somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেগাবাইট ডাটায় পরিপূর্ণ জীবন!

১২ ই মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৩:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সিনেমা অনেক সময় জীবনের কথাই বলে। কিন্তু কিছু আজগুবি সিনেমাকে কখনই জীবনের অংশ হিসেবে ভাবার অবকাশ ছিলো না, যেমন ধরুন একটি অ্যানিমেশন সমৃদ্ধ সিনেমায় দেখিয়েছিলো নায়ক/নায়িকা ভিডিও গেমসের মধ্যে ঢুকে যায়, আর চরিত্রগুলোর সাথে লড়াই করে। হালের শাহরুখ খানের ছবি রা ওয়ানে দেখিয়েছিলো ভিডিও গেমসে চরিত্রের সাথে বাস্তব দুনিয়ার মানুষ মিলে মিশে একাকার। গাঞ্জাখুরি মনে হলেও ঘটনা গুলো আস্তে আস্তে কিন্তু বাস্তব রূপ ই পাচ্ছে আমাদের জীবনে।

আমার ঘনিষ্ট বন্ধুর কথা দিয়ে শুরু করি। বন্ধপত্নীর অপারেশনের পর কেবিনে বউয়ের সাথে ছিলো সে। ফেসবুকে বউয়ের অবস্থা, পাশের বেডের রুগীর অবস্থা, বউয়ের কোকানী, রোগির দেখাশুনা করতে তার অনুভুতি, কষ্ট সবই মিনিটে মিনিটে আপডেট পাচ্ছিলাম। আপিস শেষ করে হসপিটালের কেবিনে গিয়ে দেখি, মহা অবস্থা! বন্ধু পত্নী কো কো করে কোকাচ্ছে আর বেডের এক কোণে বসে বন্ধু ল্যাপটপে বিভিন্ন স্ট্যাটাস আপ করতে ব্যাস্ত! রুমে ঢোকার সাথে সাথে রুগীনির নালিশ, আধ ঘন্টা ধরে এক গেলাস পানির জন্যে হা পিত্যেশ করছিলেন রোগিনী।

গেলো, এবার ভ্রমণ নিয়ে কথা বলি। বিভিন্ন জায়গা ভ্রমন করে ছবি তোলার শখ বাঙালী তথা সবারই থাকে আর তা কাউকে দেখাতে পারলেও শান্তি লাগে। ফেসবুক হওয়ার কল্যানে এখন প্রায় বিনে পয়সায় ছবি গুলো দেখানো যায়। এই ছবি পোস্ট করতে গিয়ে পড়লাম আরেক ফ্যাসাদে। ছবি দেখে অমুকে বলে- গেলা তো নিয়া যাবা না? কিংবা তমুকে বলে একবারও বললি না , একা একাই চলে গেলি? কিংবা আমাকে আগে বললে যেতে পারতাম। সবচেয়ে বড় নালিশ পেলাম কাছের এক বন্ধুর কাছ থেকে। সে সরাসরি ফোন করলো এবং তাদের সংসারে অশান্তির জন্যে আমাকে দায়ি করলো! খুটিয়ে জিজ্ঞেস করবার পর শোনা গেলো বিভিন্ন স্পটে ঘোরার ছবি দেখে বন্ধুপত্নী নাকি বন্ধুটিকে সেসব জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে বলছে এবং আমাদের সাথে যেতে না পারার জন্যে তাকে দোষারোপ করছে। বোঝো! আমার আবার ডিজিটাল অনুভুতির সাথে বেশিরভাগ এনালগ ফিলিংস! ফলে পরের বার ঘুরতে যাওয়ার প্লান করবার সাথে সাথে সবাইকে নক করলাম। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এতো জনকে বলে একজনকেও কোথাও যাওয়ার জন্যে "হ্যা" বলাতে পারলাম না। অমুক কাজ, তমুক দাওয়াত, হমুক কেওয়াজ! সেই কাছের বন্ধুটিও কোনভাবেই রাজী হলো না- তার বউয়ের নাকি কাজ আছে এই বলে ! কাছ ফলে আবার একা যাত্রা। তবে এখন থেকে ছবি পোস্ট করার সময় সেই বড় নালিশ ওয়ালা বন্ধুটিকে ফিল্টার করে দিতে হয়। কারও সংসারে অশান্তির কারণ হওয়া ঠিক না।

এবার আসি খেলা দেখার কথায়। ছেলেবেলা থেকেই টিভিতে খেলা দেখার চাইতে মাঠে খেলা দেখায় আগ্রহ পেতাম বেশী। বাংলাদেশের ক্রিকেট আবার বড় আন্তর্জাতিক মানে পৌছানোতে হয়েছে এক মুশকিল। দলটা যখন বেশী ভালো খেলে ফেলে, তখন মৌসুমী দর্শক, ভি আইপি দর্শক, অ্যামেচার দর্শকের বন্যা বয়ে যায়। মধ্যে খানে ক্যাচালে পড়ে নিয়মিত দর্শকদেরই কপাল পুড়ে। শুনেছি এশিয়া কাপের ফাইনালের একশ টাকা দামের টিকিট দুই হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। যাই হোক, ফেসবুকে এক ছোটভাইকে দেখি প্রতি খেলায় ই স্টেডিয়ামে চেক ইন করে দেখে। একটু হিংসাও হয়, কেরানীর চাকুরী করবার জন্যে ছুটির দিন ছাড়া মাঠে গিয়ে খেলা দেখবার ভাগ্য হয় না। তবে কেউ স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখছে শুনেও ভালো লাগে। তা এশিয়া কাপের ফাইনালে অাপিস থেকে হাতে পায়ে ধরে ছুটি নিয়ে মাঠে হাজির হই। স্টেডিয়ামে ঢুকে মোবাইল খুলে দেখি ঐ ছোটভাইয়ের স্টেডিয়ামে চেকইন করার স্ট্যাটাস। খুব আগ্রহ করে তাড়াতাড়ি ওকে ফোন দিই- স্টেডিয়ামে একজন পরিচিতের সাথে খেলা দেখবো! কিন্তু ফোন ধরে সে বললো, সে বাসে।
-স্টেডিয়ামে আসছিস!
-নাতো, বাসায় যাই।
- তা তুই যে স্টেডিয়ামে চেক ইন দিলি?
- দাদা, সেটা তো প্রতিদিনই দিই। এটা তো ফেসবুকে চেক ইন। আসলে তো বাসায়ই থাকি!
বোঝো! ডিজিটাল যুগের এনালগ আমি তো পুরাই ...না হয়ে গেলুম।

