বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পদ্ধতি দুটি। একটি হল জ্ঞান লাভ করার জন্য। যেটা করার জন্য আপনাকে অনেক অনেক বই পড়তে হবে। আরেকটা হল পরীক্ষায় পাশ করা অথবা পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাওয়া। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রচলিত ধারার প্রশ্নপত্রে ভাল নম্বর পাওয়ার জন্য বিষয়-ভিত্তিক জ্ঞান অর্জনের থেকে নোট বা চোথার গুরুত্ব অনেক। চোথা শব্দটা বুয়েটে অধিকতর প্রযোজ্য। সেখানে যেই জিনিসটাকে চোথা বলে ঢাবিতে সেটাকে আমরা নোট জেনে আসছি।
অনেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন ফিজিক্সে পড়ে আমি নোটের কথা বলছি কেন? আসলে ফিজিক্স পড়তে গেলে যত পরিশ্রম করতে হয় তার দশমাংশ করেছি কিনা সন্দেহ। আর আমেরিকান বইগুলার মত করে প্রশ্ন আমাদের আসেনা। আমাদের প্রশ্নগুলা এনসার করার জন্য নোট পাওয়া , সেটা খুব ভাল করে ফটোকপি করা, তারপর সেগুলোকে জায়গামত উদগীরন করে আসাটা খুব জরুরী। আর আমার কাছে মনে হয় ফিজিক্স হচ্ছে মুখস্থ করার জিনিষ , ইতিহাস বোঝার জিনিশ। জ্ঞানের পরিমান অপ্রতুল হলে যা হয় আর কি।
ঢাবি থেকে পাশ করার পর অনেকজনের অনেক কিছু মনে হবে। আমার কাছে মনে হয়েছিল ভর্তির শুরুতেই একটা ফটোকপি মেশিন কেনা উচিত ছিল। একাউন্টিং এ ডেপ্রিশিয়েশন বলে একটা ব্যাপার আছে। সেরকম হিসাব করলে আমি নিশ্চিত ফটোকপি মেশিন থাকাটা লাভজনক কিছুই হত। কত কিসিমের কতরকম নোট যে ফটোকপি করা হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। নোট ফটোকপি করার ব্যাপারে আমাদের ডন ছিল চন্দন। আর জেমস বন্ডের সাথে মিল রেখে সমীরনের নাম হল নোটবন্ড। আজকের এই নোট বিষয়ক লেখা নোটডন আর নোটবন্ডকে নিয়েই।
পদার্থ বিজ্ঞানে ভর্তি হতে এসে শুরুতে আমাদের সবার ধারনা ছিল NASA পর্যন্ত যেতে আমাদের আর খুব বেশি বাকি নেই। আমরা শুরুতেই গিয়ে নীলক্ষেত থেকে আমেরিকান লেখকের বই কিনে আনলাম এবং এ ব্যাপারে আমাদের বিন্দুমাত্র ধারনা ছিলনা যে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে লিখার জন্য নোট অথা চোথা মুখস্থ করে যেতে হবে। কারন আমেরিকার শিক্ষা পদ্ধতি যেরকম প্রশ্ন করে আমাদের ঢাবিতে সেরকম হবেনা। এখানে বিশাল বিশাল ইকুয়েশন যত বেশি প্র্যাক্টিস করা যাবে তত ভাল। বলা বাহুল্য, এই কাজটাতে মেয়েরা বরাবরই এগিয়ে ছিল। তবে নোট সংগ্রহ করা থেকে সেটা যোগানের দায়িত্ব থাকত নোটডন চন্দন আর নোটবন্ড সমীরনের।
নতুন ইয়ারে উঠলেই দেখা যেত চারিদিকে নোট নোট নোট রব। কয়েকটা ভাগে বিভক্ত দল। বড় ভাইয়ের অমুক নোটটা ভাল; তমুক সাবব্জেক্টের কামুকের করা নোটটা ভাল। একেকভাবে একে দল একেক দিক দিয়ে চেস্টা চালাচ্ছে। তবে সবার থেকে বেশি ফোন যাচ্ছে নোটডন চন্দনের কাছে। চন্দন কোন কারনে ভার্সিটি ২ টা বছর একটা গেঞ্জী পড়েই কাটিয়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা এমন না যে কারনটা অর্থনৈতিক। যে নীলখেতে নোট ফটোকপি করার জন্য আলাদা ড্রাইভার সহ এসিওয়ালা