নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

“Those who have the privilege to know have the duty to act.”― Albert Einstein

মোস্তফা কামাল পলাশ

"সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে"

মোস্তফা কামাল পলাশ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে একজন মাছ ও ফল চোর ডা. মোঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভূমিকা

২৭ শে অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১:৪৩


শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার কালজয়ী সৃষ্টি "একাত্তরের দিনগুলি (পৃষ্ঠা ১৬১-১৬২)" বই এ বর্ণিত ২০১৮ সালের মাছ ও ফল চোর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এর প্রতিষ্ঠাতা ডা. মোঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী ।



বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল হলও অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সরাসরি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত একটি এবং একমাত্র স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১৮ সালের মাছ ও ফল চোর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এর প্রতিষ্ঠাতা ডা. মোঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী সেই বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের দুইজন প্রতিষ্ঠাতার একজন। অন্যজন হলও ডা. মোঃ আব্দুল মবিন।



==========================================================
মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পিছনের গল্প
==========================================================
‘অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির

ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর’

—জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

"২৫ মার্চ ১৯৭১। লন্ডন আইটিএনের রাতের খবর ‘নিউজ অ্যাট টেন’। টেলিভিশনের পর্দায় হঠাৎ আবির্ভূত হলেন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রায় সব নির্বাচনী এলাকায় বিজয়ী পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সুঠাম, দীর্ঘদেহী, উন্নত শির, চোখে-মুখে দৃঢ় প্রত্যয়; কিন্তু চিন্তিত। ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ফটকে দাঁড়ানো, ঠোঁটের কোনায় চেপে রাখা ধূমপানের পাইপ। ব্রিটিশ সাংবাদিকের প্রশ্ন, ‘মিস্টার রহমান, আপনার কি পাকিস্তানিদের হাতে মারা যাওয়ার ভয় নেই?’

তাত্ক্ষণিক উত্তর দিলেন বঙ্গবন্ধু, ‘না, আমাকে মারলে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু কমিউনিস্টদের মুখোমুখি হতে হবে।’

উল্লেখ্য, সত্তরের দশকে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানের শঙ্কায় ছিল ভয়ানক চিন্তিত ও তাড়িত। কয়েক মুহূর্ত পরেই উচ্চৈঃস্বরে গম্ভীর গলায় শেখ মুজিব বললেন, ‘সাত কোটি বাঙালিকে হত্যার জন্য কি পাকিস্তানিদের পর্যাপ্ত গুলি আছে?’

চমকিত হলাম বীরের সাহসী বক্তব্যে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার খবর প্রকাশ পেল ২৭ মার্চ বিবিসি সংবাদে। একই দিন জেনারেল ইয়াহিয়ার পাকিস্তানিদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণ উদ্ধৃতি করে করাচি থেকে কেনেথ ক্লার্ক লিখলেন, ‘জিন্নাহর একতার স্বপ্ন রক্তে ধুয়েমুছে গেছে।’ ২৭ মার্চে লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হলো শেখ মুজিবের পক্ষে তরুণ বাঙালি মেজর জিয়ার বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। শেখ মুজিবুরের তুলনায় খর্বকায়; কিন্তু সাহস ও দৃঢ়তার চিহ্ন মুখমণ্ডলে। তাঁর উচ্চারিত দুই শব্দ—‘ডব জবাড়ষঃ’ শুনে চমকিত হলেন বিলেতের বাম রাজনৈতিককর্মীরা। দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, পাকিস্তানের আয়ু শেষ হয়ে গেছে। নতুন দেশ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম আসন্ন। একাধারে প্রসব বেদনার যাতনা, অপরপক্ষে শুভ সংবাদের জন্য অপেক্ষমাণ প্রবাসী বাঙালিরা। সঙ্গে সঙ্গে আমি ফোন করলাম মিডলসবরোতে আমার বন্ধু ডা. মাহমুদুর রহমান বাবলু ও তার স্ত্রী ডা. সাবেরাকে। বাবলুর মা মিসেস জহুরা রহমান খুবই মিশুক, দানশীল মহিলা এবং সুগায়িকা; বাবলুর বাবা অধ্যাপক লুত্ফর রহমান ছিলেন বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পরিচালক এবং প্রখ্যাত যক্ষ্মারোগ বিশেষজ্ঞ। অতীব নিরীহ ভদ্রলোক, ঠিক বাবলুর মার বিপরীত। তাঁরা উভয়ে আমাকে সন্তানসম স্নেহ করতেন। তাঁরাই পরে ১৯৭২ সালে সাভারে তাঁদের পুরো জমি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপনের জন্য দান করেছিলেন।

