাসি ফুটে উঠেছে। ভালো। রাগ জিনিসটা ভালোই। তার উদ্দেশ্যপূরণে এটা কাজে আসবে।
প্যারিস বা লন্ডনের লোকেরা কী বলছে সেটা তিনি একেবারেই গ্রাহ্য করেন না। কূটনীতিকদের কাজই হচ্ছে কথা বলা। তারা সারাক্ষণ কথার ফোয়ারা ছোটাতে থাকে। কিন্তু শেষে গিয়ে তাদের আলাপ-আলোচনা সব সময়ই ব্যর্থ হয়। সব সময় এমনটাই হয়ে আসছে। এরপরে দেখা যাবে, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন আবারও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। যেমনটা তারা গত সাতশ বছর ধরে করে আসছে।
কিন্তু এইবার যুদ্ধজয়ের পুরস্কার হবে পুরো দুনিয়া।
*****
জাহাজটা দুদিকে চওড়া হয়ে যাওয়া হুগলি নদীর বাঁকে প্রবেশ করল। কিন্তু কলকাতা শহরটা দৃষ্টিসীমায় ধরা দেয়ার পরেও জাহাজের ক্রুরা সেটা দেখতে পেল না। পাবে কী করে? জাহাজের ক্রুরা তখন যার যার কাজে দারুণভাবে ব্যস্ত। কেউ জাহাজের পাল মনোযোগ দিয়ে দেখছে, যাতে বাতাসের সামান্য দিক পরিবর্তন হলেও সেটা আগেভাগেই বুঝা যায়, অথবা পানিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে যে ওখানে কোনো লুকানো বিপদ আছে কিনা। জাহাজের হুইলের কাছেই দাঁড়িয়ে আছ ক্যাপ্টেন, মাস্টার এবং পাইলট। গভীর মনোযোগে জাহাজের হুইল সামলাচ্ছে তারা। প্রচুর মনোযোগ দিতে হচ্ছে। কারণ, এই নদীতে চলাচলে ঝুঁকি অনেক। এই নদীটা অগভীর, ঝঞ্জাটপূর্ণ বালুতট দিয়ে পরিপূর্ণ, যা প্রতিটি ঝড়ের পড়ে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে।
তবে জাহাজে থাকা কিছু কিছু মানুষ কিন্তু ঠিকই তাদের চারপাশের দৃশ্যের তারিফ করছিল। ওরা জাহাজের যাত্রী। জাহাজের রেলিং-এর কাছে দলবদ্ধ হয়ে জমায়েত হয়েছে ওরা। এই লোকগুলো একটা আজব সমাজের প্রতিনিধিঃ নীলচে রঙের কোট পরিহিত কেরানী এবং লিপিকার। এরা এখানে এসেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে কাজ করে করে ধন-সম্পত্তি গড়ার আশায়। জাহাজে আছে বিভিন্ন রকমের যাত্রী। সৈন্যরা তাদের ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসছে। আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীরা তাদের নিজেদের মধ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কিচিরমিচির করে কথা বলে যাচ্ছে, আর ইংল্যান্ড থেকে আগত মহিলারা একজন স্বামী খুঁজে পাওয়ার আশায় ব্যাকুল হয়ে আছে।
থিও আর কন্সট্যান্স দাঁড়িয়ে আছে এদের মাঝেই। থিও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দৃশ্যাবলির দিকে। তাদের নতুন বাসাটা একটু পরেই ধরা দিল দৃষ্টিসীমায়। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের কর্তৃত্বপরায়ণ দেয়ালটা নদী তীরবর্তী ঘাটের পাশেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ এবং খাড়া হয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে ওই দেয়াল, নদীর ওপরে এর কর্তৃত্বই প্রকাশ করতে চাইছে যেন। এর পতাকাদণ্ডে নিস্তেজ অবস্থায় একটি বিশালাকৃতির ইউনিয়ন ফ্ল্যাগ ঝুলছে, এর পাশেই দেখা যাচ্ছে গির্জার গম্বুজ এবং গভর্নরের প্রাসাদের ক্লাসিক্যাল ঘরানার চমৎকার বহির্ভাগ। নদীর ধারে ধারে প্রায় এক মাইল এলাকা জুড়ে অভিজাত চেহারার সব