বাংলাদেশ বনাম আয়ারল্যান্ড খেলার বর্ণনা না দিয়ে অন্য ভাবে লেখা শুরু করি।
বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে তখন একেবারে নতুন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের মাটিতে টেস্ট খেলতে যাবে। ২০০১ সালের কথা। তার আগে ঢাকায় জাভেদ মিয়ানদাদ বাংলাদেশে এসে সবাইকে ব্যাটিং টিপস দিলেন। সবার সমস্যা শুনলেন। হাবিবুল বাশার সুমনকে বললেন তুমি ৩০ রানকে যেভাবে ৫০ রান বানাতে পারো সেভাবে ৭০ করে ফেললেও ১০০ করে গেলা উচিৎ। সেটা পার কিনা দেখো।
পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচের স্মৃতি ভাল ছিলনা। পাকিস্তানের ৬ ব্যাটসম্যানের মধ্যে একমাত্র ফয়সাল ইকবাল ছাড়া বাকি ৫ জন সেঞ্চুরি করল এবং এটা টেস্ট ক্রিকেটে একবারই হয়েছে। বাংলাদেশ তাদের প্রথম ইনিংসে ১৮০ আর দ্বিতীয় ইনিংসে ১৫০ জাতীয় কিছু করল। অনেকেই আজেবাজে শট খেলে আউট হল। জাভেদ মিয়ানদাদকে গিয়ে পাকিস্তানী সাংবাদিকরা বলল, আপনি তাদের যা বললেন তার কিছুই তো তারা মাঠে করতে পারলনা!! আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশকে দিয়ে ক্রিকেট হবে? এর জবাব জাভেদ মিয়ানদাদ যা দিলেন সেটার জন্যই আসলে লেখার ভুমিকাটা ২০০১ এ নিয়ে যাওয়া। জাভেদ মিয়ানদাদ বললেন, অবশ্যই বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা উচিৎ। পৃথিবীর আর কোন দেশেই এরকম খেলার পরেও আপনি স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক পাবেননা। বাংলাদেশের প্রাণ হল বাংলাদেশের দর্শক।
গতকাল আয়ারল্যান্ডের সাথে বাংলাদেশ যে ২০৫ করেও জিতল, আমি মোটামুটি নিশ্চিত এই খেলাটি পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে হলে বাংলাদেশ এভাবে জিততনা। ১৬ কোটি মানুষের প্রার্থনার সাথে ২৫ হাজারের হর্ষধ্বনিটাই জিতিয়েছে বাংলাদেশকে। স্টেডিয়ামের ভিতরের চিত্র ছিল সমগ্র জাতিকে এক করিয়ে দেওয়ার চিত্র। বিপদে এক হয়ে যাওয়ার চিত্র। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যান আউট হচ্ছে কেউ হয়ত গালি দিল, পরক্ষনেই পাশেরজন হয়ত আভাস দিল ভাই আশা হারাবেননা, ক্রিকেটে শেষ বল হওয়ার আগে কিছুই বলা যাবেনা। আমাদের ছেলেদের লড়তে দিন। তবে সেই লড়ার মাঝে কিছু ফাক-ফোকর ছিল। এরকম সূচনার পর ইমরুল কায়েস এভাবে আউট না হলেও হত। জুনায়েদ সিদ্দিকী রান নেওয়ার চেষ্টা করেছেন কিন্তু রান আউট থেকে বাঁচার জন্য আপ্রান চেষ্টাতে ঘাটতি ছিল (সে মডেল হতে চায় বলে কি ডাইভ দেওয়া যাবেনা নাকি!!)