নির্বাচন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন সমরনীতি
ফরহাদ মজহার
সম্প্রতি Harvard International Review নামক একটি পত্রিকায় সজীব ওয়াজেদ জয় ও কার্ল জে সিওভাক্কো (Carl J. Ciovacco) মিলে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। ছাপা হয়েছে ১৯ নভেম্বর ২০০৮ তারিখে। (দেখুন, http:/ http://www.harvardir.org / articles/1784/)।
যে সময়ে লেখাটি ছাপা হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচনের সময়, বিচার করলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এখন যে নির্বাচনী রাজনীতি চলছে তাকে কিভাবে সাজানো হয়েছে বা হচ্ছে সেটা বোঝার জন্য এই লেখাটি পড়া ও বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া আমি সজীব ওয়াজেদ জয়কেও বুঝতে চাই। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি যখন দেশে ফিরছিলেন তখন তাঁর বিরুদ্ধে নানান প্রচারণা চলেছিল। আমি তা নিন্দা করেছি। বিশেষত শেখ হাসিনা নিজের ‘ডাইনেস্টি’ প্রতিষ্ঠা করতে চান এই অপবাদ দিয়ে রাজনীতিতে জয়ের সম্ভাব্য ভূমিকাকে নষ্ট করবার একটা তৎপরতা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেই তৎপর ছিল। ‘মানবজমিন’ পত্রিকায় ছাপা আমার বক্তব্য ছিল সোজা। জয় যদি বাংলাদেশের নাগরিক হিশাবে কোন অবদান রাখতে চান, এটা তাঁর অধিকার। (আশা করি তিনি এখনও বাংলাদেশের নাগরিক রয়েছেন, মার্কিন নাগরিক হননি)। তিনি শেখ হাসিনার পুত্র কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের নাতি এটা তার দোষ বা অপরাধ নয়। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে তাঁর একটা গ্রহণযোগ্যতা আগেই তৈরি হয়ে থাকা স্বাভাবিক। সেটাও তাঁর দোষ নয়। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ বৃদ্ধ ও প্রৌঢ়দের ভারে স্থবির। সেখানে তরুণরা সচলতা আনতে পারেন। একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়ে জয় বিদেশে দীর্ঘদিন থেকে কী শিখলেন, কী জানলেন সেটা জানার আগ্রহ অনেকেরই আছে। আমিও ব্যতিক্রম নই। লেখাটি পড়ে আমি বুঝেছি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যে নীতি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন করছে, আওয়ামী লীগকে দিয়ে সজীব ওয়াজেদ জয় সেই নীতিই বাস্তবায়ন করার কথা বলছেন। তাঁর রাজনীতি সম্পর্কে আমার ধারণা আরো স্পষ্ট হয়েছে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, বাংলাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক কর্তব্য বা তাঁর ভাষায় 'A Secular Plan' হচ্ছে ইসলামি রাজনীতির বা তাঁর ভাষায় ‘ইসলামিজম’ ঠেকাতে বাংলাদেশে পরিপূর্ণ যুদ্ধে নেমে পড়া। কারণ যাকে নিয়ে বা যেখানে তিনি লেখাটি ছেপেছেন তাতে পরিষ্কার মার্কিন সন্ত্রাস ও যুদ্ধের অধীনে শুধু নয়, এমনকি সন্ত্রাসবিরোধী সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় তিনি তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করবার কথা ভাবছেন। (কিংবা তাঁকে দিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এই কাজটিই করিয়ে নিতে চাইছে)। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী ম্যানিফেস্টো হিশাবে আমরা এই লেখাটি পাঠ করতে পারি। জয়কে ধন্যবাদ দিতে হয় কারণ আগামী দিনে আওয়ামী লীগের রাজনীতি কী হতে যাচ্ছে তার আগাম নমুনা তিনি আমাদের জানিয়েছেন।
