আপনি পড়েছিলেন কি না জানি না, আপনাদের দুই ভাইকে নিয়ে লেখা একটি গল্প ছাপা হয়েছিলো ১৯৭৮ সালে। তখন আপনারা দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী ও মোহামেডানের অধিনায়ক। ঘটনাটি ঐতিহাসিক, দুই সহোদর বড়ো দুই দলের অধিনায়কত্ব করছেন এমন ঘটনা বাংলাদেশ আর কখনো ঘটেনি। সে বছর মৌসুমের শুরুতে আপনারা দুই ভাই দুই বিপরীতমুখী ঘোষণা দিয়েছিলেন। ৭৭-এর অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর অধিনায়ক আপনি বললেন, শিরোপা ধরে রাখবো। মোহামেডানের দলনেতা মঞ্জু ভাই জানালেন, শিরোপা আমরা নেবো। সে বছর মোহামেডান লীগ-চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো। আপনি পরাস্ত হলেও গর্ব করে বলতেই পারেন, সেই চ্যাম্পয়নশীপ আপনাদের পরিবারেই ছিলো!
আবাহনী-মোহামেডানের খেলার দিন ‘স্টেডিয়াম’ পত্রিকায় ওই গল্পটি ছাপা হয়। আপনার জানার কথা নয়, আজ জানাই, ‘সেই প্রতিশ্রুতি’ শিরোনামের গল্পটির রচয়িতা ছিলাম আমি
গল্পের কপি আমার কাছে নেই, পুরো গল্পটিও মনে নেই। আবছামতো যতোটুকু মনে পড়ে তা অনেকটা এইরকম : আজ আবাহনী-মোহামেডানের খেলা। দুই দলের অধিনায়ক নান্নু ও মঞ্জু একই বাড়ির বাসিন্দা – দুই সহোদর। সকালে নান্নুর ঘুম ভাঙে একটি স্বপ্ন দেখে, আজকের খেলা নিয়েই একটি স্বপ্নদৃশ্য। গোলমুখ থেকে বলটি হঠাৎ উধাও, যা শুধু স্বপ্নেই সম্ভব। দুই ভাই, তারা পরস্পরের শত্রুপক্ষ। আজ এই সকালে তাদের কারো মনে পড়ে অথবা পড়ে না, বাল্যকালে তারা জীবনভর একই দলে খেলবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলো।
আপনার হয়তো মনে আছে, ‘স্টেডিয়াম’-এর মালিক-প্রকাশক আবাহনীতে আপনার সতীর্থ আরেক খেলোয়াড় টুটুল। নামে পাক্ষিক হলেও কাগজটি অনিয়মিত বের হয়। তবে বড়ো খেলার দিনে অবশ্যই একটি সংখ্যা বাজারে আসে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাজার দশেক কপি নিঃশেষ হয়ে যায় স্টেডিয়ামের বাইরে এবং গ্যালারিতে। এর সম্পাদক তখন আবদুর রহমান, গেট-আপ মেকাপ ও ইলাস্ট্রেশনে আফজাল হোসেন। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, ওই সময় আফজাল টিভিতে তার ‘আপনপ্রিয়’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে আপনাদের দুই ভাইকে উপস্থিত করেছিলো।
উয়ারি এলাকার সপ্তর্ষি মুদ্রায়ণে ‘স্টেডিয়াম’ কম্পোজ কাজ হয়, ছাপাখানাটি ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের কর্মকর্তা নজরুল ভাইয়ের, পত্রিকার অফিস হিসেবে সেখানে একটি ঘরও তিনি ব্যবহার করতে দিয়েছেন। মাঝেমধ্যে আড্ডা দিতে যাই সেখানে। এরকম এক আড্ডায় রহমান ও আফজাল অকস্মাৎ দাবি করে বসে, আবাহনী-মোহামেডানের খেলা উপলক্ষে পরিকল্পিত সংখ্যার জন্যে একটি গল্প লিখে দিতে হবে। কেন এই বুদ্ধি তাদের মাথায় এলো জানি না, ৮৩ সালে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই কাগজের আয়ুষ্কালে এর আগে বা পরে দ্বিতীয় কোনো গল্প আর ছাপা হয়নি। এই তথ্যটি সম্পর্কে আমি নিশ্চিত এইজন্যে যে, গোড়া থেকেই এই পত্রিকার সঙ্গে একটা সম্পর্ক আমার ছিলো, ৮০ থেকে ৮৩ পর্যন্ত ‘স্টেডিয়াম’-এর যে ক’টি সংখ্যা বেরিয়েছিলো তার সম্পাদনার দায়িত্ব ছিলো আমার।
