খুশির ঈদ , আনন্দের ঈদ বা অপেক্ষার ঈদ-এইসব বিশেষণ কবেই বিদেয় নিয়েছে মধ্যানহ পেরিয়ে যাওয়া জীবন থেকে । এখন ঈদ মানে কেবলি দায়িত্বের বোঝা টানা ,ঈদ মানে মধ্যবিত্তের কাছে সাধ ও সাধ্যের সাথে এক তুমুল যুদ্ধ । সারা বছর এমন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে বেড়ালেও ঈদের আগের রাতে এখনো ঠিক ঠিক চাঁদ দেখার জন্য খোলা ছাদে গিয়ে দাঁড়াই ,আর যখনি “ও মন রমজানের ওই রোযার শেষে “গানটা কানে বাজে তখনি মন ছুটে যায় স্মৃতিময় শৈশবে।
সেলুলয়েডের ফিতের মতোন একটা একটা করে আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকে দূরন্ত বেলার দিন। এখনকার বাচ্চাদের মতোন ইট-পাথরে শহুরে জীবন আমাদের ছিল না।বাবা সরকারী চাকরী করতেন , বড় হয়েছি সরকারী কলোনীতে। তিন ভাই-বোন ছিলাম পিঠা পিঠি ,বাবা তখনো প্রমোশন পেয়ে বড় অফিসার হননি ।আমাদের বাড়িতে টেলিভিশন নামক কোন যন্ত্র স্কুল বেলায় চোখে পড়েনি । প্রতি বছর ঈদের দিন রাতে একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হতো ,নাম -আনন্দ মেলা ; সেটা দেখার জন্য কলোনী শুদ্ধ দর্শক ঝাঁপিয়ে পড়তাম একজনের বাসাতেই । বিরক্ত হওয়া তো দূরের কথা , ড্রয়িং রুম ভরে যখন গ্যালারী বিশাল আকার ধারণ করতো তখন বাইরের জানালাও খুলে দিতেন বাড়ির কর্তা যেন বাইরে দাঁড়িয়েও দর্শকরা ঠিক মতোন আনন্দ উপভোগ করতে পারেন ।কার্টূণ ছবি ,ফুটবল খেলা সব কিছুই আমরা ওই আংকেলের বাড়িতেই দেখতাম ।
ওই সময় আম্মা কিছুতেই রোযা রাখতে দিতেন না ,তাই সেহরীতে যেন ঘুম না ভাঙ্গে সে জন্য শব্দ না করেই ভাত খেয়ে নিতেন আব্বা-আম্মা ।কিন্তু আমি ঠিকি জেগে থাকতাম, রোযা রাখার প্রতিযোগিতা ছিল বন্ধুদের মধ্যে ।কে কয়টা রাখতে পারে সেই প্রতিযোগিতা ,এমনো হয়েছে যে ক্ষুধায় থাকতে না পেরে চুরি করে পানি খেয়ে বন্ধুদের কাছে ধরা দেইনি ,পাছে আবার দাম কমে যায় ।
এখনকার দিনের মতোন এমন বাহারি রঙের ইফতার আমরা ছোট বেলায় দেখিনি ,আব্বাকে দেখতাম অফিস থেকে ফিরেই চিড়া ভেজাতো ।সাথে কলা আর গুড় ; খেজুরতো ছিল একদম সাধারণ বিষয় ।এর বাইরে যাদের অবস্থা ভালো তারা হালিম করতো ,কেউ বা নুডলস করতো ইফতারের সময় । এমন ফরমালিন দেওয়া ফলও তখন ছিল না , শরবত হিসেবে আমরা বেল-তরমুজ-আনারশ এই সব ফলের শরবতই খেতাম । রুহআফজার নাম শুনেছিলাম ; বিজ্ঞাপণ দেখতাম আর আব্বাকে বলতাম-আব্বা,লাল শরবত খাবো ।কিন্তু ওটা বাড়িতে আনবার সামর্থ আব্বার ছিল না। আমাদের ঘরে দীনতা ছিল ,তা নিয়ে হা পিত্যেশ ছিল না এক রত্তি ।