জয়ের এই লেখাটি নিয়ে লিখবার কোন প্রয়োজন বোধ করতাম না। বেশ কয়েকট কারণে লেখাটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হচ্ছে। লেখাটিতে তাঁকে শেখ হাসিনার ‘উপদেষ্টা’ হিশাবে পরিচয় দেয়া হয়েছে, যিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট। অতএব আমার এই লেখাও আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ হাসিনার একজন উপদেষ্টার নীতিনির্ধারণী লেখার ওপর আলোচনা। একে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। (তবে আশ্চর্য হয়েছি, তিনি যে শেখ হাসিনা ওয়াজেদের পুত্র, সেই তথ্য এই লেখায় তাঁর পরিচিতিতে নাই)।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে জয় একলা নন, সঙ্গে আরেকজন লেখক আছেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিশাবে লিখলে লেখাটি তার একার হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। ব্যক্তি হিশাবে তিনি অবশ্য যে কারো সঙ্গেই যৌথ লেখা লিখতে পারেন। তবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিশাবে অন্য কোন উপদেষ্টা বা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কারো সঙ্গে লিখলে সেটা ভালো দেখাত। কিন্তু জয়ের লেখার সঙ্গী কার্ল সিওভাক্কোর পরিচয়ে বলা হচ্ছে, তিনি একজন গবেষক এবং তার সাম্প্রতিক গবেষণা থিসিস হচ্ছে আলকায়েদার ‘গণমাধ্যম সংক্রান্ত স্ট্র্যাটেজি’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের আলোকে আলকায়েদার বিরুদ্ধে তথ্য ও গবেষণার কাজ এটা। তিনি এই থিসিসটি লিখেছেন সরাসরি মার্কিন সেনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ওয়েস্ট পয়েন্টের (West Point) একটি বিশেষ গবেষণা কেন্দ্রের জন্য। কেন্দ্রটির নাম Combating Terrorism Center at West Point। মার্কিন সেনাবাহিনী তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সামরিক ভাবে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্য যাদের শিক্ষা দেয় এবং সেখানে যারা গবেষণা করে তাদেরই একজন এই লেখাটির সঙ্গে জড়িত। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্য মার্কিন সামরিক নীতি ও কৌশলের সঙ্গে লেখাটির সঙ্গতি বোঝাবার জন্যই দুইজনের লেখা হিশাবে লেখাটি হয়তো ছাপা হয়েছে। যাতে বোঝানো যায় শেখ হাসিনার রাজনীতি মার্কিন সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার সামরিক রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবেই জড়িত। সেই ভাবে লেখাটি পড়বার সুযোগ রয়েছে অবশ্যই। আমরা সেই ভাবেই লেখাটিকে পাঠকদের পড়তে বলব। লেখাটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নাই। এটাও পাঠকদের জানা গুরুত্বপূর্ণ যে কার্ল সিওভাক্কো একজন মার্কিন সেনা কর্মকর্তা। তিনি ইরাক ও সৌদি আরবে মার্কিন সেনাদায়িত্বে কর্মরত ছিলেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন সামরিক নীতি ও কৌশলের সঙ্গে এই অভিন্নতা শেখ হাসিনার নিজস্ব নাকি আওয়ামী লীগের রাজনীতি, সেটা ভিন্ন ভাবে বিচার করার দরকার আছে। আমি এক মনে করি না। আওয়ামী লীগের জন্য এই নীতি বিপদের কারণ হবে। আমি এখানে সেই দিকে প্রবেশ করবো না। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন তিনি পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ভুল রাজনীতি করেছেন, সেই বিষয়ে আমি এর আগে লিখেছি। যার পরিণতি হয়েছে ২০০১ সালে তাঁর পরাজয়। দেখা যাচ্ছে, সেই একই ফাঁদ থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন নি। বরং নিজেকে এবং একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে তিনি বিপজ্জনক বিভাজনের জায়গায় ঠেলে দিচ্ছেন। আমার এই লেখাটি পড়বার আগে পাঠকদের আমি অুনরোধ করব ২০০৪ সালে আমার লেখা ‘অকার্যকর রাষ্ট্র ও উপমহাদেশের রাজনীতি