নান্নু-মঞ্জু দুই ভাই দুই দলের অধিনায়ক, সেই খেলার দিনে গল্পের বিষয় হিসেবে এর চেয়ে ভালো আর কী হয়! খেলা দেখে আপনাদের চিনি, ব্যক্তিগত জীবন প্রায় কিছুই জানি না। দু’জনের পুরো নাম জানি – মনোয়ার হোসেন নান্নু ও শামসুল আলম মঞ্জু। আপনাদের পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি কিছুই জানা নেই। কিন্তু গল্পের জন্যে তথ্য খুব জরুরি নয়। যতোদূর মনে পড়ে, ওই অফিসে বসেই গল্পটি লেখা হয় এবং আফজাল তৎক্ষণাৎ ইলাস্ট্রেশনও করে ফেলে।
‘স্টেডিয়াম’ যথাসময়ে প্রকাশিত হলো, স্টেডিয়ামে খেলাও শুরু হলো। খেলার শুরুতে মাঝমাঠে রেফারি এ লাইনসম্যানদের সামনে নিজ নিজ দলের অধিনায়ক হিসেবে আপনারা দুই ভাই করমর্দন করছেন, এই মুহূর্তটি এখনো চোখে ভাসে। এই লেখাটির সঙ্গে দেওয়ার জন্যে সেই ছবির একটি কপি মঞ্জু ভাইয়ের কাছ থেকে উদ্ধার করা গেলো।
আমি জানি, আপনি ভোলেননি যে সেদিনের খেলা অসমাপ্ত ছিলো। আবাহনী-মোহামেডানের খেলায় চিরাচরিত গোলযোগ নয়, প্রবল বৃষ্টিতে খেলাটি অমীমাংসিত অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়। আমার লেখা গল্প-সম্বলিত পত্রিকার কপিগুলিও রক্ষা পায়নি অনুমান করি, বৃষ্টিতে ধুয়ে গিয়ে থাকবে। সেখানেই গল্প আটকে থাকতে পারতো, পরিত্যক্ত ও অসমাপ্ত খেলাটির মতো। প্রায় তিরিশ বছরের ব্যবধানে সেই গল্পের উপসংহার আমাকে লিখতে হবে তা কি জানতাম!
সারাজীবন একসঙ্গে এক দলের হয়ে খেলার প্রতিশ্রুতি আপনাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে বাল্যকালে হয়েছিলো কি না জানা নেই, লেখার জন্যে সেটি তৎক্ষণাৎ কল্পনা করে নিতে হয়েছিলো সেদিন। তেমন প্রতিশ্রুতির ঘটনা থাকলেও তাকে বালখিল্য বলে বিবেচনা করাই সঙ্গত। বাস্তবতা ছিলো এই যে, স্বাধীনতার পর আবাহনী ক্রীড়াচক্র গঠিত হলে মঞ্জু ভাই সেখানে অন্তর্ভুক্ত হন, আপনি তখন মোহামেডানে। ৭৪-এ আপনিও চলে এলেন আবাহনীতে। ঢাকা ফুটবল লীগে ১৯৭৪-এর একটিমাত্র বছর আপনারা এক দলের হয়ে খেলেছিলেন। জাতীয় দলে একসঙ্গে খেলা যদি হিসেবে ধরা না হয়, বাল্যকালে প্রতিশ্রুত হয়ে থাকলে তা বাস্তব হয়েছিলো এই একটি ফুটবল মৌসুমে।
১৯৭৫-এ দু’জনের পথ আলাদা হয়ে যায়, সে বছর মঞ্জু ভাই গেলেন মোহামেডানে, খেলোয়াড়ী জীবন তাঁর শেষ হলো ৮৫-তে। আর আপনি ৮২-তে অবসর নেওয়া পর্যন্ত থেকে যান আবাহনীতে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ফুটবলে একটা নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়। পাকিস্তান আমলে অন্য সবকিছুর মতো ফুটবলেও জাতীয় দলের হয়ে বাঙালির অংশগ্রহণ সীমিত ছিলো। ৭১-এ যুদ্ধের সময় ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ ভারতে অনেকগুলি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে স্বাধীনতার বার্তা তুলে ধরে এবং সেই অভিজ্ঞতা যে এক নতুন অনুভবের জন্ম দেয়, তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের ফুটবল নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠা এবং ইংল্যান্ড থেকে আসা আবাহনীর কোচ বিল হার্ট পত্তন করে দিলেন সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচের ফুটবল-শৈলীর।
