ছোটবেলা থেকেই বছরে অন্তত একবার গ্রামের বাড়ী যাওয়া হতো। ওই একটি বারের জন্যে যাওয়ার জন্য দিনের পর দিন মুখিয়ে থাকতাম- কবে যাবো। এখনও মনে আছে কোন এক সকালে তিস্তায় করে ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে দুপুরে জামালপুর পৌছালাম। তারপর রিকশায় করে একটি ঘাটে নেমে সবাই বসে আছি লঞ্চের জন্যে। লঞ্চ মানে ভটভটি নৌকা- একটি মাঝারী মাপের নৌকায় ইঞ্জিন লাগিয়ে সেটা ভটভট করে চলতো বলেই নাম ভটভটি। সেই ভটভটিতে যাওয়ার পথে খরকা বিলের বিশালতায় জীবনের প্রথম নিজের চোখে রংধনু দেখি। মাগরিবের আজানের আগেই পৌছে যাওয়ার তাড়ায় ভটভটির মাঝির শেষ বেলায় গতির ঝড় তুলে যখন মাদারগঞ্জ ঘাটে (উপজেলার কাছে) এসে পৌছায়, তখন দিনের আলো প্রায় নিবতে বসেছে। সেখান থেকে গরুর গাড়িতে করে নিজেদের বাড়ী পৌছে সারাদিনের যাত্রার ধকল সামলিয়ে সবাই ঘুমের অপেক্ষায়। মুরুব্বীরা শোনালেন- "তোমরা তো তাও ভটভটি পাইছো, আমরা একসময়ে হেটেই যেতাম জামালপুর শহর। সকালে নাস্তা করে বের হলে আসরের পরপরই পৌছে যেতাম।" বোঝো!
আরও কিছুদিন পরের ঘটনা, শুনতে পেলাম জামালপুর থেকে নাকি এবার মাদারগঞ্জে বাসে যাওয়া যাবে। এবারের যাত্রায় ট্রেন থেকে নেমেই বাসস্ট্যান্ডের দিকে দৌড়। সেই বাসযাত্রাও ভয়াবহ অভিজ্ঞতা! একবার না উঠলে বোঝানো সম্ভব না। ঝিনাই নদীতে একটা ছোট্ট ফেরী পার হওয়ার পর থেকে শুরু হয় দোলনার দুলুনী। সামনের দিকে যাত্রার কথা থাকলেও সেই বাস বিনি পয়সায় ডানে বায়ে ঘোরানোর অভিজ্ঞতাও দান করে যাচ্ছে দেদারছে। মাঝে কিছু বেইলী ব্রিজ, আর বাকী জায়গাগুলোতে রাঙামাটির মতো পাহাড়ের রাস্তায় চড়ার কসরত সেই বাস ড্রাইভারের। ঝাড়া সাড়ে চার ঘন্টার সেই ভয়ানক বাস জার্ণির পর যখন মাদারগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে দাড়ালো, বাস থেকে নেমে হেটে দাড়াবার এনার্জিও অনেকের ছিলো না। মুরুব্বীরা এবার শোনালেন- "বুঝলা, ব্রিটিশ আমল থেকেই মাদারগঞ্জ অবহেলিত। রাস্তাঘাট তো হবার নয়"
