(এই লেখার শিরোনাম একবার লিখে প্রায় ঘন্টাখানেক বসেছিলাম। লেখার বিষয়ের ডালপালা এত ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে যে কীভাবে গুছিয়ে লিখবো তা বুঝতে পারছিলাম না। তারপরে মনোযোগ ও মন অন্যদিকে সরাতে পেরে ট্যাবটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।)
আমার প্রথম ব্লগে একটা কথা লিখেছিলাম। প্রতিটা কাজের উৎসাহ একটা নির্দিষ্ট থ্রেশহোল্ড না পার হলে আমরা কাজটা করতে পারি না। ইচ্ছা অভিলাষের একটা পারদ মাত্রা থাকে। তার চেয়েও ঝাপসা শব্দ অভিলাষ। আমার অভিলাষ একবার মহাশূন্যে ভ্রমণে যাব (সেটা কার্যকর হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, শারীরিক ও আর্থিক দিক থেকে আমি অনুপযুক্ত)। তেমনি আমার সাধ একদিন বাংলাদেশ খুব আনন্দময় একটা দেশ হবে।
এই সকল বালখিল্য আশার বয়স এবং বাস্তবতা দুইটাই পার হয়ে এসেছি। এবং পথের মধ্যেই জানতে পেরেছি এগুলো আমাদের জন্য মরীচিকার মত পেতে রাখা আছে। আমরা এসব সাধ বা অভিলাষ পোষণ করে আপাতকঠোর বাস্তবতা থেকে দুইদণ্ডের রেহাই পাই। বড়ো হতে হতে জেনেছি যে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ একটা মীথ। এখনও সেটা রোমান বা গ্রীক মিথের মত হয়ে ওঠেনি, তবে হবে। আমার নাতি বা তার নাতির সিলেবাসে হয়তো কার্ল মার্ক্স একজন রূপকথার গল্পকার বা মীথের কথক হিসেবে পঠিত হবেন। আমার মধ্যেও এই বিলাসজাত স্বপ্ন নাই যে পৃথিবী থেকে সকল শ্রেণীভাগ উঠে যাবে।
এটার পাশাপাশি অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে কোনকিছু তত্ত্বে দারুণ হইলেই সেটার প্রয়োগ দারুণ হবে বা উপযুক্ত হবে এমন কোন কথা নাই। এরকম উদাহরণ আশেপাশে প্রচুর দেখতে পাই। বাংলাদেশের মত দেশে জিপিএ সিস্টেম নিয়ে অনেকেই আশাবাদী ছিলেন ২০০৩ সালে। আধুনিক বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ের মত আমরাও ৫.০ পয়েন্ট পাবো, এবং আমাদের এই "বিশ্ববিদ্যালয়ের মত দেখতে" জিপিএ দেখে তারা আমাদের গুরুত্ব দিবে। এমনও শুনেছিলাম এতে করে আমাদের বহির্বিশ্বে পড়াশোনার উপকার হবে (কী উপকার হবে সেটা সম্বন্ধে বক্তা বেশ সন্দিহান ছিলো)। তবে আজকে প্রায় ৬ বছর পরে যেটা বুঝি, প্রচুর পরিমাণ স্টার/১ম বিভাগ শ্রেণীর মেধা ও মস্তিষ্ক নিয়েই অনেকে জিপিএ ৫.০ পাচ্ছে।
এই প্লাটফর্মে আস্তিক্য-নাস্তিক্য নিয়ে অযথাই তালগাছ-মূলক তর্ক/ঝগড়া/ত্যানা প্যাঁচানো/গালাগালির কথা মাথায় রেখেও একটা উদাহরণ একইভাবে দেয়া যায়। সেটা হলো তত্ত্বীয় ধর্ম এবং তার প্রয়োগের পার্থক্য। তত্ত্বীয় নাস্তিক্য বিষয়ে এখনও প্রমাণ গ্রন্থ বা বিশেষ গ্রন্থ না থাকলেও মোটামুটি সেখানেও ব্যবহারিকে গিয়ে আকাশ পাতাল পার্থক্য দেখি।