আবাহনীর জন্মের পর থেকে আমি তার সমর্থক। অবশ্য আমি সেই জাতের সমর্থক যার পক্ষে মোহামেডান গ্যালারিতে বসে খেলা দেখা প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনা ছিলো। সুতরাং দলানুগত্যের বাইরে থেকেও বলতে পারি, বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবলের শুরু আবাহনীর হাত ধরে। ক্রমশ অন্য দলগুলিও এই ধারা অনুসরণ করতে শুরু করে। ফুটবল তখন বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিলো, এই নবযাত্রায় তা আরো বেগবান হয়। আপনাদের প্রজন্মের ফুটবলাররা এর অনুঘটক ছিলেন, এ কথা কেউ অস্বীকার করবেন বরে মনে হয় না।
শুধু খেলার ধাঁচ নয়, সেই সময়ের খেলোয়াড়দের চেহারা ও পোশাক-আশাকও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কাঁধসমান লম্বা চুল নিয়ে দ্রুতগামী অশ্বের মতো কেশর দুলিয়ে খেলোয়াড়দের ঢাকার মাঠ দাপিয়ে বেড়াতে এর আগে কে কবে দেখেছে! পৃথিবীর অন্যসব দেশে যেমন হয়, বাংলাদেশেও সালাউদ্দিন-নান্নুর মতো ঝাঁকড়া চুল রাখা এবং খেলোয়াড়দের ফ্যাশন অনুকরণ করার রীতি প্রচলিত হয়ে যায় তখন। ফুটবল ভদ্রলোকের খেলা নয় বলে সেই সময়ে সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণাও আপনারা ভাঙতে সক্ষম হলেন। খেলাপাগল মানুষ ও সমর্থকদের উন্মাদনা শুধু নয়, ফুটবল তখন এক ধরণের সামাজিক বিবর্তনের অনুঘটক হয়ে ওঠে। আমার পিতা খেলাধুলা বিষয়ে চরমতম উদাসীন মানুষ ছিলেন, তাঁকেও একসময় ফুটবল ও সালাউদ্দিনকে এক করে জানতে এবং মানতে হয়।
সংকীর্ণ রাজনীতি এবং ধারাবাহিক প্রশাসনিক ব্যর্থতায় আপনাদের হাতে শুরু হওয়া ফুটবলের উত্থান ও অগ্রযাত্রা আমরা অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হয়েছি, তা অন্য প্রসঙ্গ।
খেলোয়াড়ী জীবনে আপনি খেলেছেন মধ্যমাঠে গেমমেকার হিসেবে এবং রক্ষণভাগে লেফট ব্যাক ও স্টপার হিসেবে। মঞ্জু ভাই রাইটব্যাক খেলেছেন বরাবর। খেলোয়াড় হিসেবে আপনারা দুই ভাই নিজেদের পজিশনে তাঁদের সময়ের এবং সম্ভবত বাংলাদেশ ফুটবলে সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। অথচ খেলার স্টাইল ও মাঠ-ব্যক্তিত্বের বিচারে দু’জন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। আপনি স্থিতি ও প্রশান্ত মেজাজের প্রতীক, আপনার খেলা ধীর অথচ ঋজু কবিতার মতো শিল্পসুষমামণ্ডিত, মনোহর। মঞ্জু ভাই আপনার ঠিক বিপরীতে। তাঁর মাঠ-ব্যক্তিত্ব ছিলো কিছুটা রূঢ়, তীক্ষ্ণমেজাজী ও পৌরুষদীপ্ত। মাথা-গরম ফুটবলার হিসেবে মঞ্জু ভাইয়ের এবং তার অব্যবহিত পরে টুটুলের খ্যাতি (নাকি কুখ্যাতি!) ছিলো। আগে অন্যদের কাছে শোনা ছিলো এবং এখন পরিচয় হওয়ার পর দেখছি, মাঠের মঞ্জুর সঙ্গে এই মঞ্জুকে একদমই মেলানো যায় না। টুটুলের বেলায়ও এই ঘটনা দেখেছি।