এর পরের বছরগুলোতে সেই বাসযাত্রার বিবিধ অভিজ্ঞতা প্রতি বছর। একবার সব যাত্রী নিয়েই ডান দিকে কাত হয়ে গেলো। আর একবার "দাতভাঙগা" নামের একটি জায়গায় এসে জানা গেলো সামনের ব্রিজ ভেঙ্গে পড়েছে। দাতভাঙ্গা নামের জায়গা থেকে মাদারগঞ্জ পর্যন্ত কাদার রাস্তায় হেটে যাবার অভিজ্ঞতা এখনও চোখের সামনে ভাসে। মনে আছে আমার মতো ছোট শিশুও দীর্ঘ হাটা শেষ করে মাদারগঞ্জ বাজারের এক দোকান থেকে একগাদা খাওয়া হাপুস হুপুশ করে শেষ করেছি। মাদারগঞ্জ বাজার থেকে অবশেষে রিকশায় চড়ে বাড়ী আসি। মুরুব্বীরা বললেন- " নদীভাঙ্গা এলাকা, চর এলাকা, রাস্তা হবার নয়, ব্রিজও হবার নয়। আমাদের এমনই থাকতে হবে"
স্কুল শেষের সময় থেকে বেশ কয়েক বছর আর বাড়ি যাওয়া হয় নি। এবার খবর পেলাম জামালপুর থেকে মাদারগঞ্জ যেতে নাকি কোন ফেরী পার হতে হয় না। বাহ, বেশ উৎসাহ নিয়ে এবার গেলাম জামালপুর থেকে মাদারগঞ্জ। এবার দুলুনীর বদলে ঝাকি খাবার পালা। তাও আমরা বেশ খুশী। যাওয়া তো যাচ্ছে। পৌছানোর টাইম বিশেষ কমে নাই। মুরুব্বীদের এবারের ভাষ্য- "ঝাকুনি থামবেনা, মাদারগঞ্জবাসী তো একটায় আটকে আছে, এলাকাবাসী সিদ্ধান্ত তো বদলায় না!" বাবা জোর গলায় বললেন- "মাদারগঞ্জবাসী ভুল সিদ্ধান্ত নেয় না।" একজন মুরুব্বী হেকে উঠলেন- "ঝাকুনী খেতে থাকো"।
সময়ের আবর্তনে জীবন জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠি ঢাকা নামের শহরের বাতাসে। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বন্ধুরা যখন নিজেদের এলাকার খোজখবর দেয়, তখন মনটা আনচান করে উঠে। জন্মভুমি , শিক্ষাভুমি আর কর্মভুমি সহ জীবনভুমি ঢাকা হলেও শিকড় টা তো পড়ে আছে মাদারগঞ্জে।
অনেক বছর পর জরুরী প্রয়োজনে বাড়ী যাওয়ার প্রয়োজন হলো- শোনা গেলো এখন নাকি সরাসরি ঢাকা থেকে মাদারগঞ্জ বাস যায়, এমনকি রাতের গাড়ীও নাকি আছে! রাতের গাড়ীতে উঠলে সকালে নামিয়ে দিবে নিশ্চয়ই, এমন ভাবনা থেকে রাতের বাসে উঠে ঘুম দিই। রাত তিনটায় ঘুম ভাঙিয়ে বাসের লোক জানালো মাদারগঞ্জ চলে এসেছে। আমাকে রাত তিনটায় নামিয়ে দিয়ে বাস চলে গেলো সামনের দিকে। ঢাকার আবহাওয়ায় গড়ে ওঠা এই মানুষটার মনে রাত তিনটার ঢাকার রাস্তার কথা মনে পড়ে গেলো, সাথে সাথে ভয়ে আত্নারাম কেপে উঠলো। মাদারগঞ্জে এই নির্জনে রাত তিনটায় কি বেঁচে বাড়ী যেতে পারবো? ভয়ে ভয়ে এককদম দুই কদম সামনে হেটে চললাম। কই, ওই তো দেখা যাচ্ছে একটা ছোট্ট দোকানদার, মহা আনন্দে রেডিও শুনছে, চোখে মুখে ভয়ের ছাপ নাই তো! দোকানের সামনে গিয়ে শুনলাম রিকশা পাওয়া যাবেই। কথা প্রসঙ্গে গভীর রাতের বিভিষিকার কথা দোকানদারকে বলতেই হাহা