দ্রুত যোগাযোগ করলাম ডা. মসিহুজ্জামানের সঙ্গে। মসিহ খুব ভালো ছাত্র ছিল। মসিহ ও আমি একই দিনে একই সঙ্গে বিলেতে গিয়েছিলাম। মসিহর বাবা পুলিশ ইন্সপেক্টর আকতারুজ্জামান আমার পাকিস্তানি পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাঁর সিদ্ধেশ্বরীর টিনের বাড়িতে বেশ কিছুদিন ভবিষ্যতের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে বসবাস করেছেন। মসিহর ছোট ভাই কর্নেল খাইরুজ্জামান ফিলিপাইন ও মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন।

আমি বাঙালি ডাক্তারদের সঙ্গে প্রতিদিন রাত ১২টা পর্যন্ত ফোনে কথা বলতাম। সবাই চিন্তিত, উত্কণ্ঠিত। ১৯৭১ সালে এক হাজারের বেশি বাঙালি ডাক্তার আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন কাউন্টিতে কর্মরত ছিলেন, মূলত উচ্চশিক্ষার জন্য তাঁরা ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে আগত। এ ছাড়া এক লাখের বেশি বাঙালি ছিল বিভিন্ন পেশার এবং হোটেল-রেস্টুরেন্টের কর্মচারী, যাদের বেশির ভাগই সিলেটের। বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র ছিল কয়েক হাজার। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন তাদের মধ্যে অন্যতম। লন্ডন, গ্লাসগো, এডিনবরা, ম্যানচেস্টার, বার্মিংহাম, কভেন্ট্রি, লিডস, নিউ ক্যাসেল, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ অন্যান্য ছোট-বড় শহরে শনি-রবিবার পূর্ব পাকিস্তানের চিকিত্সক, ছাত্র ও অন্য পেশাজীবীরা জড় হতে থাকলেন শহরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে।

সম্ভবত ২৭ মার্চ ছিল শনিবার। লন্ডনে সবচেয়ে বেশি ভিড় হতে থাকল পুরনো কমিউনিস্টকর্মী তাসাদ্দুক হোসেনের দ্য গ্যানজেস রেস্টুরেন্টে। এটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্রদের আড্ডাখানা। এখানে শুক্রবার সন্ধ্যা এবং শনি ও রবিবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনেক সদস্য সপরিবারে ভারতীয় খাবারের স্বাদ নিতে আসতেন।

৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে পুরান ঢাকার সর্বত্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মমতার চিত্র প্রকাশ করল তাদের রিপোর্টার সাইমন ড্রিংয়ের বরাতে, পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় শিরোনামে। টেলিগ্রাফের সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানিরা স্তম্ভিত হয়ে যায়। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে পরিচিত ও নিকটজনের চিন্তায়। ভাবের আতিশয্যে হাইড পার্কে কয়েকজন বাঙালি পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমিও তাদের অনুসরণ করি। আমরা রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হই।