প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা’ শিরোনামে লেখাটি যেন দয়া করে পড়ে রাখেন। তাহলে আমার বক্তব্য বুঝতে সহজ হবে। লেখাটি ‘সাম্রাজ্যবাদ’ নামে প্রকাশিত বইয়ে রয়েছে। আওয়ামী লীগের ভারতপন্থী রাজনীতির সঙ্গে এই মার্কিন সামরিক সংযোগের ব্যাপারটি এমন কোন আকস্মিক ঘটনা নয়, যদি আমরা মনে রাখি জানুয়ারি ১৯৯৫ সাল থেকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য যে উদ্যোগ শুরু হয়েছিল সেটা ইতোমধ্যে প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডসংক্রান্ত সহযোগিতার পরিণত রূপ পরিগ্রহণ করেছে। এই বিষয়েও আমি এর আগে লিখেছি। তবে যাঁরা আরো জানতে চান তাঁরা ভারতীয় দূতাবাসের এই লিংকটা আপাতত পড়ে রাখতে পারেন। (http://www.indianembassy.org/ press_release/2005/June/ 3.htm)
তৃতীয় যে কারণে এ লেখাটি গুরুত্বপূর্ণ সেটা হোল হার্ভার্ড ইনটারনেশনাল রিভিউ তাঁকে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের ‘কপী ঘপবসয়মথয়মসড়’ হিশাবেও পরিচয় করিয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে নানান সময়ে নানা শক্তি বা পক্ষের সঙ্গে দেনদরবার করবার ক্ষেত্রে সজীব ওয়াজেদ জয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বলে তারা বলেছে। বিশেষত এটাও বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের বর্তমান সামরিক সরকারের’ সঙ্গেও সজীব ওয়াজেদ জয় দেনদরবারের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। পত্রিকাটি বর্তমান সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলেনি, বলেছে ‘সামরিক সরকার’। তিনি ঠিক কী দেনদরবার করেছেন সেটা বলা হয়নি। তবে জয় তাঁর ব্লগে সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের সঙ্গে দেখা ও কথাবার্তা বলেছেন সেই সম্পর্কে লিখেছেন। তাঁর লেখায় পরিষ্কার যে তিনি সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদকে পছন্দই করেছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘কী নেগোশিয়েটর’ হিশাবে তাঁর এই সাক্ষাৎ যথেষ্ট আলোচিত এবং যাঁরা এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছেন তাঁরাও কমবেশি পরিচিত। বর্তমান সামরিক সরকারের সঙ্গে তাঁর এই দেনদরবারের কথা বেশ ফলাও করেই তাঁর পরিচিতিতে বলা হয়েছে। (দেখুন, http://www.sajeeb.blogspot.com/)। সামরিক সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করবার সঙ্গে লেখায় যে নীতি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিফলন কতোটা ঘটেছে আমরা জানি না। কিন্তু এই কারণেও লেখাটি গুরুত্বপূর্ণ।
চতুর্থ কারণ হচ্ছে, আমার আশা, এই লেখাটির পর, আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্টের এই তরুণ উপদেষ্টার প্রস্তাব আর আওয়ামী লীগের আগামি রাজনীতি যে সমার্থক হবে না বা জাতীয় স্বার্থে সমার্থক হতে পারে না, আওয়ামী লীগের দেশপ্রেমিক নেতাকর্মীরা সেটা উপলব্ধি করবেন। এই অবস্থান থেকে অবিলম্বে তাঁদের দূরত্ব বজায় রাখার ওপর আগামি নির্বাচনে তাঁদের ভোট পাওয়া না পাওয়া অনেকাংশেই নির্ভর করতে পারে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অবশ্যই গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল লড়াই-সংগ্রামের ধারা রয়েছে। সেই ধারা গৌরবের, সেই ধারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত। সজীব ওয়াজেদ জয় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাজনীতির যে ধারা বাংলাদেশে প্রয়োগ করতে চাইছেন তা আদতে ইসলামবিরোধী মার্কিন সমরনীতি। এই পার্থক্য ধরিয়ে দেবার জন্যই এই লেখা। শুরুতে অতএব ধর্মনিরপেক্ষতার দুই ধারার ওপর কিছু আলোকপাত করা যাক।