। আইরিশরা উইকেট এর পেস-অফ করে বল করছিল। মানে হল স্লো উইকেটে যাতে ব্যাটসম্যানরা টাইমিং করতে না পারে তাই গতিতে বৈচিত্র আনা।। সেই ধাধায় মিস টাইমিং হল সাকিবের। হটাৎ উরন্ত সূচনার পর সব থেমে গেল। কিন্তু থেমে নাই দর্শকরা। বুকে তখনও আশা। সবাই দলকে সমর্থন দিয়েই যাচ্ছে। এতক্ষন তামিমের ৪ মারার সময় চিৎকার ছিল। এখন প্রতিটা সিঙ্গেলে চিৎকার। গ্যালারিতে বসে থাকা দর্শকদের অনেকের মোবাইলে ফোন আসছে। যারা ফোন করছে তারা হয়ত জানতে চাচ্ছে কি হবে। গ্যালারীতে কিন্তু কোন নৈরাশ্য নেই। কারন আমরা জানি আমরা আজ দলকে জিতিয়েই যাব। এক দর্শক মোবাইলে বলতে লাগলেন, " আরে চিন্তা করিস না, রকিবুলরে তো অনেক রিকোয়েস্ট কইরা একটা সিঙ্গেল নেওয়াইলাম। ২৫০ হইলেই হইব"। তখনও আমাদের আশা ২৫০ হবে। মুশফিক রকিবুল প্লার্টফর্ম সাজিয়ে দিয়ে যাবে। আশরাফুল এসে পাওয়ার প্লেতে রান তুলে নিবে। উইকেটে যেহেতু বল ব্যাটে আসছেনা সোজা ব্যাটে খেলাই ভাল ছিল। ব্যাটটাকে চামচ বানাতে গিয়ে আউট হয়ে গেল মুশফিক রহিম। মানুষ আশরাফুলোকে যতই গালি দিক সে মাঠে প্রবেশ করা মানে অন্য কিছু। সব দর্শকই নড়ে চড়ে উঠল। কিন্তু আশরাফুল এসে দেখিয়ে গেল কিভাবে মুশফিক আউট হয়েছিল। মন মেজাজ আমার তখন খারাপ। গ্যালারী থেকে উঠে ফুড কর্নারে গেলাম। বিরিয়ানী কিনলাম। বিরিয়ানীতে এক পিস মুরগী আর এক পিস ডিম দেয়। সেই ডিম এ এক কামড় দেওয়া মাত্রই শুনলাম আরেকটা আউট। রকিবুল রান আউট সেটা নিজ চোখে দেখিনি। আস্ত ডিমটাকেই ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম। ফুড কর্নারের লোকজন খুব অবাক হলনা। বাংলাদেশে দর্শকরা যে বাংলাদেশের খেলায় কুসংস্কার বিশ্বাস করে এটা তাদের ভালই জানা। গ্যালারীতে ফিরে গেলাম। মাইকেল বিভান একবার একটা কথা বলেছিলেন, মাঝে মাঝে ৩০ রানও অনেক সেঞ্চুরির থেকে মূল্যবান যদি সেটা দলের কাজে লাগে। যেমন সে ১৯৯৯ এর সেমিফাইনালে খেলেছিল সাউথ আফ্রিকার সাথে। কালকে নাইমের ২৯ রানও কোন অংশে একটি হাফ সেঞ্চুরির থেকে কম না। কারন সংখ্যার বিচারে ২০০ আর ১৯৯ এর মধ্যে পার্থক্য ১ হতে পারে, কিন্তু ক্রিকেট শরীরের দক্ষতার পাশাপাশি মনেরও খেলা। এই মনের খেলায় ১ রান অনেক। ১ রানের জন্য দুই দুইবার বিশ্বকাপ থেকে দক্ষিন আফ্রিকার ফেরত যেতে হয়েছিল। আজকে প্রথম আলোতে মাশরাফি বলেছেন, ১৯৯ কে মনে হয় ১০০ এর ঘরে আর ২০৫ কে ২০০ এর ঘরে।
