মেয়েটি উঠে আসতেই যেন আলোকিত হয়ে উঠলো বাসের ভেতরটা! এক কথায়- অপরূপা। একনজর দেখেই আমার বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা ধড়াস করে উঠলো!
বাস থেমে আছে বাড্ডা লিংক রোডের স্টপেজে। লোকজন উঠছে। আমি দ্রুত ক্যালকুলেশন করতে থাকলাম। মেয়েটা কোন সিটে বসতে যাচ্ছে? মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত সিটগুলো সব বোরখা পরা আন্টিরা বুক করে রেখেছে। সুতরাং, মেয়েদের সিটে বসার কোনো সুযোগ নেই তার।
আমি বসে আছি বাসের তৃতীয় রো-তে, বাম দিকে দুজনে বসার সিটে। পাশের সিট খালি। সামনের রো-তেও একটা সিট খালি আছে। বসতে হলে এই দুটো সিটের মধ্যে একটিতেই বসতে হবে। আমার সামনের সিটে বসে এক বুড়ো পান চিবাচ্ছে। কোনো রুচিশীল মেয়ের তার পাশে বসার কথা না। তারমানে তাকে বসতে হলে আমার পাশেই বসতে হবে!
দিনের সবচেয়ে বোরিং মুহূর্ত কাটাচ্ছিলাম আমি। অফিস শেষে বাসে করে ফিরছিলাম। ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি মুহূর্তটা আজ হঠাৎ অন্যরকম রূপ নেবে! এই আগুন সুন্দরীর পাশে বসে বাকি রাস্তাটা যাবো, ভাবতেই উত্তেজনায় গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই, মেয়েটি ঐ বুড়োকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এলো। আমি যতটা পারলাম জানালার কাছে সরে গেলাম, যাতে তার বসতে কষ্ট না হয়। কিন্তু আমাকে হতবাক করে সে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলো! সম্ভবত আমার পেছনেও কিছু সিট ফাঁকা আছে। আমাকে পাশে বসার যোগ্য মনে করলো না?
আবার চমকে উঠলাম। মেয়েটির ঝট করে আমার পাশেই বসে পড়েছে! এটা কি ছিলো? ও কি আমাকে বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করলো নাকি? পাশে না বসলে আমার মন খারাপ হয় কিনা দেখতে চাইলো?আমি মৃদু হাসলাম। দাঁড়াও মেয়ে, তোমাকে দেখাচ্ছি মজা!
বাস চলতে শুরু করলো। মিনিট দুয়েক নীরবে কেটে গেলো। আমি মনে মনে চিন্তা করছি মেয়েটির সাথে কীভাবে কথা বলা যায়। ভালো একটা বুদ্ধি মাথায় এলো। পাশে তাকিয়ে বললাম, “আচ্ছা, মালিবাগ কি চলে এসেছি?"
মনে মনে হাসলাম আমি। এই রাস্তায় আমি রেগুলার বাসে চেপে যাতায়াত করি। খুব ভালো করেই জানা আছে মালিবাগ এখনও অনেক দূর!
মেয়েটি হাসি মুখে বললো, "আরে না না! মালিবাগ এখনও অনেক দেরি।"
মেয়েটি হাসছে কেন? ও কি বুঝে ফেলেছে আমি যে কথা বলার উছিলা খুঁজছিলাম? আমি অভিনয় চালিয়ে গেলাম, "ওহ! আসলে কখনো ওদিকে যাইনি তো।"
মেয়েটি বললো, "সমস্যা নেই। মালিবাগ এলে আমি বলবো আপনাকে।"
"থ্যাংক ইউ! আপনি কই নামবেন?"
"মালিবাগেই।"
লাও ঠ্যালা! আজ আমার কপালই বলতে হবে! বাস থেকে নেমে মেয়েটিকে ফলো করে তার বাসাটাও চিনে নেওয়া যাবে। এমন অনিন্দ্যসুন্দরী একটা মেয়ের সাথে প্রেম না হোক, রেগুলার দেখা-সাক্ষাৎ হলেও খুব ভালো লাগবে। কিন্তু সে জন্য আরও একটু ক্লোজ হতে হবে। কীভাবে হওয়া যায়?
মেয়েটি ফোন বের করলো। ফেসবুকে ঢুকছে। আমি আড়চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকলাম তার ফোনের দিকে। নাম- জেরিন তাসনীম। ফেসবুক প্রোফাইলে শাড়ি পরা ছবি। ফেসবুক আইডিও পেয়ে গেলাম। বাসায় ঢুকেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবো।
খুব বাতাস বইতে শুরু করলো হঠাৎ। মেয়েটির চুল উড়ে এসে আমার চোখে মুখে লাগতে থাকলো। সে খুব চেষ্টা করছে চুলগুলো বাগে রাখতে। কিন্তু বেয়াড়া চুল তা মানছেই না! আমি আবেশে চোখ বন্ধ করলাম! আহ! এই তো জীবন।
হঠাৎ বাস ব্রেক করলো। হেলপার চিৎকার করে উঠলো, "এই রামপুরা, রামপুরা!"
মনে মনে গালি দিলাম হেলপারকে। শালা শুয়োরের বাচ্চা, বাস থামানোর আর সময় পেলি না?
বাসে লোকজন উঠতে শুরু করলো। সব সিট বুকড। যাত্রীর ভিড় জমে গেলো। একজন পেছন থেকে চিৎকার করলো, “ঐ ব্যাটা, বাস ছাড়! হইছে তো, আর কত লোক নিবি?” তার সাথে সাথে সুর মেলালো আরও কয়েকজন।
বাস ছেড়ে দিলো আবার। আমাদের সিটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক বয়স্ক লোক। কাশছে অনবরত। মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার। এমন সুন্দর রোম্যান্টিক মুহূর্তটা নষ্ট করে দিচ্ছে বিরক্তিকর কাশির শব্দ! আমি ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দিয়ে মেয়েটির দিকে মনযোগী হলাম। কি সুন্দর মায়াময় চোখদুটো। ঐ চোখে তাকিয়ে পৃথিবীর সব ভুলে যাওয়া যায়!
হঠাৎ মেয়েটা উঠে দাঁড়ালো। ঐ কাশতে থাকা বয়স্ক ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে বললো, “আংকেল আপনি এখানে বসেন।”
হোয়াট? এইটা আবার কী হলো?
মেয়েটা সরে গেলো। বয়স্ক লোকটা বসছে আমার পাশে। আমি মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকালাম।
মেজাজ বিগড়ে গেছে আমার। বাস ভর্তি এতো পুরুষ মানুষ। তারা কেউ উঠছে না, আর তুই মেয়ে মানুষ হয়ে উঠে গেলি? মানবতার অবতার তুই? মাদার তেরেসা? তোর ওঠার দরকার কি ছিলো? কাশি কি হয় না মানুষের?
“তুহিন, আজ অফিস কেমন হলো বাবা?”
আমি চমকে উঠলাম ভীষণভাবে! ঝট করে তাকালাম পাশে বসা বয়স্ক ব্যক্তির দিকে। লোকটা আমার বাবা!
“বা… বাবা তুমি?”
“হ্যাঁ। একটু ডাক্তার দেখাতে আসছিলাম…” বলেই আবার কাশতে শুরু করলেন বাবা।
আমি চোখ তুলে তাকালাম মেয়েটির দিকে। কেমন সহানুভূতির দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে! অচেনা-অজানা এক বয়স্ক লোকের জন্য তার চোখ দুটোতে রাজ্যের মায়া!
লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে গেলো।
আজ এক নারীর মহত্ত্বের কাছে পরাজিত হলো পুরুষ।