ধর্মনিরপেক্ষতার দুই ধারা
মোটা দাগে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাজনীতির দুটো ধারা আছে। প্রথম ধারা ঐতিহাসিক, প্রগতিশীল ও গণমানুষের লড়াই-সংগ্রামের ধারা। দ্বিতীয় ধারা অনৈতিহাসিক, চরম প্রতিক্রিয়াশীল, গণবিরোধী এবং অবস্থাভেদে ফ্যাসিস্ট রূপ পরিগ্রহণ করে। প্রথম ধারা যেন সজীব ওয়াজেদ জয় ভালো বুঝতে পারেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের ঔপনিবেশিকতা, সাম্রাজ্যবাদ, জাতিগত নিপীড়ন ও সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। এই ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা, জাতিগত নিপীড়ন এবং পাকিস্তানের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম একাকার হয়ে আছে। এই লড়াইয়ের চরিত্র বোঝার জন্য লড়াইয়ের নানান অভিমুখ, প্রকাশ বা প্রবণতাকে শনাক্ত করবার দরকার আছে, তাদের মাত্রা নিয়েও গবেষণা হতে পারে কিন্তু একটি অন্যটি থেকে আলাদা কোন রাজনীতি নয়। একই রাজনীতি। নিপীড়িত জনগণের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামকে আমরা খণ্ড খণ্ড ভাবে বিচার করলে এই লড়াইকেও আমরা খণ্ড খণ্ড ভাবেই বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন ভাবে বুঝব। সামগ্রিকভাবে বুঝলে একটিকে অন্যটি থেকে আলাদা করা যায় না। অর্থাৎ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান এই দেশের কৃষক, শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষ ও উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অধিকার আদায়ের জন্য যে লড়াই করেছেন তার চরিত্র না বুঝলে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রগতিশীল ও অগ্রসর চরিত্রের কিছুই আমরা বুঝব না। শুধু এই দুই বড় মাপের নেতাই নন, কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিশাল একটি ধারা এই লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং বাংলাদেশের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের লড়াইকে তাঁরা প্রাণবন্ত ও সফল করে তুলেছিলেন। ঠিক যে জাতীয় সংগ্রাম বনাম শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যে সম্পর্ক ও পার্থক্য আছে। সেই বিষয়ে আমি এখানে যাবো না। এইকভাবে ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দী, মণি সিংহসহ আরো অনেক নেতার অবদানকেও আমরা ভুলে যেতে পারি না। সকলে মিলেই দোষেগুণে এই ধারাকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন।
অবিচ্ছেদ্য কথাটির নিচে আমি দাগ টেনেছি, কারণ প্রায়ই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে এক দিকে ইতিহাস-নিরপেক্ষ ভাবে বিমূর্ত বা হাওয়াই কায়দায় ব্যবহার করা হয়, অন্য দিকে একে ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের প্রক্রিয়া বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লড়াই থেকে আলাদা ব্যাপার বলে গণ্য করা হয়। যেমন, যদি আমরা গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করি এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম ও গণতন্ত্র চর্চাই আমাদের প্রধান রাজনৈতিক আদর্শ হয় তাহলে গণতন্ত্রের ধারণার মধ্যেই তো ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা অন্তর্ভুক্ত। গণতন্ত্র থেকে আলাদা করে ভিন্ন একটি ধারণা হিশাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে হাজির করার কারণ কী? এর রাজনীতিটা কি তাহলে গণতন্ত্র থেকে আলাদা? এর উদ্দেশ্যই বা কী?
