কোন একটা ধর্ষনের ঘটনা ভাইরাল হলে অনলাইনে ২টা পক্ষ তৈরী হয়ে যায়। আমরা যার যার মতামত নিয়ে হাজির হয়ে যাই। এরমধ্যে কেউ বলে পুরুষই একমাত্র দায়ী, কেউ আবার বলে ঐ মাইয়া নাইট ক্লাবে গেসে কেন অথবা ওর পোষাক খারাপ। আমার এই লেখা কারো লাইক কামানোর জন্যতো নয়ই বরং কারো যদি এই লেখা পড়ে আমাকে খারাপ মনে হয়, তাহলে বলবো আলহামদুলিল্লাহ। আরেকটা কথা, পুরো পোস্ট না পড়ে দয়া করে কেউ কমেন্ট করবেন না।
আজ আমরা এখানে পবিত্র কুরআনের সুরা নূরের ৩০ ও ৩১ নং আয়াত এবং সুরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো।
সুরা নূরের ৩০ নং আয়াতে পুরুষের সংযম এবং ৩১ নং আয়াত ও সুরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াতে নারীদের সংযম নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে সুরা নূর আল কুরআনের ২৪ নং সুরা এবং সুরা আহযাব ৩৩ নং সুরা। তার মানে আল কুরআনে আল্লাহ প্রথমে পুরুষের সংযমের কথা বলেছেন, তারপর নারীদের। কিন্তু তাই বলে এটা ভাবার কোন অবকাশ নেই যে তাতে নারীদের সংযমকে হালকা করে দেখা হয়েছে। শুধুমাত্র পুরুষের সংযমকে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
"আন-নূর ২৪:৩০
قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا۟ مِنْ أَبْصَٰرِهِمْ وَيَحْفَظُوا۟ فُرُوجَهُمْۚ ذَٰلِكَ أَزْكَىٰ لَهُمْۗ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرٌۢ بِمَا يَصْنَعُونَ
মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।"
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় দুটি হাদিস উল্লেখযোগ্য।
১. হযরত বুরাইদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ) কে বলেনঃ "হে আলী (রাঃ) দৃষ্টির উপর দৃষ্টি ফেলোনা। হঠাৎ যে দৃষ্টি পড়ে ওটা তোমার জন্য ক্ষমার্হ কিন্তু পরবর্তী দৃষ্টি তোমার জন্য ক্ষমার যোগ্য নয়।" (আহমাদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, দারেমী)
২. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, "আদম সন্তানের জন্য তাক্বদীরে যিনার অংশ যতটুকু নির্ধারণ করা হয়েছে, সে ততটুকু অবশ্যই পাবে। দুই চোখের যিনা তাকানো, কানের যিনা যৌন উদ্দীপ্ত কথা শোনা, মুখের যিনা আবেগ উদ্দীপ্ত কথা বলা, হাতের যিনা (বেগানা নারীকে খারাপ উদ্দেশে) স্পর্শ করা আর পায়ের যিনা ব্যভিচারের উদ্দেশে অগ্রসর হওয়া এবং মনের যিনা হলো চাওয়া ও প্রত্যাশা করা। আর যৌনাঙ্গ তাকে পূর্ণতা দান করে অথবা পূর্ণতা দান থেকে বিরত থাকে। (বুখারী ৬২৪৩, মুসলিম ২৬৫৭, আবূ দাঊদ ২১৫২)
তার মানে রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে হঠাৎ চোখ পরে গেলে সমস্যা নেই, কিন্তু দ্বিতীয়বার তাকানো যাবে না। আবার দ্বিতীয়বার যেহেতু তাকানো নিষেধ এই ভেবে প্রথমবারেই ভালোমতো দেখে নিলাম এমনটাও করা যাবে না। এজন্যই বলা হয়েছে দৃষ্টি নত রাখার কথা। আর সর্বপ্রকার যিনা থেকে দূরে থাকাটাই পুরুষত্ব। (অন্তত ইসলাম তাই বলে)
"আন-নূর ২৪:৩১
وَقُل لِّلْمُؤْمِنَٰتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَٰرِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَاۖ وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ ءَابَآئِهِنَّ أَوْ ءَابَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَآئِهِنَّ أَوْ أَبْنَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَٰنِهِنَّ أَوْ بَنِىٓ إِخْوَٰنِهِنَّ أَوْ بَنِىٓ أَخَوَٰتِهِنَّ أَوْ نِسَآئِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَٰنُهُنَّ أَوِ ٱلتَّٰبِعِينَ غَيْرِ أُو۟لِى ٱلْإِرْبَةِ مِنَ ٱلرِّجَالِ أَوِ ٱلطِّفْلِ ٱلَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا۟ عَلَىٰ عَوْرَٰتِ ٱلنِّسَآءِۖ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّۚ وَتُوبُوٓا۟ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।"
প্রথম দুটি লাইনে পুরুষদের যা বলা হয়েছিল তা-ই আবার নারীদের ক্ষেত্রে বলা হলো, দৃষ্টি নত রাখা ও যৌনাঙ্গের হেফাযত করা। কিন্তু নারীদের দৃষ্টি নত রাখা পুরুষদের চেয়ে কম গুরুত্ব বহন করে, নয়তো পুরুষদেরও শরীর ঢাকার বিধান চলে আসতো।