প্রত্যেক রোযার ঈদের সকালে আমরা তিন ভাই বোন কিছুই খেতাম না ।কারন ,একটা আন্টি ছিলেন চার তলার ফ্ল্যাটে , যিনি খুব মজা করে পুডিং আর কাস্টার্ড করতে পারতেন ,আমাদের মায়েরা অতোটা তখনো এ ব্যপারে শিদ্ধহস্ত হতে পারেননি ।আমরা বন্ধুদের সাথে করে সেই আন্টির বাসায় নামাজের পর পরই উপস্থিত হতাম ,আন্টি বিষয়টা বুঝতে পারতেন ।প্রতি বছর আমাদের জন্য স্পেশিয়াল পুডিং থাকতো , এমন আর একটা আন্টি ছিলেন যার হাতের চটপটি না হলে আমাদের ঈদ সম্পূর্ন হতোনা ।এভাবে আমরা ঈদের দিন লিস্ট করে রাখতাম -কোন সময়ে কার বাসায় কী খাব । এভাবে ঘুরে ঘুরে খেতে খেতে কখোন যে ঈদের দিনটা কেটে যেত তা টেরই পেতাম না।
ঈদের জামা বন্ধুরা কেউ কাউকে দেখাতাম না -এটা খুব প্রাচীন একটা প্রচলন ছিল।আমাদের মায়েরাও নাকি তার বান্ধবীরা বাড়িতে এলে বালিশের নীচে বা খাটের তলায় নতুন জামা লুকিয়ে রাখতেন ।এমন জমকালো মার্কেটতো তখন ছিল না , একই রঙের কাপড় কিনে আম্মা তিন ভাই-বোনকে জামা বানিয়ে দিতেন ।মনে আছে আমি কলেজে পড়ার সময়ও মায়ের হাতে শেলাই করা কাপড় পড়েছি ।তখন রোযার দিনেও মানুষের মধ্যে যেমন সংযম দেখতাম ,তেমন ঈদ নিয়ে বাড়াবাড়ি রকম আদিখ্যেতাও চোখে পড়েনি । অতিরঞ্জিত কোন কিছু ছিল না বলেই হয়তো পাড়ায় পাড়ায় হিন্দী গান বাজিয়ে ছেলেরা আড্ডা দিত না, মার্কেটের সামনে রঙের প্রলেপ লাগিয়ে কেউ গলা কেটে চাঁদা চাইতোনা । ঈদের সন্ধ্যায় টিন এজ ভাই-বোনরা খুব সুন্দর করে সাংস্মৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো আংকেলদের কাছ থেকে চাঁদা উঠিয়ে ।চুনোপুটি হিসেবে আমাদের মাঝে মধ্যে মাইক্রোফোন দেওয়া হতো ছড়া বলার জন্য ।পুরো কলোনী নেমে আসতো সেই সব অনুষ্ঠান দেখার জন্য ,তখন এমন ২৫ /৩০ টা চ্যানেল ছিল না ,ইন্টারনেট ছিল না।। সারাদিন ঘুরে আর সন্ধ্যায় গান বাজনা করেই আনন্দময় ঈদ কখোন যেন ভোর হয়ে যেত, রাতে ঘুমানোর সময় কাঁদতাম আর আল্লাহকে বলতাম-ঈদ কেন দুই দিন হয় না ?
এখন আমার কাছে ঈদ মানে -গাধার কাঁধে চল্লিশ মণ ওজনের একটা বোঝা।।আর আমার মায়ের কাছে অপেক্ষা, তার বধূ জীবনে আব্বা তাকে আহামরী শাড়ি বা অলংকার দিয়ে ভরিয়ে দেননি ,সেটা নিয়ে কোন দিন তাকে আফসোস করতে দেখিনি ।কিন্তু ,বড় হবার সময় অনেক আন্টিকে দেখেছি একটা ভালো শাড়ির জন্য স্বামীর সাথে ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে যেতে ।আম্মা তখনো যেমন শান্ত ছিলেন , এখনো তেমন।এখনো ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে তার কোন প্রত্যাশা নেই ,দিলে ভালো ;না দিলে ক্ষতি নেই।তার সমস্ত আগ্রহ নাতিদের নিয়ে, ছেলে মেয়েরা নাতি-নাতনিদের কাপড় ঠিক মতো দিল কিনা সেটা নিয়েই বেশি ব্যাস্ত থাকেন ।আম্মার তাগাদাতেই আমাকে মার্কেটে ছুটোছুটি করতে হয়েছে এবার ,আর যে ধাক্কা-ধাক্কি শামলাতে হয়েছে তাতে করে এক দিনে ওজন কমেছে কম করে হলেও তিন কেজি ।আমাদের তিন ভাই-বোনের মাশাল্লাহ তিন তিনটে কন্যা ।আম্মার ইচ্ছা তারা একই রকম কাপড় পড়ে ঈদ করবে, ঠিক আমরা যেমন করতাম ।কিন্তু তার বয়স হয়ে গেছে ,শেলাই মেশিন নিয়ে বসা সম্ভব না ।আর তাছাড়া আজকালকার বাচ্চাদের এই সব পুরনো ডিজাইনে মন ভরবেনা ।কি আর করা ! একটার বয়স চার ,আরেকটার সাড়ে চার আর বড়টার আট। তিন কন্যার জন্য একই রকম কাপড় কিনতে আমার নাভীশ্বাস উঠে গেল , সি এন জি ড্রাইভার এখানে যাবেতো ওখানে যাবে না ,সাথে আছে ট্রাফিক জ্যাম ।দেখা গেল গাড়ি ভাড়াই গেল কাপড়ের দামের চাইতে বেশী ।