প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছে। সেইসব প্রাসাদ-অট্টালিকার সামনে আবার জমকালো বাগান-ও আছে। জাহাজঘাটায় বড় বড় সব জাহাজ নিষ্প্রাণ ঢেউয়ের ওপরে অলসভাবে দুলছে। অন্যদিকে ছোটখাটো গড়নের স্থানীয় নৌকা, যাকে বজরা নামে ডাকা হয়, সেগুলো প্রচণ্ড বেগে চটপটে ভঙ্গিতে ওইসব স্থির হয়ে থাকা জাহাজগুলোর মাঝ দিয়ে ছুটে ছুটে যাচ্ছে। ওই বজরার বৈঠাগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে যেন শতপদীর পা।
কন্সট্যান্স ওর ভাইয়ের হাতে আলতো করে চাপ দিল। "তোর কাছে কী মনে হচ্ছে, থিও?"
"মনে হচ্ছে যেন এবার নিজের একটা বাড়ি পেয়েছি।" সে চিৎকার করে বলল।
কিন্তু তারপরেও এই বাসগৃহটি তাদের আগের বাসগৃহের চেয়ে আলাদা। এখানে সাগরের ফেনা জোরালো বেগে সৈকতের ওপরে আছড়ে পড়ে না। তার বদলে এখানে বাদামী রঙয়ের পানির একটি নদী মন্থরলয়ে ধীরে ধীরে বয়ে যাচ্ছে। এবং সুশ্রী চেহারার লালচে পাথরের বদলে, এই দুর্গটি নির্মাণ করা হয়েছে ধবধবে সাদা ইট দিয়ে। সূর্যের আলোর তলায় এটি উজ্জ্বলভাবে রশ্মি বিকিরণ করে যাচ্ছিল। কিন্তু ওরা যতই দুর্গের কাছাকাছি হচ্ছিল, থিওর কাছে দুর্গের সত্যিকারের চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে দেখল, দুর্গের সাদা দেয়ালটা আর্দ্রতা এবং উত্তাপের কারণে হলুদ হয়ে গেছে, যেন ঘনীভূত দুধ। এবং এখানকার এই স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়াটা থিওর শরীরের ওপরে ভীষণ চাপ ফেলছিল, মাথা ব্যথা করছিল ওর। এই কলকাতা শহরটার বাহ্যিক চেহারা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত চমৎকার, কিন্তু প্রাসাদ-অট্টালিকার সম্মুখভাগে থাকা বাগানগুলো পেরিয়ে আসতেই, জঙ্গলটা চারপাশ থেকে ওদেরকে চেপে ধরতে শুরু করল।
জাহাজের যাত্রীদেরকে অভিবাদন জানানোর জন্য দুর্গ থেকে একটি কামানের গোলা নিক্ষিপ্ত করা হল। অন্যদিকে একটি হাতি তীক্ষ্ম স্বরে বুনো চিৎকার করল। ওই চিৎকার শুনে থিওর শরীরটা কেঁপে উঠল।
"আমি নিশ্চিত তুমি এখানে খুব সুখে থাকবে," কেরানীদের একজন কন্সট্যান্সকে বলল। সে একজন কৃশকায় পুরুষ, চুলের রং হলদেটে এবং আধো আধো উচ্চারনে কথা বলে। কিন্তু তারপরেও সে ঠিকই কন্সট্যান্সের পাশের রেলিং-এর বহুল আকাঙ্ক্ষিত জায়গাটা দখল করে নিতে পেরেছে। এই জাহাজটা যেই সময় থেকে মাদ্রাজ শহর থেকে নোঙ্গর তুলেছে, এই জাহাজে থাকা কমবয়সি পুরুষেরা ওর চারপাশে ছোঁক ছোঁক করছে। ব্যাপারটা এমন যেন, এক দল পতঙ্গ মোমবাতির আলোয় আকৃষ্ট হয়ে তার চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। কন্সট্যান্স যদি ওর স্কার্ফটা ফেলে দেয়, এক ডজন প্রণয়াভিলাষী পুরুষ ছোঁ মেরে সেটাকে তুলে আনবে, এবং সেটা ঘটবে ওই স্কার্ফটা ডেক স্পর্শ করার আগেই। কন্সট্যান্স যখন ডিনার করতে যায়, ওর গ্লাসে থাকা পানীয়ের স্তর যদি এক ইঞ্চির একশ ভাগের এক ভাগ-ও নেমে যায়, হাতের কাছে অবশ্যই কেউ না কেউ থাকবে, যে কিনা ওটাকে আবারও পূর্ণ করে দেবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজগুলো যত প্রকার পণ্যদ্রব্য বহন, তার মাঝে খুব অল্প কয়েকটিই একজন যোগ্যতাসম্পন্ন ইংরেজ লেডির মতো মূল্যবান। একজন সুন্দরী ইংরেজ লেডিকে ভারতবর্ষে খুবই মূল্যবান হিসেবে দেখা হয়।