আয়ারল্যান্ড ব্যাটিং শুরুর পর প্রত্যেকটি দর্শক বুঝে গেল আজ দলকে জেতাতে আমাদের সমর্থন লাগবে। তাই ১৬ রানের মাথায় ক্যাচ পড়লেও দর্শকরা একজন আরেকজনকে বুঝাতে লাগল শান্ত হন, আমরাই জিতব। স্টেডিয়ামে থাকা প্রতিটা দর্শক যে কোন অবস্থাতে এটাই বিশ্বাস করে চলছি আমরাই জিতব। আমি সাউথ গ্যালারী আমার বাম সাইডে তাকালেই ভিআইপি এলাকায় কবি নির্মলেন্দু গুনকে দেখা যাচ্ছে। কবিও মনে হয় চেষ্টা করছেন কোন ভাবে কবিতার ছন্দে যদি বাংলাদেশকে জিতানো যায়। আমার পিছনে সপরিবারে বসা এক ভদ্রলোক। আমরা সবাই বাংলাদেশ বাংলাদেশ চিল্লাই তার ৪ বছরের অবুঝ বাচ্চা বলে আয়ারল্যান্ড আয়ারল্যান্ড। ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি কেএফসি (স্টেডিয়ামে এদের বুথ আছে) থেকে চিকেন আর পেপসি নিয়ে আসল আর বাচ্চাকে বিশাল একটা বাংলাদেশের জার্সি পড়য়ে দিল। বাবারে আর আয়ারল্যান্ডের নাম নিস না। বাম পাশে তাকালাম। স্বামী-স্ত্রী খেলা দেখতে এসেছে। মহিলা জোরে জোরে বলছেম, আল্লাহ কালকে দুইটা ফকির খাওয়াব প্লিজ জিতিয়ে দাও। আমার আশে পাশে ভাইগ্না ভাগ্নি সবাই একজন আরেকজনকে বুঝয়ে যাচ্ছি না আজকে জিতবই। এর মাঝে মজার ব্যাপার স্যাপারও হতে লাগল। দেখা যায় যখন যাকে গালি দেওয়া হচ্ছে সে দলের কাজে লাগছে। আশরাফুল, তুই করিস নাকো ভুল বলার সাথে সাথে সে উইকেট পাচ্ছে। তবে জনগনের সব রাগ ওই অ্যাশের উপরই। নাইম ইসলামের বলে চার হলেও সেটা দোষ পড়ে আশরাফুলের উপর। আসলে তার আউটটাই যে মেনে নেওয়ার নয়। গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে হারানোর পর ট্রেন্ট জনসন চিকেন্স ড্যান্স নেচেছিলেন। আশরাফুলও তাই একজনকে বোল্ড করার পর বক্সিং ড্যান্স নাচলেন। এর মধ্যে একজন অন্য কিছু খুঁজে পেল। ফোক-সম্রাট মমতাজ যে খেলা দেখতে এসেছিলেন। আশরাফুল নাকি সেই খুশিতেই ওরকম নাচ দিল। তবে দুই ভাই ব্রায়ানকে আমার ভালই চেনা আছে। নেইল ও ব্রায়ানের ৭৩ রানের উপর ভর করেই আয়ারল্যান্ড পাকিস্তানকে হারিয়েছিল। কালকে স্টেডিয়ামে বসেও দেখলাম আর যে কারো থেকে এই দুই ভাই টাইমিং বেশ ভাল করে। আর নেইল অযথা ঝুকি নেননা। কিন্তু আমরা ২৫০০০ দর্শক বসে আছি কেন? সারাক্ষন চিৎকার আর চেচামেচি। খেলার ইকোয়েশন অনুযায়ী আয়ারল্যান্ড স্বাভাবিক ক্রিকেটটা খেললেই জিতে। কিন্তু আমাদের ২৫০০০ জনের দ্বায়িত্ব যেন টাইগাররা তাদেরকে দিয়ে অস্বাভাবিক কিছু করায়। সেটা হল। সাকিবের