মাইক্রোবাস সাথে রাখে সে ২ বছর ধরে একই গেঞ্জী পড়ে ভার্সিটি আসছে তার কারন অনুসন্ধানে আমরা চেস্টার কোন ত্রুটি রাখিনি। ভাল রেজাল্ট করার জন্য মানুষ হুজুরের পানি পড়া খায়- বাটি চালান, চাল পড়া এইসব দেয় আমাদের ধারনা কোন হুজুড় পীর দরবেশ মনে হয় তার গেঞ্জীতে ফু দিয়ে গেঞ্জীপরা দিয়ে দিয়েছে। গ্র্যাজুয়েশনের আগপর্যন্ত এই গেঞ্জী পরলে হয়ত কাঙ্খিত রেজাল্ট পাওয়া সম্ভব। চন্দন হল সেই পাব্লিক যে নিজের নোট ভুল করে ২ বার ফটোকপি করে ফেলে। ব্যাপারটা কিরকম? কোন বড় ভাইয়ের নোট পাওয়া গেছে নোটটা হয়ত সুবিধার নয়। সে সেটাকে হয়ত কলম দিয়ে লিখবে। তারপর কোন এক বিচিত্র কারনে তার নিজের অরিজিনাল লেখাটা না পড়ে সে সেটার ফটোকপি করতে তার মাইক্রোবাস হাকিয়ে নীলখেত যাবে। হয়ত ফটোকপি করে বাসায় এসে দেখবে সে আগেই কোন এক সময় তার নিজের লেখা ফটোকপি করে রেখেছে যা তার মনে নেই। এই ব্যপারটা তার ক্ষেত্রে ঘটেছে।
নোটবন্ড সমীরনের কাজ ছিল নিজের নোট করা। অসম্ভব পরিশ্রমী একজন ছেলে। মা বাবা আদর্শ ছেলে বলতে যা বুঝায় তাই। কোন আলগা শখ পূরনের তাগিদ নাই, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে- আমাদের বিশ্বাস সে এই মর্মে বিশ্বাসী। তার দোষ বলতে একটাই তার হাতের লেখাটা খুবই খারাপ। যেহেতু সে আমাদের উপকার করবে তাকে গালি দেওয়াটাই বর্তমান জগতের নিয়ম তাই আমরা সবাই মিলে তাকে গালি দিতাম। সে নোট করছে কিন্তু সেটা আমাদের জন্য খুবই দূর্বোধ্য। হয়ত একই পাতায় যেখানে ১৭ লাইন থাকলে নোটটা সুন্দর হত সে ২৫-৩০ লাইন লিখে ফেলছে। আর তার হাতের লেখার কারনে সেটা অনেকটা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের মত দূর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে। নোটবন্ড সমীরনের নোটের সব থেকে বড় সমস্যা ছিল সে প্রতিটা লাইনের শেষ শব্দটি ভেঙ্গে ফেলত। যেমন- Electromagnetic radiation (often abbreviated E-M radiation or EMR) is a form of en-
ergy exhibiting. কোন কারনে energy শব্দটির স্থান লাইনের শেষ প্রান্তে সঙ্কুলান হচ্ছেনা তাই সে এটাকে ভেঙ্গে দিত। এই কাজটা একবার করলে হয়- তা না সে প্রতিটা লাইনে লাইনে এই কাজ করত এবং সব গুলা শব্দ ভাঙ্গত। সেটা ১০ অক্ষরের শব্দই হোক বা দু’অক্ষরের শব্দই হোক। আরে বাবা শব্দটা পরের লাইনেই লেখা যায়। হাতের লেখা তো আর মাক্রোসফট ওয়ার্ড না যে এটাকে জাস্টিফাই করা যাবে।
সবুজ ভাইয়ের নোট আমাদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তার সৃষ্টি করেছিল। নতুন বছর হলেই সবুজ ভাইয়ের নোট, সবুজ ভাইয়ের নোট। এর বাইরে ছিল গোপালদা, বিলাসদা এনাদের নোট। তবে আমরা ছিলাম পরিবর্তিত সিলেবাসের নতুন ব্যাচ। তাই আমাদের বেশ কষ্ট পোহাতে হত। কারন পুরানো সব নোট দিয়ে আমাদের কভার হতনা। তখন আমাদের ব্যাচের লোকজন কি নোট করত তার প্রতিযোগিতা চলত। ভার্সিটির একটা অলিখিত নিয়ম হল নিজের গাটের লেখা নোট নিজ ইয়ারে কাউকে দিতে হয়না। ক্রিকেট খেলায় পাওয়ার প্লে এর সুবিধা নেওয়ার মত এটাও একটা গেম প্ল্যান। তবে আমার কাছে এটাকে যথেষ্ট ফেয়ার মনে হত। কারন ভাল রেজাল্ট করার ইচ্ছা যাদের তাদের সব কিছুতে সিরিয়াস থাকা লাগে। আর শেষ অবধি এইসব ছোট খাট ব্যাপার অনেক কিছুর ব্যবধান গড়ে দিত। স্পোর্টিং মেন্টালিটির কথা চিন্তা করতে ব্যাপারটা ঠিক আছে।