তারপর বলা হলো যা সাধারনত প্রকাশমান তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য যেন প্রকাশ না করে। এখানে যা সাধারণত প্রকাশমান বলতে মুখ ও হাতের কব্জি পর্যন্ত অংশ বুঝানো হয়েছে।
"আয়িশাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। একদা আসমা বিনতু আবূ বাকর (রাঃ) পাতলা কাপড় পরিহিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থেকে নিজের মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেনঃ হে আসমা! মেয়েরা যখন সাবালিকা হয় তখন এই দু’টো অঙ্গ ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ প্রকাশ করা তার জন্য সংগত নয়, এ বলে তিনি তাঁর চেহারা ও দু’ হাতের কব্জির দিকে ইশারা করেন।
(সুনানে আবু দাউদ)"
আর তারপর বলা হয়েছে মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখার কথা। এখানে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে পূর্বের হাদীস অনুযায়ী ওড়না পাতলা হওয়া যাবে না।
সবশেষে বলা হয়েছে তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জা প্রকাশের জন্য জোরে পদচারণা না করে এবং তওবা করে।
অর্থাৎ এ ব্যাপারে এ পর্যন্ত যেসব ভুল-ভ্রান্তি হয়ে গেছে তার জন্য তওবা করে ভবিষ্যতের জন্য আল্লাহ ও রাসুলের দেখানো পথে চলার শপথ করতে হবে।
"আল-আহযাব ৩৩:৫৯
يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِىُّ قُل لِّأَزْوَٰجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَآءِ ٱلْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَٰبِيبِهِنَّۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰٓ أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا
হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।"
সুরা নূরের ৩১ নং আয়াতের সাথে মিলাতে গেলে এই আয়াতে একটি পরিবর্তন লক্ষণীয়, এখানে ওড়নার বদলে চাদর ব্যাবহার করা হয়েছে। 'জালবাব' ঐ চাদরকে বলা হয় যা স্ত্রীলোকেরা তাদের দোপাট্টার উপর পরে থাকে।
উপসংহারঃ
১. পুরুষের সংযমের কথা আগে বলা হয়েছে, নারী যত বাজে পোষাক পরেই চলুক না কেন পুরুষ যদি দৃষ্টি নত রাখে তাহলে খারাপ কিছু হওয়ার আশংকা থাকে না।
২. যেহেতু নারীদের নিজেদের ঢেকে রাখার কথা বলা হয়েছে তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে যে, সব নারী যদি পর্দা করে তাহলে পুরুষের দৃষ্টি নত করে চলার দরকার কি? ধরে নিলাম বেশিরভাগ মুসলিম নারীরা পর্দা মানা শুরু করলো, কিন্তু অমুসলিম নারীদের আর শয়তানের অনুসারী মুসলিম নারীদের তো আর জোর করে পর্দা করানো যাবে না, সুতরাং সব ধরনের যিনা থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে।
৩. একইভাবে নারীদের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আল্লাহর আদেশ মানতে হবে কোন প্রশ্ন ছাড়াই।
"আল-জিন ৭২:১৩
وَأَنَّا لَمَّا سَمِعْنَا ٱلْهُدَىٰٓ ءَامَنَّا بِهِۦۖ فَمَن يُؤْمِنۢ بِرَبِّهِۦ فَلَا يَخَافُ بَخْسًا وَلَا رَهَقًا
আমরা যখন সুপথের নির্দেশ শুনলাম, তখন তাতে বিশ্বাস স্থাপন করলাম। অতএব, যে তার পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস করে, সে লোকসান ও জোর-জবরের আশংকা করে না।"
৪. পুরুষকে নারীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। তাই বলে পুরুষত্ব মানে দূর্বল নারীর উপর অত্যাচার করা নয়, নারীকে একা পেয়ে ধর্ষণ করা নয়। এগুলো বরং সহজ, কারন শয়তান এখানে সাহায্য করে। পুরুষত্ব দেখাতে চাইলে বিকেলবেলা নিউমার্কেটে ৩০ মিনিট ঘুরে আসুন কোন মেয়ের দিকে না তাকিয়ে অথবা ঈদের বাজারে বসুন্ধরা সিটি বা যমুনা ফিউচার পার্কে ১ ঘন্টা শপিং করুন দৃষ্টি নত রেখে, আমি চেষ্টা করেছি, খুবই কঠিন। শয়তান এখানে আপনাকে বাঁধা দেবে। শয়তানের এই বাঁধা উপেক্ষা করে যদি দৃষ্টি সংযত রাখতে পারেন তাহলেই আপনি আসল পুরুষ।
৫. আমি নিজে দৃষ্টি সংযত করে চললাম, তাই বলে সবাইতো আর ভালো হয়ে যাবে না। নিজের মা, বোন, স্ত্রীর সাথে কোন খারাপ কিছু ঘটে গেলে যতই আন্দোলন করি আর বিচার চাই এবং যদি সুবিচার পেয়েও যাই, তাদের স্বাভাবিক জীবন কি ফিরে আসবে? তাই তাদেরকে আল্লাহর আদেশ পালন করাতে হবে। মনে রাখতে হবে চেষ্টা করার দায়িত্ব আপনার, হেদায়েত দেবার মালিক আল্লাহ।
আল্লাহ আমাদের মা বোনদেরকে হেফাযত করুন, আমাদের সবাইকে হেদায়েত দিন, আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৭ রাত ৯:৩০