ঈদ শপিং নিয়ে আমার একটা গবেষণা আছে। যেমন , একটা শ্রেনী আছে যারা শবেবরাতের পর পরই ঈদের কেনা কাটা শেষ করে ফেলে , আর একটা শ্রেনী আছে যারা করে প্রথম রোযার দিকে ,আর বড়লোক শ্রেনী পাড়ি জমায় বিদেশে এবং সবচাইতে শেষের গুলো জম্মের আরাম প্রিয় তারা শবে-কদরের পরের দিন বের হয় যেন শহরের রাস্তা খালি পাওয়া যায় ।আমি সেই শেষ কাতারের মানুষ , যেই আউটলেটেই ঢুকি , একটাই কথা-আমাদের কালেকশনতো শেষ ম্যাডাম ,এখন আর নতুন ডিজাইন হবে না । তবু এক অজানা আনন্দে আমি মার্কেটে হাঁটতে থাকি ,ঈদের বাজারে একটা অন্যরকম আবেদন থাকে যা অন্য সময় থাকে না । গাউসিয়া মার্কেটে ঢোকার মুখেই ওয়েলকাম টিউন কানে এলো-পকেট,মানিব্যাগ সাবধান ।কি ভয়ংকর ওয়েলকাম টিউন স্বয়ং নিরাপত্তা কর্মীর মুখে ,আমি ভেতরে প্রবেশ করি না ,বাইরে দাঁড়িয়ে শাড়ি-চুড়ি দেখি আর দেখি ছেলেদের অহেতুক ঘোরাঘুরি ।ঢাকা শহরে একটি এলাকায় কয়টা শপিং মল করতে পারলে ভালো ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করা সম্ভব তা একমাত্র ধানমন্ডিওয়ালা্রাই বলতে পারবেন ।ঝিগাতলার রাস্তায় কোন রিক্সা চালানো সম্ভব না ,বিশেষ করে ইফতারীর আগ মুহূর্তে ।রাস্তার উপর যংযম ভাঙ্গনের যে অসংযমি পায়তারা চলতে থাকে রীতিমতোন ভয় লাগে আমার-মানুষ এতো খায় ! কেমনে খায় এতো কিছু???
যাই হোক কন্যাদের জন্য জামা কেনা হয়েছে , মনের মতোন রঙ না হলেও কাছাকাছিতো হয়েছেই ।দাদীর মুখে হাসি ,আমার স্বস্তি ।কিন্তু একি হায় !!!তারা তিন কন্যা ঈদের জামা পড়ে প্রজাপতি হয়ে এক তলা থেকে চার তলা উড়ে বেড়াচ্ছে ।এদের তো আবার এক ড্রেসে ঈদ হয় না ,একেক জনের তিনটা চারটা করে জামা।সকালে একটা পড়ে , দুপুরে পড়ে আর একটা ,ঘুমানোর আগেও দেখি কন্যারা জামা বদলিয়ে নতুন জামা পড়ে ঘুমাতে যায়।ঈদের জামা কাউকে দেখাতে হয় না-এই প্রাচীন ধারণা তাদের মোটেও ছুঁতে পারছেনা ।বার বার এসে আমাকে জিজ্ঞেসও করছেনা-আমাদের কেমন লাগছে বলোতো ?
এখনকার বাচ্চারা আসলে ঈদ বোঝে না ,তারা বোঝে একদিনের জন্য হলেও মা পড়ার জন্য বকবে না,ভারী ঝোলা কাঁধে নিয়ে স্কুলে যেতে হবে না।একদিনের জন্য হলেও তারা কে- এফ- সি বা বি- এফ- সিতে খেতে পারবে আর ছোট্ট গেমস জোনে খেলতে পারবে । বাসার টেবিল ভর্তি যতো পদেরই খাবার থাকুক , ওই এক চিলতে জায়গাতেই আটকে গেছে আমাদের বাচ্চাদের শৈশব।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৭ রাত ১:২৭