আরো একটা উদাহরণ দেখি এই সমাজ-বিষয়ে সকল মতবাদে। সেই গোত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র থেকে শুরু করে পুঁজিবাদ পর্যন্ত যত নীতি এসেছে, সবাই নিজস্ব ভুল, ত্রুটি নিয়েই এসেছে। মানুষের চির"ভ্রষ্ট" চরিত্রের কারণেই একটা দলের সবার সাথে খাপ খায় এমন কোন পথ বা মত কেউ দেখাতে পারেন নাই। কোন মতবাদেই এই সুবিধাগুলো প্রদান করতে পারেন নাই বিধায় মানুষ শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদ আর মুক্তবাজার নিয়ে কাজ চালাচ্ছে। ইউটোপিয়ান সমাজ কেবল বই-পুস্তকে সম্ভব বলেই আমরা চোখ খুলে দেখি সবাই কাড়াকাড়ি করেই নিচ্ছি সবকিছু! এবং এটাকে সমর্থনের জন্যেই কি না জানি না, বাকি সমস্ত মতবাদ আজকের পৃথিবীতে ভীষণ কোণঠাসা। কাগজে কলমে যতই "সুন্দর ভবিষ্যত" বা "সুন্দর পৃথিবী"র আশ্বাস থাকুক না কেন, এই পুঁজিবাদি, নিস্পৃহ এবং নিষ্ঠুর ব্যবস্থার কাছে বাকি সব থুবড়ে পড়ছে।
এটাও একটা উদাহরণ যে তত্ত্বমতে যে কথা উপযোগী মনে হচ্ছে, বাস্তবে তা অনেক সময়েই ধোপে টিঁকে না।
সামাজিকভাবে আমাদের বাস্তবতা ক্রমশই চরমপন্থী হয়ে উঠছে। একটু ব্যাখ্যা করি। আমি নিজে নব্বুইয়ের দশকে বড়ো হয়েছি। তার আগের দশকব্যাপী স্বৈরাচার ও সামরিক শাসনের মিশ্রণে থেকে আমাদের সমাজ অনেকাংশই ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। মতপ্রকাশ বা আনন্দ-উৎসবের মাঝেও আমি একটা ম্রিয়মাণতা টের পেতাম। হয়তো সমাজের উপরতলায় এগুলো ঠিকঠাকই ছিল, ওখানে অবশ্য কখনই বা উদযাপনের জাঁকজমক কমেছে? সেসময়ের তুঙ্গবিষয় ছিল ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম (এখন তাঁকে শুধুমাত্র তাঁর মৃত্যদিনে স্মরণ করা হয়!) এবং গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলা। ছোট ছিলাম, বা রাজনৈতিক বিষয়ে গড়ে ওঠা সুশীলীয় অনাগ্রহের কারণেই মামলার খুঁটিনাটি সম্বন্ধে জানতাম না। বিস্ময় হলো হেরে যাবার পরে, একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, জামাতে ইসলামির মত ধর্মব্যবসায়ী দলের নেতা হয়ে এই লোকটি কীভাবে নাগরিকত্ব পেয়ে গেল। নাগরিকত্বের আড়ালে তাকে স্বীকার করে নেয়া হলো (ক্ষমা তো আগেই করা হয়ে গেছে!)।
এই দশকের শুরুতে জামাত যখন বিএনপি এবং আরো দুইদলের সাথে জোট করলো, এবং সরকারের অংশ হয়ে গেলো তখন আমি বুঝলাম যে হয়তো আমিই ভিন্নভাবে চিন্তা করছি। দেশের বেশিরভাগ মানুষ এদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচন করছে এই জিনিসটা আমার মেনে নিতে কষ্টও হলো।
তত্ত্বাবধায়কের সময়ে দেখলাম বিএনপি ও আওয়ামীলীগের অনেক বড়ো বড়ো নেতা দূর্নীতিসহ নানান মামলায় ধরা পড়ছেন, কেবল জামাতের কেউ ধরা পড়ছে না। এইবারেও আমি অবাক হলাম, এরা ধোয়া তুলসীপাতা নয় সেটা নিশ্চিত, এবং চুরি করার সময়ে চোর এটা খেয়াল করে না যে বাক্সপত্র ওলটপালট হচ্ছে। সুতরাং নিশ্চয়ই চুরির আলামত আছে, দূর্নীতির চিহ্ন আছে। সেগুলো কেন কেউ খুঁজে পাচ্ছে না, কিংবা বলা যায়, সেগুলো কেউ কেন খুঁজে বের করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে না। জামাত এবং জামাত-সমব্যথীরা কি তবে হর্তাকর্তাদের মধ্যেও, তত্ত্বাবধায়কদের মধ্যেও?