ছোটবেলায় জন্মদিন করার খুব শখ ছিলো। জন্মদিনের দিন সকাল থেকে আম্মুর কাছে বায়না দিয়ে রাখতাম। তিনি আবার আব্বুর কোর্টে বল ঠেলে দিতেন। আব্বু আপিস থেকে এসে সিদ্ধান্ত দিতেন। হই হই করে চার পাশে সবাইকে ডাকা হতো, টেলিফোনে জানানো হতো। সন্ধ্যার পর মুহুর্তে বাসায় চল্লিশ পঞ্চাশ জন হাজির হয়ে যেতো। এখন জন্মদিনটা আরও বেশী উইশফুল! জন্মদিনের দিন ইনবক্সে শ খানেক উইশ, ওয়াল পেপারে আরও শ দুইয়েক উইশ। মনটাই ভরে যায়। দেখেছো, আগে আমার লোককে ডেকে বলা লাগতো- আজ আমার জন্মদিন, আর এখন লোককে জানানোর আগেই আমাকে জানিয়ে দেয়। বড় হলে কত সুবিধে। সবার অসম্ভব ভালোবাসা পাওয়া যায়। প্রতিবারই খুব লজ্জ্বা লাগে। কাউকেই একটু কিছু খাওয়াতে পারিনা, অথচ কষ্ট করে আমার জন্যে উইশ করে। এবার আমিই সবাইকে সম্মান জানাবো। জন্মদিনের দিন সকালে সবার আগে খাওয়া দাওয়া অর্ডার করে আসলাম। একটা ভ্দ্রগোছের কেকের ডিজাইন অর্ডার করে আসলাম, সন্ধ্যায় বাসায় দিয়ে আসবে। মাত্র কেজি তিনেক কেক! শর্ট পড়ে কিনা টেনশনেই পড়ে গেলাম। যাই হোক। এবার সবাইকে ফোনে আসতে বলবার পালা, মোবাইলে আগেই রিচার্জ করে রাখলাম। সবাই শুনে প্রথমে খুশীই হলো। আন্তরিক ধন্যবাদও পেলাম একেবারে নগদে। এর পর ক্ষমা প্রার্থনার পালা। প্রত্যেকেরই একটি করে শক্ত অজুহাত আছে। কারও বাইরে যেতে হবে, কারও আগেই দাওয়াত পড়ে গেছে, কারও অমুকে অসুস্থ্য, কারও কোচিং আছে, আর নিজের না থাকলেও পরিবারের কারও কোচিং আছে, কেউ টায়ার্ড.....। আর মুহুর্তে কোন অজুহাত তৈরী না করতে পারলেও কেউ আধঘন্টার মধ্যে জানাচ্ছে বলে ফোন রেখে দিলো! ফেসবুকে তিন সাড়ে তিনশোর মতো উইশ পাওয়া এই আমাকে সন্ধ্যায় সশরীরে উইশ করতে আসলো মোটে তিনজন!

অনলাইন যোগাযোগ আর ট্রাফিক জ্যাম এই দুইয়ের খপ্পরে পড়ে আজ আমাদের সামাজিক জীবন পুরোপুরি বিপন্ন। উদ্ভিজ্জ আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য আজ ক্রমশ ছোট হয়ে উঠছে। আমাদের আশা ভরসা, আন্দোলন, বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, ভালোবাসা সব অনলাইনের খাতায় বন্দী। মৃত আত্নীয়ের সাথে শেষ সেলফি এখানে প্রকাশের জায়গা, বড় বড় কঠিন শব্দে বিদ্রোহের ভাষা আজ অনলাইন পর্যন্তই, রাজপথ পর্যন্ত আসে না। বন্ধুর শ্লীলতাহানীর প্রতিবাদ অনলাইনে ঝড় হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বাস্তবদুনিয়ায় পাতার টোকাও বাজে না। মনে হয়, যৌনানুভুতির অনলাইন ভার্সন থাকলে প্রেমভালোবাসার জন্যেও কেউ সামনে আসতো না।

বাসায় খাবার থাক না থাক, মোবাইলে আর রাউটারে যথেস্ট পরিমান মেগাবাইট নিশ্চিত করাই এখন মৌলিক চাহিদার অংশ। ফলে, মেগাবাইট ডাটায় বন্দী হয়ে গেছে আমাদের জীবন।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৪:১৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×