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঢাকা শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার আগে ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও শেখ মুজিবের আলোচনা পর্যবেক্ষণের জন্য আগত বিভিন্ন দেশের মিডিয়া ও সাংবাদিকদের ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দেন। বিবিসির মাইকেল ক্লেটন ও ডেইলি টেলিগ্রাফের সাইমন ড্রিং ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ছাদে লুকিয়ে থাকেন ঢাকার ইংরেজি দৈনিক দ্য পিপলের সম্পাদক আবিদুর রহমানের পরামর্শে। পরে অ্যাসোসিয়েট প্রেসের ফটোগ্রাফার মিশেল লরেন্টকে নিয়ে সাইমন ড্রিং ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫ মার্চ রাতে বর্বরতা ও নির্মমতার স্বাক্ষরের চিত্র ধারণ করে সুকৌশলে পরের দিন ব্যাংকক পৌঁছে সেখান থেকে ডেসপ্যাচ পাঠান, যা ৩০ মার্চ ১৯৭১ ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হয় প্রথম পৃষ্ঠায়, বড় শিরোনামে।

স্মরণ প্রয়োজন, শেখ মুজিবের ১৯৭১-এর ৭ই মার্চের বিখ্যাত ভাষণ—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,’ ৯ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানীর ‘স্বাধীনতার দাবিতে আপসহীন’ থাকার আহ্বান এবং ১২ মার্চ ময়মনসিংহে কৃষক সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর স্বাধীনতার পক্ষে অবিচল থাকার পুনঃ আহ্বানকে বিলেতের বাঙালি পেশাজীবী ও ছাত্ররা খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর পাকিস্তানকে ‘ওয়ালাইকুমস সালাম’ খুব বেশি উত্তাপ সৃষ্টি করেনি। এসব বক্তব্যকে তারা দরাদরির রাজনৈতিক স্টান্ট বলে ধরে নিয়েছিল। তবে এবার প্রবাসী বাঙালিরা ধাক্কা খেল আইটিএন, বিবিসি এবং টাইমস ও টেলিগ্রাফের সচিত্র সংবাদে।

অধিকতর সংবাদ প্রত্যাশায় তারা জড়ো হতে থাকে সপ্তাহ শেষে শনি-রবিবার ৩ ও ৪ এপ্রিল লন্ডনের হাইড পার্ক কর্নারে। জমে ওঠে বক্তৃতা ও পাকিস্তানিদের প্রতি ধিক্কার। অধিকতর সংবাদ সংগ্রহ ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে লন্ডনের পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-শিক্ষক, রাজনৈতিককর্মীদের ধারণা ও চিন্তার তথ্য জানার জন্য স্কটল্যান্ডের লানাকশায়ার থেকে ল হাসপাতালের ডা. মবিন ও আরো অনেকে এসে যোগ দেয় হাইড পার্কের সমাবেশে। মবিন ঢাকার ছেলে; কিন্তু পাস করেছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ থেকে। ভালো ক্রিকেট খেলে। তার মেজো ভাই হাসনাত আব্দুল হাই তখনকার দিনে সব উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত পরিবারের একান্ত কাম্য, অত্যন্ত আকর্ষণীয় পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য, একজন সিএসপি। মবিনের এক ভাইপো মাসুদ বিন মোমেন বর্তমানে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত।

ভাবের আতিশয্যে হাইড পার্কে কয়েকজন বাঙালি পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমিও তাদের অনুসরণ করি। আমরা রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হই।