দেখা যায়, এক দিকে রয়েছে পদ্ধতিগত মুশকিল একটি আদর্শ বা চিন্তার ধারাকে ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত বা আলাদা ভাবে বিচারের ভুল পদ্ধতি, অন্য দিকে রয়েছে কোন একটি চিন্তা, ধারণা বা আদর্শকে তত্ত্বগত ভাবে ধারণ করা বা সামগ্রিক ভাবে বোঝার অক্ষমতা। এই দুটো মারাত্মক সমস্যা রয়ে গিয়েছে আমাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক চর্চায়। এর ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষ-বিপক্ষের ছুতায় আমাদের সমাজে যে ভয়াবহ বিভক্তি, সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার গোড়ায় রয়েছে আমাদের চরম বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা। তারই অভিপ্রকাশ বাংলাদেশের রাজনীতির দুই প্রতিহিংসাপরায়ণ ধারা। আজ এই বিভাজন বহু প্রাণ ও রক্ত দিয়ে অর্জন করা বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ঢালাও দোষারোপ করবার আগে এই অক্ষমতা আমরা কিভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে কাটিয়ে উঠব সেই দিকটা নিয়েই আগে ভাবতে হবে।
পদ্ধতিগত মুশকিল সম্পর্কে কিছু কথা বলা যাক। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র লড়াইকে গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্রেফ রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা থাকুক বললে কিছুই বোঝা যায় না। গণমানুষের সত্যিকারের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন এই অনৈতিহাসিক ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’বাদী রাজনীতি সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ সম্পূর্ণ বিপরীত ধারা। এর চরিত্র আগাগোড়ায় প্রতিক্রিয়াশীল, গণবিরোধী, ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী। এই কালে এই ধারাই জর্জ বুশের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ ও তেলের জন্য ইরাক ও আফগানিস্তান দখল করে নেওয়ার প্রধান রাজনৈতিক মতাদর্শ। ফিলিস্তিনি জনগণকে অধিকারহারা করে রাখতে হলে ইসলাম মাত্রই বর্বর ও সন্ত্রাসী এই তত্ত্ব প্রমাণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র রাজনীতিকে পরদেশ দখলের কাজে সরাসরি ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বিশেষত ইসলামপ্রধান দেশগুলোতে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং একটি বর্বর ও সন্ত্রাসী ধর্ম হিশাবে ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে ইসলামকে প্রতিস্থাপিত করে জর্জ বুশের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী যে ‘ক্রুসেড’ শুরু হয়েছে এই বিপরীত ধারা সেই ক্রুসেডেরই মতাদর্শ। এর সারকথা হচ্ছে ইউরোপ খ্রিষ্টীয় সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মের যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপ খাড়া করেছে সেটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একমাত্র রূপ বা মডেল। অথচ ইউরোপ ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াই করেছে সামন্তশ্রেণীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার জন্য। শোষক ও নিপীড়কের বিরুদ্ধে শোষিত ও নির্যাতিতের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। এখানেই তার মর্মের দিক। গির্জা বা চার্চ ছিল সামন্তশ্রেণীর রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্র। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষক সামন্ত শ্রেণীর বিরুদ্ধে শোষিত, নির্যাতিত ও অধিকারহারা মানুষ ইউরোপে যে রাজনৈতিক বিপ্লব করেছে, সেই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলাফল হিশাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। ধর্মকে শোষকরা যেভাবে ব্যাখ্যা করেছে শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণীর লড়াইয়ে সেই একই ধর্মের ব্যাখ্যা হয়েছে ভিন্ন ভাবে। এটা ছিল শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণীর লড়াই। ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াই ধর্মের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় নি, ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রশ্ন হিশাবে তার সমাধান করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রাম থেকে একে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নাই। ইউরোপের এই বিশেষ ইতিহাসকে অস্বীকার করারও দরকার নাই, কিন্তু তার ঐতিহাসিক পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে। কিন্তু যখন এটাই একমাত্র মডেল হিশাবে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা চলে, তখন সেটা আমাদের মতো দেশে নিপীড়কের হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