করে হেসে উঠলো মধ্যবয়সী দোকানদার। তিনি বললেন চুরি/ছিনতাই এসবের কথা অন্য এলাকার লোকমুখে শোনা গেলেও মাদারগঞ্জে এর প্রশ্নই ওঠে না। দোকানদার নিজে তিনবছর ঢাকায় একটি গার্মেন্টস এ থাকলেও এলাকায় চলে এসেছেন শান্তির জন্য। "আপনে সারারাত হেটে বেড়ান না, কোন সমস্যা হবে না" শুনে চমৎকৃত হলাম। এরই মধ্যে শিষ দিতে দিতে এর রিকশা চলে আসলো- বাসের হর্ণ শুনে নাকি সে এসেছে কাওকে নেয়ার জন্যে। আমাকে নামিয়ে দিয়ে সে একা ফেরৎ আসবে, ভয় লাগবে না? প্রশ্নটা শুনে সেও হেসে উঠলো- যেন প্রশ্নটা বোকার মতো করা হয়েছে। "রাতে রিকশা চালানোর মতো আনন্দ আর আছে নাকি? রোদ থাকে না।" অর্থাৎ রোদের তাপই তার একমাত্র কষ্টের কারণ! (মনে পড়ে গেলো ঢাকার একটি রাতের কথা। রাত বারোটার দিকে গুলিস্তান থেকে মালিবাগ পর্যন্ত এক রিকশা আমাকে প্রায় অর্ধেক ভাড়া দিয়ে উঠিয়ে এনেছিলো। রিকশা চলার সময় সে কারণটা বললো যে, সে বাসায় ফেরার সময় অন্তত একজন সঙ্গী খুজছিলো যাতে তার একা আসতে না হয়। দিনের অর্জিত আয়টুকু কাওকে দিয়ে দিতে হয় নাকি এই ভয়েই সে কাতর ছিলো। )
এরপরে কি আর টেনশন থাকে!
আরও কিছু বছর পরের ঘটনা। আবারও বাড়ি যাওয়ার জরুরী তলব। নব্বইএর দশকে ভটভটিতে চড়া ছোট্ট সেই বালকটি আজ নিজেরই ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নাতি নাতনী প্রথমবারের মতো বাড়ী যাচ্ছে এই উত্তেজনায় আবার বাবা তার মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্গী ছোট গাড়ীটিকে সাজাচ্ছেন। রাস্তায় সম্ভাব্য ঝাকুনীতে গাড়ী ও বাচ্চাদের কষ্ট হবে বললেও বাবা আমার দিকে বিষদৃষ্টি হানলে রণে ভঙ্গ দিই। মাদারগঞ্জের পথে সকালে রওয়ানা হলে মাগরিবের ওয়াক্তে পৌছতে হবে বউকে এই ধারণা দিয়েও রাখি। কোন এক শুক্কুরবার সকালে রওয়া হয়ে আশুলিয়া রোডের ঝাকুনীতে বলে উঠলাম "এই শুরু হলো"। কিন্তু আশুলিয়া পার হওয়ার পর এলেঙ্গা পেরিয়ে মধুপুরের পথেও যখন ঝাকুনী শুরু হলো না, তখন বউকে বললাম "জামালপুরের পর বুঝবা। " কিন্তু জামালপুর পার হয়ে মাদারগঞ্জের পথে যেতে গিয়ে অবাক হতে হলো বেইলী ব্রিজগুলো নাই দেখে। সেগুলোর জায়গায় অসম্ভব সুন্দর সুন্দর সব নতুন ব্রিজ। রাস্তার একপাশে মাটি ভরাটের কাজ চলছে- এই রোড নাকি বিশ্বরোড হয়ে যাবে। আমার মাদারগঞ্জের রোড বিশ্বরোড হয়ে যাবে!