ব্রিটেনে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন

এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে সম্ভবত ১০ তারিখে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ১০০ জন পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি চিকিত্সক লন্ডনের কিংস ক্রসের কাছে এক কমিউনিটি হলে মিলিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সাহায্য-সহযোগিতার উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সংক্ষিপ্ত নাম বিএমএ (BMA) বিধায় নবগঠিত বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সংক্ষিপ্ত নাম ঠিক করা হয় বিডিএমএ (BDMA)। পাঁচ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি মনোনীত হয়। কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন লন্ডনের উপকণ্ঠ সারেতে কর্মরত চক্ষু চিকিত্সক আবু হেনা সাইদুর রহমান, যিনি ‘খসরু ভাই’ নামে বেশি পরিচিত। রংপুরের এম এ হাকিম, এমআরসিপি সহসভাপতি। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বা দ্বিতীয় ছাত্রসংসদের সহসভাপতি আলতাফুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক। আলতাফ নিকটবর্তী ল্যাংকাশায়ারের একটি শহরে ডাক্তারি করতেন। আলতাফ পরবর্তী সময়ে ওই শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। আলতাফই ব্রিটেনে নির্বাচিত প্রথম বাংলাদেশি মেয়র।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন গঠনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন মোস্তফা ও তাঁর স্ত্রী ডা. মমতাজ বেগম কহিনুর। তাঁরা সবাই স্কটল্যান্ডে থাকতেন। অন্য উদ্যোগী চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা চিকিত্সক কাজী কামরুজ্জমান উলভার হ্যাম্পটনে অ্যানেসথেসিয়ায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। সদস্য নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রসংসদের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ডা. এম এ মবিন। আমাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

আমি ইয়র্ক শহরে জেনারেল ও ভাসকুলার সার্জারির রেজিস্ট্রারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে লন্ডনে এসেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করার উদ্দেশ্যে। আস্তানা গেড়েছি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সির ছাত্র রকি নুরুল আলম, লুিফ জাহান চৌধুরী ও মাহবুবদের সঙ্গে, তাদের উত্তর লন্ডনের ক্রিকলউডের বাসায়।

স্থির হয় প্রত্যেক সাধারণ সদস্য চিকিত্সক মাসে ন্যূনতম ১০ পাউন্ড চাঁদা দেবেন ব্যাংক স্ট্যান্ডিং অর্ডারের মাধ্যামে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে সাহায্য করার লক্ষ্যে। কয়েকজন অনেক বেশি চাঁদা দিতেন। স্কটল্যান্ডের ডা. কাজী ফজলুল হক এবং সারে/সাসেক্সের ডা. এম বখত মাজমাদার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। উভয়ের বিদেশি স্ত্রী। ম্যানচেস্টার এলাকার ড. সালেহ আহমদ, নুরুল আলম, জর্জিসুর রহমান, সুশান্ত বিশ্বাস, খুলনার তৈয়বুর রহমান, নজরুল (যিনি ১৯৭২ সালে লন্ডনে শেখ মুজিবুর রহমানের পিত্তথলি অপারেশনে প্রধান সহকারী ছিলেন), চট্টগ্রামের আব্দুর রহিম, চক্ষু চিকিত্সক নুর হোসেনসহ আরো অনেকে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যাপক উত্সাহ ও সহযোগিতা দেন নিউ ইয়র্কের চিকিত্সক ডা. খন্দকার মো. আলমগীর, যিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ঢাকা শহরে একটি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য মিরপুরে তাঁর এক খণ্ড জমি ও দুই কোটি টাকা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে তিনি দান করেছেন।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাকাউন্ট খোলা হয় মিডল্যান্ড ব্যাংকে, যা বর্তমানে এইচএসবিসি নামে পরিচিত।

পরের সপ্তাহে এক জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে যত দ্রুত সম্ভব, মে মাসের মধ্যেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. এম এ মবিন নিজ খরচে কলকাতা যাবেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য।

পরের সপ্তাহে জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, যত দ্রুত সম্ভব, মে মাসের মধ্যেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. এম এ মবিন নিজ খরচে কলকাতা যাবেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য। সদস্যদের অনুরোধ করা হয় ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত উদ্বাস্তুদের কাপড়চোপড় ও ওষুধপত্র দিয়ে সাহায্য করার জন্য। সাড়াও পাওয়া গিয়েছিল যথেষ্ট।