ধারণাগত অপূর্ণতার দিক কী? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেহেতু ধর্মতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠন অসম্ভব তখন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মাত্রই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক হয় তাকে আলাদা করে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র বলার কোনই প্রয়োজন পড়ে না। যখন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে আলাদা আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে তখন বুঝতে হবে হয় ধারণাগত ভাবে গণতন্ত্র এখনো বিকশিত হয়নি। কিম্বা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে গণতন্ত্রের জন্য নয়, ব্যবহার করা হচ্ছে ভিন্ন উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি নামে যে রাজনীতির চল আমরা দেখি, তার মূল উদ্দেশ্য জনগণের ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি ও আশা-আকাঙ্ক্ষার বিরোধিতা করা। একে হাজির করা হয়েছে ইসলামের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিপরীতে। সমাজকে ইসলামপন্থী ও ইসলামবিরোধী শিবিরে ভাগ করবার দরকারে। জর্জ বুশের পক্ষের রাজনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার এই ভেদবুদ্ধির ওপর আশ্রয় করেই এখন সক্রিয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অর্থাৎ ইসলাম-প্রধান দেশগুলোর জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অস্ত্র হিশাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ধর্মনিরপেক্ষতার এই দুই পরস্পরবিরোধী ধারাকে আমরা সহজেই চিনব যদি আমরা প্রশ্ন করি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কি ধর্মতত্ত্বের ভিত্তিতে আদৌ গঠন করা সম্ভব? জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পই যদি রাষ্ট্রের ভিত্তি হয় গণতন্ত্র মানে যদি রাষ্ট্রের ভিত্তি কোন আসমানী, দৈব বা রহস্যজনক শক্তি বা ধর্মতত্ত্ব (য়ভপসলসবী) না হয়ে থাকে গণতন্ত্র যদি জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের অভিব্যক্তি হয় তাহলে গণতন্ত্রের বাইরে বাড়তি একটা ব্যাপার হিশাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে আলাদা করে বলার উদ্দেশ্য কী? গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা থেকে আলাদা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র এই ধারাকে ঠিকই গণতন্ত্রবিরোধী ধারা হিশাবে জনগণ শনাক্ত করে। অন্য দিকে ইসলামপন্থীরাও একে ইসলামবিরোধী বা ইসলামের দুষমন হিশাবে চিহ্নিত করে। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার যে রাজনীতি গড়ে তোলা হয়েছে তারই বিপরীতে স্বাভাবিক কারণেই ইসলামি রাজনীতি সংঘবদ্ধ হতে পেরেছে।
জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্প গণবিরোধী অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ বা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অগণতান্ত্রিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে জনগণ ধর্মকে তার লড়াই-সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে ব্যাখ্যা করে। তার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনীতি এ কারণেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ইসলামের যে ব্যাখ্যা হাজির করেছেন তা গণমানুষের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ফলে তাঁর রাজনীতি ছিল সত্যিকার অর্থেই ধর্মনিরপেক্ষ। তাঁর ইসলাম শুধু গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার দিক থেকেই বিপ্লবী ছিল না, সমাজ গঠনের ক্ষেত্রেও ইসলামকে অগ্রসর চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে কিভাবে গণমানুষের স্বার্থের পক্ষে দাঁড় করাতে হয়, তার উদাহরণ তিনি রেখে গিয়েছেন। বাংলাদেশে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নামক বিদ্যমান রাজনীতির চরম প্রতিশ্রুতিশীল দিক যদি আমরা সহজে বুঝতে চাই তাহলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আর শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতিকে আলাদা বা বিভক্ত ভাবে হাজির করবার মধ্যেই আমরা সেটা খুঁজে পাব। আমার কথাও পাঠক সহজে বুঝবেন। ভাসানীকে বাংলাদেশের জনগণের গড়ে ওঠার ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে বা তাঁকে বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে নির্বাসিত করে, বিস্মৃতির মধ্যে ঠেলে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার ইসলামবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারা গড়ে উঠেছে। একে মোকাবিলা করা ছাড়া বাংলাদেশের খেটে খাওয়া শোষিত, লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত মানুষের আর কোনো গত্যন্তর আছে বলে আমি মনে করি না। মওলানার পথই বাংলাদেশের গণমানুষের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পথ। জর্জ বুশের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নয়।
বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটিকে গণমানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক গৌণ, এর সম্পর্ক গণমানুষের লড়াই-সংগ্রাম। লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষ যখন নিজের ইচ্ছা ও সংকল্প সম্পর্কে সজ্ঞান ও সচেতন হয়ে ওঠে তখন ধর্ম সম্পর্কেও মানুষ সজ্ঞান ও সচেতন হয়, তার বিকৃত, গণবিরোধী, ধর্মান্ধ বা প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবহার প্রতিরোধ করে। মওলানা ভাসানীর রাজনীতির ক্ষয়ের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ক্ষয় হয়েছে। বিপরীতে শোষক শ্রেণীর হাতে ধর্মনিরপেক্ষতার বাংলাদেশের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে।
আওয়ামী লীগের সেকুলার প্লান
সজীব ওয়াজেদ জয় আওয়ামী লীগের জন্য যে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ‘পরিকল্পনা’ দিয়েছেন, তার সঙ্গে জর্জ বুশের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের কোনই ফারাক নাই। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভূমিকাকে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুদ্ধ পরিকল্পনার অংশ হিশাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনাই আমরা এখানে পাই।
যে পরিকল্পনার প্রস্তাব করা হয়েছে তার ভূমিকা হিশাবে লেখাটি দাবি করছে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সময় থেকেই একটি সেকুলার মুসলিম রাষ্ট্র হিশাবে গড়ে উঠেছে। যদিও নানান অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান হয়েছে তবুও বারবারই সেই গোড়ার জায়গায় বাংলাদেশ প্রত্যাবর্তন করবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ‘ইসলামপন্থী রাজনীতির দিকে ক্রমশ বাংলাদেশে যে ঝোঁক বাড়ছে তার চিহ্ন খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, এর ফলে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার পবিত্রতা বিনষ্ট হচ্ছে।’ (গুরুত্বারোপ আমার)। এটাই হচ্ছে, জয় ও সিওভাক্কোর দিক থেকে, বিপদের কথা। আওয়ামী লীগের আগামি রাজনীতি ইসলামের বিরুদ্ধে মার্কিন সমরনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েই মোকাবিলা করতে হবে। সেই পরিকল্পনাই তাঁদের লেখায় হাজির করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ইসলামই (ওঢ়লথশমঢ়শ) হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান ও তার সেকুলার উপাদানের প্রধান বিপদ। আগামি আঠারো ডিসেম্বর তারিখে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেখানে দুই প্রধান দল তাদের রাজনীতিতে কে কতোটা ‘ইসলাম’ মেশাবে সেটাই প্রত্যক্ষ বিষয় হয়ে উঠবে।