বল নেইল ও ব্রায়ান মারল। স্টেডিয়ামের প্রত্যেক দর্শক চিন্তা করল এই বলটা তামিম ধরবে কিভাবে? অসাধ্য সাধন হল। বলের ফ্লাইট আর তামিমের জাম্প একেবারে মিলে গেল। তামিম কিন্তু সেলিব্রেশন পিচের দিকে করেনি। ঘুরে দর্শকদের দিলে তাকিয়ে বলটি উপরে মারল। দেখ আমি তোমাদের জন্য ক্যাচটা ধরেই ফেললাম। দর্শকরাও আনন্দে আত্মহারা। শেষ ১৩ ওভারে আয়ারল্যান্ডের লাগে ৫৬ রান হাতে ৫ উইকেট। কোন দেশটা এখান থেকে হারবে বলুন। কিন্তু দর্শকরা তখনো গ্যালারীতে। আল্লাহ আল্লাহ করছে। কিছু একটা হবেই। এই প্রথম আমি আর নার্ভ রাখতে পারলাম না। বাথরুমে গেলাম। বাথরুম করে বের হয়ে গ্যালারীর দিকে না গিয়ে একটু বাইরে হাটলাম। আরেকটা পেপসি খেলাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি যতনা দর্শক গ্যালারীতে তার থেকে বেশি বাইরে। সবার হাত ভুভুজেলা আর বাংলাদেশের পতাকা। গ্যালারীতে ঢোকার মুহুর্তে পুলিশদের ওখানে দাঁড়িয়ে আছি। দাড়ানোর নিয়ম নাই কিন্তু পুলিশরাও কিছু বলছেনা। কর্তব্য পালনের পাশাপাশি বাংলাদেশের জয়/পরাজয় তাদেরকেও প্রভাবিত করে সেটাই স্বাভাবিক। শাফিউলের বলে কেভিন ও ব্রায়ান পুল করল। ওটা কে! দাড়ি আছে মানে শুভ। ভাই ধর ভাই ধর, ইয়েস। স্টেডিয়াম কেঁপে উঠল। কেভিনও ব্রায়ান আউট। এরপর যেই জিনিসটা করা সব থেকে বেশি দরকার সেটা করল শাফিউল। তার বল তো নয় যেন আগুনেরই গোলা রে। সেই আগুনের গোলায় একজন হইল বোল্ড আরেকজন লেগ বিফোর। ৩০ রান লাগে আয়ারল্যান্ডের উইকেট দরকার একটা। সাকিবের একটা ভাল বলই যথেষ্ট। কিন্তু কাল সব আগুনের গোলা গুলা আসছিল শফিউল থেকেই। সেই আগুনের গোলার কয়েকবার পরাস্ত হওয়ার পরে অবশেষে মাহেন্দ্রক্ষন। মডেল জুনায়েদ সিদ্দিকী মডেলিং ভুলে ক্যাচটি ধরে নিল। স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে বাইরে যা দেখলাম অবিশ্বাস্য। আমরা স্টেডিয়াম থেকে বের হচ্ছি কিন্তু হাজারো হাজারো মানুষ উলটা স্টেডিয়ামের দিকে ছুটে যাচ্ছে। খেলা দেখার ইচ্ছা খেলোয়ারদের দেখার ইচ্ছা সবার আছে। কিন্তু টিকেট পাওয়ার ভাগ্য অথবা সামর্থ্য অনেকেরই নেই। কিন্তু আনন্দ যে সবারই সমান। সেই আনন্দে শরীক হতে সবাই স্টেডিয়াম প্রান্তরে ছুটছে। আজ সারারাত ধরে আনন্দ হবে। কারন এটা এমন এক জয় যেটা অর্জন করতে হয়েছে। হোক আয়ারল্যান্ড। হোক মাত্র ২৭ রানের জয়। জয়টা কষ্ট করেই পাওয়া। আর জয় সে ২৭ রানেরই হোক আর ১০০ রানেরই হোক। জয় তো জয়ই।