২.
২০০৮ এর শুরুতে আমি ব্লগজগতে প্রথম এসেছি। প্রথম দিকে লেখার চাইতে পড়তাম অনেক বেশি। সময় এবং সুযোগ কমে যাওয়াতে এখন সেটা হয়ে ওঠে না। পড়তে পড়তে খেয়াল করলাম প্রচুর ব্লগ লেখা হচ্ছে জামাতপন্থি এবং রাজাকার-তোষণমূলক কথাবার্তা দিয়ে। যেহেতু এটা খোলা মাধ্যম, কেউ চাইলেই সেটা বন্ধও করতে পারবে না। সরাসরি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুললে হয়তো সেটা অভিযুক্ত করা যায়। কিন্তু একটু আড়াল করে, আবডাল দিয়ে লিখলে অনেক সময়ে সেটা বোঝাও যায় না।
এরকম লেখাগুলো পড়তে পড়তে এবং তাদের অন্যদের সাথে মন্তব্যে কথাবার্তা পড়তে পড়তে দেখলাম এটা বেশ শক্তিশালী পদক্ষেপ। পুরো ঘটনাগুলো বেশ গুছিয়ে, আঁটঘাঁট বেঁধেই করা হচ্ছে। মন্তব্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেলে হয় তা মডারেট হচ্ছে, নতুবা তা মুছে ফেলা হচ্ছে। ব্লগের কর্তৃপক্ষের হস্ত্ষপের বিলম্বের পেছনে যে কারণই থাক না কেন, সেটা অন্যান্যদের উষ্মা এবং গালিগালাজ থামাতে পারছে না। একটা পর্যায়ে নিক বা ব্লগার ব্যান করে দিলেও সে বা অন্য কেউ অন্য নামে ঘুরে ফিরেই আসছে (একজন ব্লগার সম্ভবত এই লিস্টও বানিয়েছিলেন!)।
আমি সবসময়েই এরকম পোস্টগুলো এড়িয়ে চলি, সারাদিনের অনেক রকম জটিলতা ও কাউকাউয়ের পরে ব্লগে এসে একই কাজ করতে ভালো লাগে না। তারপরেও মাঝে মাঝে এই নিস্পৃহতার সীমাটা ছাড়িয়ে যায়। তখন হয়তো কোন পিচ্ছিল, এবং বিরক্তিকর ধরনের জামাতি কারও সাথে তর্ক শুরু করতে হয়। এসব তর্কের কোন সফলতা নাই, কারণ একজন শিবির বা জামাত মনোভাবের কারো পক্ষে নিজস্ব মতামতের বাইরে গিয়ে চিন্তা করা সম্ভব না। সম্পূর্ণ জেনে, বুঝে একটা ধর্মব্যবসায়ী ও খুনি-ধর্ষণকারী দলের সমর্থক হতে গেলে নিজস্ব নৈতিকতা বা মানবতাবোধকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। মাথা মুড়ে চুনকাম করে ফেলা হয় বলেই তাদের আচরণ এবং ব্যবহার হয় পরিশীলিত, মার্জিত। এবং রাজনীতি ও ধর্ম ব্যাপারে যেহেতু আমরা কম বেশি উদাসীন, পড়াশোনা কম, বিশ্বাসটাও মরচে ধরা নড়বড়ে, আমাদের মাঝে তারা বেশ দীপ্তি নিয়েই বিরাজ করে। তাদের চারিত্রিক সুষমা দেখে মুগ্ধ হয়ে শিবিরপন্থি বা জামাতের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে দেখেছি অনেককেই।
৩.