রাইটব্যাক যে আক্রমণাত্মক খেলা খেলতে পারে, রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ও আক্রমণে সহায়ক হতে পারে মঞ্জু ভাইয়ের খেলায় দেখে ঢাকার দর্শক তা প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিলো। এক অর্থে তা ছিলো এক ধরনের বিপ্লবাত্মক ঘটনা। মঞ্জু ভাই মোহামেডানে চলে গেলে আবাহনীতে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন টুটুল, তিনিও মঞ্জু ভাইয়ের খেলার ধারাটিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। মনে পড়ছে, একবার একটি পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে মঞ্জু ভাই বলেছিলেন, ৭৫ ও ৭৬-এ টুটুল যে খেলা খেলেছিলো তা ধরে রাখতে পারলে মঞ্জু নামে ঢাকার মাঠে কেউ যে কোনোদিন খেলেছিলো তা আর কেউ মনে রাখতো না। রূঢ় ও তীক্ষ্ণমেজাজী বলে পরিচিত মঞ্জু ভাই বলছেন এই কথা তাঁরই সমসাময়িক এবং একই পজিশনের খেলোয়াড় সম্পর্কে। বাংলাদেশে এই বিনয় খুব বেশি দেখতে আমরা অভ্যস্ত নই।
১৯৭৪-র আইএফএ শীল্ড টুর্নামেন্টের কথা আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে। আবাহনী গেছে কলকাতায় খেলতে। তখন টিভিতে খেলা দেখানোর চল হয়নি। বিটিভি ছিলো, কিন্তু কলকাতায় দূরদর্শন সম্ভবত চালুও হয়নি তখনো। রেডিওতে ধারাবর্ণনা শুনছিলাম, আবাহনী খেলছে কলকাতার অন্যতম সেরা দল ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে। দুর্দান্ত খেলেছিলো আবাহনী এসদিন। একসময় আকাশবাণীর ধারাভাষ্যকারকে যা বলতে শুনলাম তার বক্তব্যটি এরকম: ‘ঝাঁকড়া চুলের দীর্ঘদেহী বাংলাদেশের ছেলেটি মাঝমাঠে কাউকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না, যেন এলাকাটি তার একান্ত নিজস্ব’।
ওই ধারাবর্ণনা আপনি শোনেননি, তখন আপনি মাঠে। ‘ঝাঁকড়া চুলের দীর্ঘদেহী ছেলেটি’ বলে যাকে বর্ণনা করা হচ্ছিলো, তার নাম নান্নু। তখন আপনি মাঝমাঠের খেলোয়াড়। হাঁটুতে আঘাতজনিত কারণে পরবর্তী বছরগুলিতে স্টপার হিসেবে খেলেছেন। মাঠে সবচেয়ে দ্রতগতির খেলোয়াড় আপনি ছিলেন না, তা আপনি নিজেও স্বীকার করবেন। আপনি খেলতেন নিজস্ব দক্ষতা, ফুটবলবোধ এবং বুদ্ধি ও সুবিবেচনা মেশানো এক অসাধারণ খেলা। দৃষ্টিনন্দন ছিলো আপনার পাসিং ও নিখুঁত হেডওয়ার্ক। হেড করে বলটি গোলমুখ থেকে সরিয়ে দেওয়াই একমাত্র কাজ নয়, বরং বলটিকে নিজ দলের খেলোয়াড়ের নাগালে পৌঁছে দিতে হবে, তা আপনার মতো করে আর কাউকে করতে ঢাকার মাঠ কখনো দেখেনি।
সবচেয়ে দর্শনীয় ছিলো আপনার স্লাইড ট্যাকল, স্টপারের সর্বশেষ অস্ত্র। খানিকটা জুয়ার মতো। রক্ষণভাগের শেষ খুঁটি স্টপার, যার পরাস্ত বা ব্যর্থ হওয়ার অর্থ বিপক্ষের আক্রমণের সামনে গোলরক্ষক সম্পূর্ণ একা ও অরক্ষতি। অথচ জুয়াটি খেলতেন আপনি খুব হিসেব করে, পেশাদার জুয়াড়ির দক্ষতায়। অধিকাংশ সময়ে আপনি জিতে এসেছেন অসাধারণ সময়জ্ঞানের কারণে। এই অস্ত্রটি আপনি ব্যবহার করতে জানতেন নিখুঁতভাবে। আপনাকে অনায়াসে বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ও স্টাইলিশ স্টপার বলতে আমাদের একটুও ইতস্তত করতে হবে না।