কেন বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতি এতো প্রবল হয়ে উঠল? বলা হচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা নিজেদের জন্য যে বৈধতা নির্মাণ করেছে গত দুই বছরে রাজনৈতিক কারণে জরুরি অবস্থার অধীনে সামরিক শাসন বলবৎ রাখার জন্য তার ক্ষয় হয়েছে। এখন ইসলামের বিপরীতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ রক্ষার উপায় কী? খুবই সোজাঃ আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করা। কেন? কারণ (শেখ হাসিনার) আওয়ামী লীগই ধর্মনিরপেক্ষতার একমাত্র বাহক। যদি নির্বাচিত হয় একমাত্র আওয়ামী লীগই ইসলামকে ঠেকিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে সক্রিয়ভাবে ইসলামকে ঠেকাবার জন্য কিছু কাজ করতে হবে। অতএব নির্বাচিত হয়ে এসে আওয়ামী লীগ কী কী কাজ করবে সজীব ওয়াজেদ জয় ইরাক ও সৌদি আরব ফেরত একজন মার্কিন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে সেই পরিকল্পনাই আমাদের লেখাটিতে পেশ করেছেন। যেহেতু ইসলাম ঠেকানোর কাজটি সামরিক হতে বাধ্য সেই কারণে ওয়েস্ট পয়েন্ট সামরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামরিক ভাবে সন্ত্রাসবিরোধী কাজ নিয়ে যিনি গবেষণা করছেন, তিনি এই লেখার একজন লেখক। আওয়ামী লীগের এই কর্মপরিকল্পনা কতোটুকু বাস্তবায়িত হবে আমরা এখনও তা বলতে পারি না। কিন্তু পরিকল্পনাটা আমাদের জানা ও বোঝা দরকার। তবে মার্কিন সামরিক পরিকল্পনার অধীনে আগামী দিনে আওয়ামী লীগের যে নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো বাস্তবায়িত হবে সেটাই একটি মুসলিম দেশে সেকুলার শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বিশ্বের জন্য সেটা হবে একটি নজির।
ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাজনীতি তো আছেই। জয়ের লেখা সেই রাজনীতি নিয়ে নয়। নইলে আমরা এতো কথা খরচ করতাম না। আওয়ামী লীগের সেকুলার প্লানের যে নকশা জয় আমাদের দিচ্ছেন, তার লক্ষ্যবস্তু শুধু ধর্মবাদী দল বা ইসলামি সন্ত্রাস নয়, এই পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্যবস্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। আর ঠিক এখানেই তাঁর লেখার গুরুত্ব। বলা হচ্ছেঃ
'The Islamists cleverly began growing their numbers within the Army by training for the Army Entrance Exams at madrassas. This madrassa training was necessary because of the relative difficulty associated with passing these exams. The military is attractive because of both its respected status and its high employment opportunities in a country where unemployment ranges from 20 percent to 30 percent for younger males. High demand for military posts has resulted in an entrance exam designed to limit the number of recruits. Before this madrassa Entrance Exam campaign, only 5 percent of military recruits came from madrasses in 2001. By 2006, at the end of the BNP's reign, madrassas supplied nearly 35 percent of the Army recruits. In a country that has seen four military coup d'etats in its short 37 year history, the astronomical growth of Islamists in the military is troubling to say the least'.
অভিযোগ করা হচ্ছে চালাকি করে সেনাবাহিনীতে মাদ্রাসার ছাত্ররা ঢুকে পড়েছে। কোন ষড়যন্ত্র করে নয়। সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পাবার জন্য যে পরীক্ষা হয়, সেই পরীক্ষার জন্য মাদ্রাসার ছাত্ররা নিজেদের তৈরি করে। মাদ্রাসার ছাত্ররা নাকি ভালো ছাত্র হয় না বলে এতোদিন শুনে এসেছে। দেখা যাচ্ছে সুযোগ পেলে তারা অন্যদের টেক্কা দিতে পারে। মাদ্রাসার ছাত্ররা যদি সেনাবাহিনীর নির্ধারিত পরীক্ষায় পাশ করে তাহলে আপত্তিটা কীসের? মাদ্রাসার ছাত্র বলেই কি আপত্তি? যে সকল পরিসংখ্যানের দেওয়া হয়েছে কাদের হিশাব কাদের সংখ্যা তার কোন খবর নাই। কোন উৎস বা রেফারেন্স দেওয়া হয় নি।
সজীব ওয়াজেদ জয় ও কার্ল সিওভাক্কো সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে ইসলামি ভূত কী করে তাড়াবেন তার একটি পরিকল্পনা হাজির করেছেন।
আগামী কিস্তিতে সেই বিষয় ও অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে আরো কিছু কথা বলব।
email : [email protected]
(নয়া দিগন্ত: ২২/১১/২০০৮)
Click This Link