নিরপেক্ষ বলে কোন পক্ষ নাই বলে আমি বিশ্বাস করি। মানুষ কোন না কোনভাবে একটা সাইড নিবেই। একজন জামাতপন্থী খুব ভালো করেই জানে বাংলাদেশের মানুষের মনে কুশিক্ষা এবং ধর্মবিষয়ক অজ্ঞানতা কতটা বেশি। সেই জায়গাটা নরম এবং নাজুক বলে সেখানে একটু গুতো দিলেই ঝুরঝুর করে তার প্রতিরোধ ভেঙে পড়বে। তারপরে কোন ফাঁকে তাকে মগজ ঘুলিয়ে, গল্প ও কবিতার ছলে "সাথী" বানিয়ে ফেলা হবে সেটা সে নিজেও জানবে না।
আমি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বুয়েটের মত প্রতিষ্ঠানে মেধাবী ও উজ্জ্বল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেই প্রচুর জামাতি ও শিবিরপন্থী চরিত্র। এদের কেউই পোশাক আশাক, চলন বলনে গোঁড়া নয়। পাঞ্জাবি-পায়জামা-টুপি পরা ছেলে অথবা বোরকাবৃত মেয়ে'র বেশ ছেড়ে অনেকেই আমাদের মতই শার্টপ্যান্ট আর সালোয়ার কামিজ-ফতুয়া পরছে এবং মনে মনে শিবিরঘেঁষা মনোভাব ধারণ করছে। চলনে বলনে আধুনিক এবং বিজ্ঞরূপ ধারী এই সব মানুষই তীব্রভাবেই একগুঁয়ে (অন্তত প্রগতির প্রশ্নে); ধর্মের মূল জ্ঞানের চাইতে কর্ম অর্থাৎ সামাজিক পালনের ব্যাপারে বেশি উৎসাহী; এবং বর্তমান রাজনীতি ও প্রেক্ষাপট নিয়ে সচেতন, উচ্চাভিলাষী।
এই "সচেতন", "শিক্ষিত" জনগোষ্ঠীর নিরানব্বুইভাগ তুখোড় ছাত্র, কিন্তু এমন সচেতনতার সাথে জামাতি বা শিবিরীয় মনোভাবের পাশাপাশি জীবনযাপনেও তারা প্রবলভাবে ধর্মান্ধ। অবস্থা বিশেষে ধর্মের "সুবিধা" সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবেই তারা আদায় করে। অথচ ধর্মজাত স্বার্থত্যাগ বা নিঃস্বার্থ আচরণ তাদের মাঝে দেখি না। পরোপকারের যে মুখোশ তারা সামাজিকভাবে ধারণ করেন সেটারও গূঢ় উদ্দেশ্য থাকে প্রতিপত্তি বা স্ট্যাটাস অর্জন।
আশংকা বা ভয়ের বিষয় হলো, বাংলাদেশের ইতিহাস বা স্বাধীনতার প্রতি হুমকি বহন করে এরকম অনেকগুলো মতবাদকেই এরা চিত্তে ও ধ্যানধারণায় ধারণ করে। এবং সেইদিন দূরে না যেদিন আমাদের উদারতা এবং প্রগতিবাদীত্বের বুলশিটের মধ্যে দিয়ে তারা শাসন, ক্ষমতা ও অর্থবিত্তের দাপট দেখানো শুরু করবেন। আমরা ছা-পোষা মধ্যবিত্ত কেবল রাজনৈতিক অনীহা থেকেই চেয়ে চেয়ে দেখবো প্রতিক্রিয়াশীলতার ছায়া দীর্ঘ হতে হতে আমাদের জনপদ ঢেকে ফেলছে।
***
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:৪৪