এমনকি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় ও সমর্থকদের সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিলেন আপনি। ৮২-তে খেলা থেকে অবসর নেওয়ার আগে আপনার শেষ খেলাটি গ্যালারিতে বসে দেখেছিলাম, মনে আছে খেলার শেষে সতীর্থ ও প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের সঙ্গে আবেগময় বিদায় জ্ঞাপনের দৃশ্যটি। সারা স্টেডিয়ামের দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতায় অভিনন্দিত করেছিলো ঢাকার ফুটবলের রাজসিক খেলোয়াড়টিকে।
আজ আপনাকে লিখছি এই বিদায়ের প্রসঙ্গ নিয়েই। ডাক্তার জবাব দিয়েছে, আর কিছু করণীয় নেই – এর চেয়ে ভয়ংকর কোনো কথা আর হয় না। যার প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে তার জন্যে তো বটেই, তার আশেপাশের মানুষ, প্রিয়জন ও স্বজন-বন্ধুদের জন্যেও এক ভয়াবহ অসহায়তার অনুভব। আপনার জন্যে অচেনা, কোনোদিন না-দেখা অসংখ্য মানুষও কাতর হবে, অশ্রু বিসর্জন দেবে। আপনি তার কিছুই জানবেন না। জেনেই বা কী এসে যাবে!
১৯৯৮ সালে একদিন পত্রিকায় পড়ে চমকে উঠলাম, কর্কটরোগে আক্রান্ত আপনি। এমনই এক রোগ যার নামই অস্তিত্বের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। তবু চিকিৎসায় সেরে উঠলেন আপনি। কিছুকাল পরে আবার ফিরে এলো রোগ। এইভাবে ক্যানসারের সঙ্গে এক ধরনের লড়াই চলছিলো আপনার প্রায় দশ বছর ধরে। এই লড়াইয়ের মাশুল এখন গুনছে আপনার শরীর। কিডনি অকেজো হয়েছে, ডায়ালিসিস চলছে, তার সঙ্গে আরো আনুষঙ্গিক জটিলতা। স্টপার আজ ক্লান্ত, তার স্লাইড ট্যাকল হয়তো এবার ব্যর্থ হতে চললো। আজ একটু আগে জানলাম, সম্প্রতি আপনার ছোটোখাটো স্ট্রোকও হয়ে গেছে বার চারেক। ডায়ালিসিস চলছে ক্রমাগত।
এইসব সময়ে বোঝা যায় আমাদের মনুষ্যজীবনের নশ্বরতা ও সীমাবদ্ধতা। মতি নন্দীর ‘স্টপার’ উপন্যাসের পরাক্রান্ত স্টপার মাঠে অপরাজেয় হলেও বাস্তব জীবনের রূঢ় আক্রমণের সামনে সে প্রতিরোধহীন। মাঠে প্রতিপক্ষের দুরন্ত স্ট্রাইকারকে রুখে দেওয়ার কৌশল আপনার জানা ছিলো, কিন্তু এই যে চলে যাওয়ার কথা উঠছে সেখানে আপনার – বস্তুত সব মানুষেরই – কিছুই করণীয় নেই। অনিবার্য জেনেও এর জন্যে প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয় না।
এদিকে মঞ্জু ভাই কী করেন? তিনি নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা ৯২ থেকে। গত বছর তাঁর ডালাস শহরে চলে আসার কথা, বাড়ি কিনে স্ত্রী-পুত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন, নিজে থেকে গেছেন নিউ ইয়র্কে। বিষণ্ণ মুখে বললেন, কী করে আসি? কখন নান্নুর কী খবর আসে, ওখান থেকে তৎক্ষণাৎ রওনা হয়ে যেতে পারবো। কখন যেতে হয়, কে জানে!
৭২-এ শোনা আকাশবাণীর ধারাভাষ্যকারের বাক্যটি মনে আসে – মাঝমাঠে ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটি কাউকে দাঁড়াতেই দিচ্ছে না। মহামহিম সেই অন্তিম হয়তো বাস্তব হয়ে মাঝমাঠের কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছে, সেখানে যে সে কাউকে কখনো দাঁড়াতে দেয়নি। দেবে না।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০০৮ সকাল ১০:২৮