"আমিও নিশ্চিত, এই জায়গাটা আমার জন্য খুবই আনন্দদায়ক হবে," কন্সট্যান্স চেহারায় বিরক্তমাখা একটা হাসি দিয়ে বলল।
ওদের আগমণের কারণে দুর্গের সামনের জাহাজ-ঘাটে মানুষের ভিড় লেগে গেছে, এই জাহাজ ওদের জন্য সাথে করে যেই খবর নিয়ে এসেছে তা জানতে ইচ্ছুক ওরা। ছোটখাটো আকৃতির নৌকাগুলো যাত্রীদেরকে জাহাজ-ঘাটে নামিয়ে দিচ্ছিল। এই দৃশ্য দেখে কন্সট্যান্সের মন কিছুটা প্রফুল্ল হয়ে উঠল। জাহাজের ভেতরে আবদ্ধ অবস্থায় জীবন কাটাতে কাটাতে ওর ভীষণ বিরক্তি ধরে গিয়েছিল। রাতের পর রাত একই চেহারা, তাদের সাথে একঁঘেয়ে, ক্লান্তিকর কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া, আর প্রতিবেলা একই রকমের শক্ত শক্ত খাবার খাওয়া। কন্সট্যান্স এবার মানুষের ভিড়, নতুনত্ব এবং ড্যান্স করবার সুযোগ চায়।
অন্যদিকে, ওর পাশেই বসে আছে ওর ভাই থিও। সে এসবের কিছুই চায় না। প্রতি রাতে, সে একই দুঃস্বপ্ন বারবার দেখে... ওর বাবার হাত ওর কাছ থেকে ছুটে যাচ্ছে, গুঁড়ো গুঁড়ো ইটের ধূলিকণায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে ওর ফুসফুস। সে এর লজ্জা এবং অপমানে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওর বাবা-মায়ের নৃশংস মৃত্যুর কোনো বিচার পায়নি সে। এখন সে শুধু একটা জিনিসই চায়। এই অবিচারের প্রতিশোধ।
ওদেরকে বহনকারী নৌকাটি জাহাজ-ঘাটায় দুম করে আঘাত হানল। সিঁড়ির একদম শীর্ষভাগে পৌঁছাতেই জনতার হৈ-হট্টগোলে ওদের মাথাটা একদম খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হল। ব্যবসায়ী এবং স্বজনদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন আত্মীয়-স্বজনেরা জাহাজের যাত্রীদের কাছে নানান খবরাখবর জানতে চাইছিলেন। কুলি, হকার এবং একদল পতিতা তাদের সেবা নেয়ার জন্য সাধাসাধি করছে। পতিতাদের দেখে থিও ওর শরীরটাকে সংকুচিত করে কিছুটা পিছিয়ে গেল।
একজন মানুষ জনতার মাঝ দিয়ে ভিড় ঠেলতে ঠেলতে ওদের কাছে এগিয়ে এল। লোকটা লম্বা এবং সুদর্শন, এলেমেলো চুল, চলাফেরায় আত্মবিশ্বাস ফুটে বের হচ্ছে। চারপাশের সবাই একে অপরকে কনুই এং কাঁধ দিয়ে ক্রমাগত ধাক্কা মেরেই যাচ্ছে, কিন্তু এর মাঝেও সে এতটাই স্বচ্ছন্দ এবং চেহারাতেও নির্মল একটা হাসি মেখে রেখেছে, যেন এই পরিস্থিতিটা সে দারুণভাবে উপভোগ করছে। সে নিজের পথ করে নিয়ে সরাসরি থিও আর কন্সট্যান্সের কাছে চলে এল।
"হেই, কাজিন!" সে আনন্দিত ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠল। কন্সট্যান্সের গালে চুমু খেল সে এবং একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওর দিকে। তার চোখজোড়া হালকা বাদামী রঙয়ের, সবুজাভ কিছু বিন্দু আছে এবং ভারতীয় সূর্যের তলায় খুব বেশি পরিমাণে চলাফেরা করার কারণে চোখের প্রান্তগুলো কুঁচকে গেছে।
"আন্দাজ করছি, তুমিই আমাদের কাজিন জেরার্ড।" কন্সট্যান্স বলল।
.
ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের প্রথম পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/photo.php?fbid=2985829594796406&id=100001081832019&set=a.422627021116689&source=56