হাইড পার্ক কর্নারে পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে পুড়িয়ে দিয়ে আমরা তখন রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক। যোগাযোগ করি ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তরে। সেখান থেকে আমাদের দেওয়া হয় ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকের’ একটি এক পৃষ্ঠার প্রত্যয়নপত্র। সেটা দেখিয়ে জরুরি ভিত্তিতে সংগ্রহ করি ভারতীয় ভিসা। নয়াদিল্লির উদ্দেশে যাত্রার আগের দিন হঠাৎ ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে সাদা পোশাকের এক অফিসার এলেন। আমাদের সতর্ক করে জানালেন, যারা বাংলাদেশের পক্ষে সক্রিয় তাদের খোঁজখবর নিচ্ছে পাকিস্তান দূতাবাস। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিলেতের ‘হোম’ মিনিস্ট্রিকে অনুরোধ করেছেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত।

আমরা লন্ডন হিথরো বিমানবন্দর থেকে সিরিয়ান এয়ারলাইনসে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি সম্ভবত ১৬ মে। এক ঘণ্টার বিরতি দামেস্ক বিমানবন্দরে। স্বল্পবিরতির কারণে আমরা প্লেন থেকে নামলাম না। এক ঘণ্টার জায়গায় চার ঘণ্টা পার হলো; কিন্তু প্লেন ছাড়ে না। সবাই উসখুস করছে, বিরক্ত। আমি বিমানবালাকে ডেকে প্রশ্ন করলাম, দেরি কেন হচ্ছে? নীরস ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বিমানবালা আমাদের দুজনকে দেখিয়ে জবাব দিলেন, ‘আপনাদের কারণে সিরিয়ান এয়ারলাইনসের দামেস্ক থেকে নয়াদিল্লি যাত্রা বিঘ্নিত হয়েছে। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের দুই নাগরিককে গুরুতর অপরাধের বিচারের জন্য পাকিস্তানে ফেরত নিয়ে যেতে চাইছে। দামেস্ক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানাল, প্লেনে কোনো পাকিস্তানি নাগরিক নেই। তারা আরো জানাল, ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যয়ন অনুযায়ী এই দুজন রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক, পাকিস্তানি নন। পরের দিন আমরা দিল্লি পৌঁছি।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পরামর্শ দিল, ভারতীয় পুলিশের অনুমতি ছাড়া কলকাতার বাইরে না যেতে, কলকাতার আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা ভালো নয়। আরো বলল, কয়েক দিন কলকাতায় থেকে ফিরে যেতে, বিলেতে ওষুধপত্র ও কাপড়চোপড় যা সংগৃহীত হবে তা ভারতীয় দূতাবাসে পৌঁছে দিলে তারা ভারতীয় জাহাজে করে এনে শরণার্থীদের মধ্যে বিতরণ করে দেবে, চাইলে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পৌঁছে দেবে।

আমরা বোকার মতো সরল মনে কলকাতা পুলিশের কাছে আগরতলা ও আসাম যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করি। দুই দিনের মধ্যে অনুমতি পেয়ে যাব আশ্বাস দিলেও চার দিনেও অনুমতিপত্র না পাওয়ায় বিষণ্ন হয়ে পড়ি। আমাদের দুঃখের কথা শুনে সাদেক ভাই বললেন, ‘বোকামি করেছ, পুলিশের কাছে কেন গিয়েছ, কখনো তোমরা অনুমতি পাবে না। নাম বদলে টিকিট কেটে সোজা আগরতলা চলে যাও। সেখানে খালেদ মোশাররফের সাক্ষাৎ পাবে।’ সাদেক খান এজেন্টের মাধ্যমে মি. জেড চৌধুরী ও মি. মবিন নামে দুটি টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন।