নতুন বছরের শুরুতেই নোটডন চন্দনের ফোন অবধারিত। সাথে লোভনীয় প্রস্তাব। অমুকের নোট তাকে যোগাড় করে দিতে পারলে তার কাছ থেকে কি খাসা স্পেশাল নোট পাওয়া যাবে। নোটডন সমীরনেরও তখন নোটের সন্ধান শুরু। এক পাতা নোটের জন্য কেউ জীবন দিতে প্রস্তুত কেউ জীবন নিতে। কোনকারনে যদি সমীরনের বিয়ে ঠিক হয় যাত্রাবাড়ী। বর হয়ে যাওয়ার পথে যদি তাকে বলা হয় এক পাতা নোট এখন গাবতলীতে আছে। আমি নিশ্চিত সে তার বিয়ে ছেড়ে তখনই গাবতলীর পথে রওনা হয়ে যাবে। আর সেই খবর নোটডন চন্দনের কানে চলে গেলে সে তার মাইক্রোবাস হাঁকিয়ে সেটা লুট করতে চলে আসবে। চন্দন ফোন করে আমাকে বলত সমীরনের কাছে কি কি নোট আছে সেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তার কাছে পাচার করতে। আর সমীরনের কথা হল আমাকে কোন নোট দেওয়ার পর তথ্য গোপন রাখতে। একটা মজার ব্যাপার, নোট আর তথ্য এই দুই জিনিশ কখনই গোপন থাকার জিনিশ না। যার যার পাওয়ার সে সে পেয়ে যেত। নোট ফটোকপি করার পর ফটোকপি বাজে আসার কারনে সেটার উপর আবার ঘষামাজা চলত। নোট সম্পর্কিত তথ্য বিভ্রাটের কারনে ভার্সিটি জীবনে বহু সম্পর্ক নষ্ট হতে দেখলাম। কি কারন? এক মেয়ে নোট পেয়েছে কিন্তু হয়ত তার প্রিয় বান্ধবীর কাছে গোপন রেখেছে। প্রিয় বান্ধবী কোনভাবে ব্যাপারটা জেনে গিয়েছে। সম্পর্ক শেষ। ভাল কথা আমার কাছে সব সময় সব নোট থাকত কিন্তু পড়ালেখার প্রতি অনীহার পরিমান বেশি তাই খুব কম পড়ে দেখতাম। তবে আমার একটা বৈশিষ্ট্য হল “না” বলতে না পারা। তাই যখন যে যেটা চাইত দিয়ে দিতাম। ব্যাপারটা যে খুব প্রশংসনীয় কাজ হত তা না। বেশির ভাগ মানুষই এ জন্য আমাকে গালি দিত। শুধু মাত্র গাধারাই এ হীন কাজ করে- এরকম কথাও শুনেছি। মানুষের উপকার করলে গাধা ডাক শোনা যেতে পারে, কিন্তু তাতে কারো কোনো ক্ষতি হয়না- আমি এ মর্মে বিশ্বাসী। আর পৃথিবী এভাবেই ব্যালেন্স হয়। বুদ্ধিমানদের পাশাপাশি আমার মত দু’চারটা গাধা থাকবেই।
তবে এই নোট কালচার কিন্তু খুব ভাল জিনিশ না। যদি কেউ হায়ার স্ট্যাডিজ করতে চায় তার জন্য বই পড়ার অভ্যাসের বিকল্প কিছু নেই। হায়ার স্ট্যাডিজ করতে বাইরে যাওয়ার জন্য জিআরই টোফেল এর পাশাপাশি আমাদের জন্য ফিজিক্স জিআরই দেওয়া লাগে। বলা মাতুল্য, এগুলার জন্য কোন বড় ভাইয়ের নোট নেই। আর বিদেশ গেলেই তো হবেনা। পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ না থেকে খালি নম্বর পাওয়ার জন্য পড়ে বিদেশ গেলে তারজন্য সেই জায়গাটা খুব সুখকর হওয়ার কথা না।
লেখাটা জানি কেমন হয়ে গেল। খুব মজার কিছু লিখতে চেয়েছিলাম কেমন ঝিম মেরে গেল। আজ উঠি। নোটডন চন্দনের ভাইয়ের বিয়ে খেতে যাব। শেভ করতে যাই।