একটি মাত্র ঝাকুনী ছাড়া যখন বাড়ীর উঠোন পর্যন্ত পৌছে গেলাম, তখন দুপুরের খাবার সময় কেবল শুরু হচ্ছে! পদে পদে আমার সব ভবিষ্যতবানী ও সাবধানবানী যখন বউএর কাছে মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে গেলো তখন বুকটা ভরে উঠলো। বাবা গর্বভরে তার নাতি নাত্নীদের মাদারগঞ্জের সবুজ দেখাচ্ছেন। তার গলায় সেই একই জোর আওয়াজ- মাদারগঞ্জের লোক ভুল সিদ্ধান্ত নেয় না।
বিকালে বউকে নিয়ে বের হলাম ছোটবেলার দেখা মাদারগঞ্জ দেখাতে। মনে আছে- গাবেরগাও এর কিছু পরেই ইটের রাস্তা শেষ হয়ে যেতো। চাচাতো ভাইয়ের সাইকেলে রাস্তার এই শেষ মাথায় এসে হাটা দিতাম নদী দেখার জন্যে। এবার অটোতে করে চলা শুরু করলাম, কি আশ্চর্য, গাবের গাও ছেড়ে গাড়ী চলছে তো চলছেই, পাকা রাস্তাই তো শেষ হয় না! অটোতে ঝাড়া আড়াইঘন্টা চারপাশ চষে বেড়ালাম, এক ফুট রাস্তাও পাকারাস্তা ছাড়া পেলাম না। অথচ চারপাশের মাঠের সবুজ আছে আগের মতোই।
সেই মুরুব্বীদের ভাষায় -ব্রিটিশদের চোখে না পড়া, নদীপাড়ের অঞ্চল, অবহেলিত চরাঞ্চল আজ বদলে গেছে জাদুর ছোঁয়ায়। সহজসরল কৃষকের জনপদ মাদারগঞ্জ আজকে গর্ব করবার মতো উন্নত হয়েছে। এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পেয়েছে ডিজিটাল আলো। আমার নতুন দেখা ভাগিনা, ভাতিজাদের বিশ্ব নিয়ে ভাবনা ঢাকার উন্নত স্কুল কলেজের থেকে মোটেও কম উন্নত না। বরং ক্ষেত্রবিশেষে ওদের চিন্তার গভীরতা আমাকেই অবাক করে দিয়েছে। বাবার মুখে বলা কথা "মাদারগঞ্জবাসী ভুল সিদ্ধান্ত নেয় না।" আজ সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।
ছাত্র বয়সে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়া হলের বন্ধু গর্ব করে বলেছিলো- তুমি মীর্জা আজমের এলাকার , তুমি খুব ভাগ্যবান।
৯১ এর নির্বাচনে ৩০০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে সর্বকনিষ্ট আমার শিকড়ের এলাকার সাংসদ, পত্রিকায় পড়ে গর্ব লেগেছিলো। পরপর দুটি সংসদের প্রথম বিল উত্থাপন করেছিলেন আমার শিকড়ের এলাকার সাংসদ এটাও গর্বের বিষয় ছিলো আমাদের মতো দ্বীপান্তরিত ঢাকাবাসীর জন্য। যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আজম ভাই হয়েছিলেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা আমাকে কংগ্রেচুলেট করেছিলো - যেহেতু আমার বাড়ী মাদারগঞ্জ এজন্যে, সেদিনের কথা এখনও ভাবলে ভালো লাগে। বছরের পর বছর ধরে নানা প্রতিকুলতাকে জয় করে আমার শিকড়ের এলাকাকে আধুনিক করে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আমাদের মুখ যেভাবে উজ্জ্বল করেছেন সেটা প্রকাশ করবার ভাষা আমাদের নেই। আজ আজম ভাইয়ের ডাকে মহামান্য রাষ্ট্রপতিও আনন্দচিত্তে আমাদের জেলায় যান। এই অপরিসীম আনন্দ রাখবার জায়গাও আমাদের নেই।
জীবন ও জীবিকার কাছে পরাজিত হয়ে শিকড় থেকে দূরে সরে গেছি। শিকড়ের টানে বছরে দুই একবার বাড়ি যাওয়া ছাড়া আমাদের হয়তো কিছুই করার নেই। কাগজ কলমের পরিচয়পত্রের লিস্টিতে সেই ঢাকাবাসী হয়েই দিন কাটাতে হয়। কিন্তু সেই শিকড়ের কাছে ছুটে যাওয়াকে মধুময় ও মহিমাম্বিত করবার জন্যে যার সুদীর্ঘ বছরের আত্নত্যাগে আজ মাদারগঞ্জ আর জামালপুর প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে- "মাদারগঞ্জ আমার শিকড়" এটা গর্বের সাথে বলতে পারছি, সেই মীর্জা আজম ভাই আমাদের শিকড়ের অহংকার, আমার অহংকার।
(দীর্ঘ দিন পর মাদারগঞ্জ গিয়ে অসাধারণ সব পরিবর্তন দেখে একান্তুই কিছু কথা আমার মন জুড়ে বের হয়ে এলো।)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৬ রাত ৮:২৩