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের দ্বিতীয় পর্বঃ Click This Link

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের তৃতীয় পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3211705148875515&id=100001081832019&_ft_=mf_story_key.3211705148875515:top_level_post_id.3211705148875515:tl_objid.3211705148875515:content_owner_id_new.100001081832019:throwback_story_fbid.3211705148875515:photo_id.3211705005542196:story_location.4:story_attachment_style.photo:thid.100001081832019:306061129499414:2:0:1593586799:5167009495212656913&__tn__=*s-R

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের চতুর্থ পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3213814051997958&id=100001081832019&_ft_=mf_story_key.3213814051997958:top_level_post_id.3213814051997958:tl_objid.3213814051997958:content_owner_id_new.100001081832019:throwback_story_fbid.3213814051997958:photo_id.3213813895331307:story_location.4:story_attachment_style.photo:thid.100001081832019:306061129499414:2:0:1593586799:2041402156577410201&__tn__=*s-R

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের পঞ্চম পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3220982584614438&id=100001081832019&_ft_=mf_story_key.3220982584614438:top_level_post_id.3220982584614438:tl_objid.3220982584614438:content_owner_id_new.100001081832019:throwback_story_fbid.3220982584614438:photo_id.3220982351281128:story_location.4:story_attachment_style.photo:thid.100001081832019:306061129499414:2:0:1593586799:-6887371295566324405&__tn__=*s-R

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের ষষ্ঠ পর্বঃ
https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3230524416993588&id=100001081832019&refid=17&__tn__=*s-R

ঘোস্ট ফায়ার উপন্যাস অনুবাদের সপ্তম পর্বঃ

https://mbasic.facebook.com/story.php?story_fbid=3232644440114919&id=100001081832019&refid=17&_ft_=mf_story_key.3232644440114919:top_level_post_id.3232644440114919:tl_objid.3232644440114919:content_owner_id_new.100001081832019:throwback_story_fbid.3232644440114919:photo_id.3232644223448274:story_location.4:story_attachment_style.photo:thid.100001081832019:306061129499414:2:0:1593586799:9210059653702672880&__tn__=*s-R
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০২০ সকাল ৮:০৮
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দেশনায়ক তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে  

লিখেছেন এম টি উল্লাহ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৮


আগেই বলেছি ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং আওয়ামীলীগের যবনায় জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পৌনে একশ মামলা হলেও মূলত অভিযোগ দুইটি। প্রথমত, ওই সময়ে এই প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল দেশনায়ক তারেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পকে নিয়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****

ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ

লিখেছেন সরলপাঠ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠেলার নাম বাবাজী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩১

এক গ্রামীণ কৃষক জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাবে। লোকটি ছিলো ঠোটকাটা যখন তখন বেফাস কথা বা অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে ক্যাচাল বাধিয়ে ফেলতে সে ছিলো মহাউস্তাদ। এ জন্য তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×