বাংলাদেশের মাটিতে বিশ্বকাপের খেলা হবে এর থেকে আনন্দের ব্যাপার আর কিই বা আছে। যারা টিকেট কেটে খেলা দেখবেন তাদের আনন্দ তো আরো বহুগুন বেড়ে যাবে। সবার সাথেও আমিও দারুন আনন্দিত। খালি ছোট একটা ঘটনা মনে পড়ে যাওয়ায় আমার সামান্য মন খারাপ। আপনাদেরকে সেটাই বলতে চাই।
কলনীতে বসবাস করলে পাড়ার ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাটা বোঝা যায়। পাড়ায় থাকার কারনে ক্রিকেট খেলা ছোট বেলা থেকেই খুব প্রিয়। আমার জন্ম বেইলী রোড ছয়তালা কলনীর ১৪ নম্বর বিল্ডিং-এর ৫ তালায়। পাড়ায় নানা বয়সের ছেলেমেয়েরা নানা ধরনের খেলা খেলতো। খুব ছোট বেলা থেকেই বড়দের সাথে ক্রিকেট খেলাটাই আমার সব থেকে পছন্দের ছিল। বড়রা অবশ্য আমাকে নিতে চাইতনা। বড়দের ক্রিকেটে ছোটদের নেওয়া ঝামেলা আছে। ফিল্ডিং মিস করবে ব্যাটিং-এও বেশি কিছু আশা করা যায়না। তবে দু’জনের কারনে আমি সুযোগ পেতাম। একজন ছিলেন রাজন ভাই আরেকজন রাজীব ভাই। দেখা যেত সবসময় রাজীব ভাই বিপক্ষ দলে ভাল কাউকে দিয়ে আমাকে তার দলে টেনে নিতেন। হয়ত ক্রিকেটের প্রতি আমার আগ্রহটাই এর প্রধান কারন। রাজীব ভাই নিজেও যে ক্রিকেট খুব পছন্দ করতেন। সব সময় দেখতাম বিশাল বিশাল ছয় মারতেন। একবার কোন কারনে তিনি ফার্স্ট ওভারেই আউট হয়ে গেলেন। ১০ ওভারের খেলায় শুরুতেই তিনি আউট মানে হল খেলায় আমরা হারছি। কারন ১০ ওভারে যেহেতু বাই/ওভার থ্রো খেলা হবেনা তাই ৭০ এর মত রান চাই। সম্ভবত পাড়ার ক্রিকেটে সেটাই আমার প্রথম সফল ভাবে আগমন। আমি কি ভাবে জানি একাই ৩০ এর মত করে ফেললাম পুরা দল করল ৭০ এর বেশি এবং আমরা ১০ কি ১২ রানে জিতলাম। আমার আনন্দ আর ধরেনা। কারন রাজীব ভাই না থাকলে ফার্স্ট ডাউন আর নামা হতনা। অন্য কেউ পাত্তাই দিতনা। আর ততদিনে কাজের ছেলেকে দিয়ে বল করিয়ে করিয়ে যে আমি পেঁকে গিয়েছি এ খবর কেউ জানেনা। রাজীব ভাই খুশিতে আমাকে ইউসুফ কনফেকশনারীত নিয়ে গিয়ে কোক খাওয়ালেন। পাড়ার ক্রিকেটে সেটা আমার প্রথম ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ পুরস্কার হতে পারে। এর আগে ভাইভা সম্পর্কিত ব্যাপারে রাজীব ভাইয়ের উপর কিঞ্চিত ক্ষিপ্ত ছিলাম। ১৯৯১ সালে গভ ল্যাবে রিটেনে টিকার পর রাজীব ভাইকে বলেছিলাম আমার ভেবে (শব্দটা যে ভাইভা সেটা জানতাম না) পরীক্ষা বাকি রাজীব সে কথা পুরা দুনিয়াতে জানিয়ে দিয়েছিলান। যে আমি ভাইভা কে ভেবে মনে করি। রাজীব ভাই ইন্টার পরীক্ষায় ১২ তম স্থান অধিকার করেছিলেন। সবাই বেশ অবাক হয়েছিল এবং আমরা বেশ গর্বিত হয়েছিলাম। ক্রিকেট খেলেও যে ইন্টারে স্ট্যান্ড করা যায় সে উদাহরন আমাদের জন্য দরকার ছিল।