সপ্তম দিনে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে কলকাতা থেকে আগরতলা গেলাম। পূর্ব পাকিস্তানের মহকুমা শহরের চেয়েও ছোট। দেখা হলো ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির সঙ্গে। ছাত্রজীবনে আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম বলে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না। তাই একটু শঙ্কিত হয়ে তাকাতেই মণি বললেন, ‘ডাক্তার, আমি জানতাম আপনি আসবেন, কমিউনিস্টরা লন্ডনে বসে থাকবে না।’ হাসিমুখে ভালো ব্যবহার করলেন। দেখা হলো চট্টগ্রামের এম আর সিদ্দিকী সাহেবের সঙ্গে। তিনি ওই রাতে তাঁদের সঙ্গে আগরতলা সার্কিট হাউসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। পরের দিন ভোরেই রওনা হলাম দুই নম্বর সেক্টরের উদ্দেশে মেলাঘরের পথে। সাক্ষাৎ হলো মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর জিয়া, সফিউল্লাহ, মীর শওকত আলী ও অন্যদের সঙ্গে। যুদ্ধে ফিল্ড হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বললাম। প্রথমে রাজি না হলেও আহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকায় মেজর খালেদ মত বদলাতে বাধ্য হন। দুই মাসের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দেহরক্ষী হাবুল ব্যানার্জির আনারসবাগানে শুরু হয় ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’।"

ডা. মোঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী
ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র

সুত্র: দৈনিক কালেরকন্ঠ, ৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৭


১) মামলার পর এবার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে হামলা ও ভাঙচুর

২) Dr Zafrullah Chowdhury accused of stealing fish, fruit

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +৭/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ২:৩২

রাজীব নুর বলেছেন: বেশ গোছানো পরিপাটি লেখা।
আপনি বরাবর'ই সুন্দর লিখেন। ভাল বিষয় নির্বাচন করে।

২| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৮

হাবিব বলেছেন: সত্য মুক্তি পাক মিথ্যা ধ্বংস হোক।

৩| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৫:০০

স্বপ্নের শঙ্খচিল বলেছেন: এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
.........................................আমাদের দারিদ্র মুক্তির সংগ্রাম এখনো শেষ হয় নাই ।

৪| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৮:৫২

কে ত ন বলেছেন: একজন রাজাকার চিরদিনই রাজাকার (শাহরিয়ার কবির বাদে), কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নন। কাজেই ৭১ সালে কে কি করেছে, সেটা বিবেচ্য না। এখন সে আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে কিনা, সেটাই বিবেচ্য। তার কোন ভূমিকার কারণে যদি আওয়ামী লীগ খতির সম্মুখীন হয়, তবে তিনি যত বড় খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাই হন না কেন, প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন 'রাজাকার'

৫| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৯:২৮

পদ্মপুকুর বলেছেন: কে ত ন বলেছেন: একজন রাজাকার চিরদিনই রাজাকার (শাহরিয়ার কবির বাদে), কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নন। কাজেই ৭১ সালে কে কি করেছে, সেটা বিবেচ্য না। এখন সে আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে কিনা, সেটাই বিবেচ্য। তার কোন ভূমিকার কারণে যদি আওয়ামী লীগ খতির সম্মুখীন হয়, তবে তিনি যত বড় খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাই হন না কেন, প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন 'রাজাকার'

৬| ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ৮:০১

সোহানী বলেছেন: উদ্ভুত এক উটের পিঠে চলছে স্বদেশ..................

৭| ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ১১:০৯

খাঁজা বাবা বলেছেন: আওয়ামীলিগের বিপক্ষে কথা বললে অতি শিঘ্রই তাদের রাজাকার ট্যাগ দেয়া হবে। আবার তারা রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিনত হবে।

৮| ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১২:৫২

ঢাবিয়ান বলেছেন: এত হয়রানির পরও তিনি ভয় পেয়ে নিজের অবস্থান থেকে এক বিন্দু সরে যাননি। এরাই দেশের সুর্যসন্তান।

৯| ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১২:২৫

দেশ প্রেমিক বাঙালী বলেছেন: এখানে কোনো অনলাইন মুক্তিযোদ্ধাকে যে দেখতে পাচ্ছিনা এই ধরুন চাঁদগাজী, কলাবাগান ইত্যাদি ইত্যাদি অনলাইন মুক্তিযোদ্ধাদের। তাদের বক্তব্য জানতে এবং লেখাটি সঠিকতা নির্ণয় করতে আহবান করছি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.