১৯৯৫ সালের জুন মাসে বেইলিরোড কলনী ছেড়ে ইস্কাটন আসলাম। রাজীব ভাই তখন বুয়েটে ইলেক্ট্রিকালে পড়ছেন। তারাও বাসা চেঞ্জ করে কই জানি গেল। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে রাজীব ভাইয়ের সাথে দেখা হল। ১৯৯৪ আইসিসি ট্রফি খেলে বাংলাদেশ ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সুযোগ পেতে পারত অল্পের জন্য সেই সুযোগ হাতছাড়া হওয়াতে আমাদের বেশ মন খারাপ। বিশ্বকাপের খেলা বলা যায়না বাংলাদেশেও হতে পারত তাহলে।
ইস্কাটনেও বড় ভাইদের এবং ক্রিকেট খেলার লোকজন পেয়ে যাওয়ার কারনে বেইলীরোড যাওয়া ধীরে ধীরে কমে গেল। ১৯৯৬ বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরু হল আর আমার মাঝেও আফসোস শুরু হল। ইস, বাংলাদেশে যদি বিশ্বকাপের খেলা হত। ৯ মার্চ ভারত-পাকিস্তান খেলা। ব্যাঙ্গালোরে। তার কয়েকদিন আগে খবর পেলাম রাজীব ভাই আর নেই। তিনি ভারত-পাকিস্তান খেলার টিকিট যোগাড় করেছিলেন। বাসে করে আরেজনকে সাথে নিয়ে ভারত যাওয়ার পথে বেনপোলে ছোট একটা বাস দূর্ঘটনা হয়। পুরা বাসের কারও কিছু হয়নি খালি একটা রড ঢুকে যাওয়াতে রাজীব ভাই ঘটনা স্থানেই মারা যান। ভারত পাকিস্তান খেলার দিন পুরা খেলাটা দেখলাম মন খারাপ করে। ক্রিকেটে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। টেস্ট খেলে বাংলাদেশ। বিশ্বের সব গুলা দেশকে ওয়ানডেতে হারিয়েছে। এখনো আমি মাঝে মাঝে রাজীব ভাইয়ের সাথে ১৯৯৫ তে ফিরে যাই। আহা, যদি বাংলাদেশ কেনিয়ার কাছে না হারতো তাহলে ১৯৯৬ বিশ্বকাপ খেলতে পারতো। বিশ্বকাপের খেলা দেখার জন্য হয়র রাজীব ভাইকে তখন আর ভারত যেতে হতনা এভাবে মারাও যেত না।
রাজীব ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে তার মা নাকি মাটিতেই পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। রাজীব ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার সাহস আর হয়নি। বেইলি রোড কলনীতে তার লাশ এসেছিল। যেই মাঠে বসে তিনি ছক্কা মারতেন সেখানেই মানুষের চোখের পানিতে শেষবারের মত তিনি চলে গেলেন।
মানুষের জীবন কোনকিছুতেই থেমে থাকেননা। এমন না যে তার কথা আমি সব সময় স্মরন করি। কিন্তু দেশের মাটিতে বিশ্বকাপের খেলা যখন দেখতে যাব তাও সেই ফেব্রুয়ারী মাসেই তখন হটাৎ করে তার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বেঁচে থাকলে হয়ত বিশ্বকাপের একটা খেলা তার সাথেও দেখা হয়ে যেত। বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ জিতবে- আমি নিশ্চিত রাজীব ভাই পরকাল থেকেও সেই খেলা দেখবেন আর দারুন খুশি হবেন।