চলতে চলতে হাইজ্যাকারের কবলে পড়লাম। একজন আমাকে এসে বলল,
- আপনাকে বড় ভাই ডাকে।
- কে বড় ভাই? কার বড় ভাই?
পাশেই রিকশা দাড় করানো। সেখানে একজন বসা।সেই একজন বলল,
- গত বুধবার আমাদের এলাকায় কয়েকটা পোলাপাইন পিটাইয়া গেছিল তুই কি সেই দলে ছিলি?
- আমি পোলাপাইন পিটানো দলে থাকব কেন? আমি মশা-মাছিও খুব বিরক্ত না করলে মারিনা। পোলাপাইন পিটানো অনেক পরের ব্যাপার।
-হারামজাদা ফাইজলামী করস।
এতটুকু বলার পর হাইজ্যাকার ঘড়ি মোবাইল নিয়ে গেল। পকেটে ৮১০ টাকা ছিল। ১০ টাকা কি মনে করে যেন নেয়নি। ব্যাপারটা হাস্যকর। আমার দুলাভাই যে পুলিশ ব্যাপারটা হাইজ্যাকারকে বলা ঠিক হবে কিনা তখন বুঝতে পারিনাই। এখন আবার দুলাভাইকেও হাইজ্যাকারের কথা বলতে পারছিনা। দুলাভাই ব্যস্ত আছেন। শাফায়াত নামের একজন ছেলে নিখোঁজ হয়েছে। তাকে পাওয়া যাচ্ছেনা। আগ বাড়িয়ে দুলাভাইকে সাহায্য করতে গেলেই মোবাইল আর ঘড়ি ছিনতাইয়ের কথাটা বলতে হবে। তাই চুপ আছি।
বেকারদের বেকার সময় থাকেনা। আমি বেকার। থাকি বোনের সংসারে। এই অবস্থায় খোঁটা খাওয়া উচিত কিন্তু আমার দুলাভাই এতই ভাল মানুষ যে খোঁটা খাওয়া দূরের ব্যাপার, পারলে তিনি এমন ব্যবস্থা করে দেন যে সারা জীবন আমি তার বাসাতেই থাকি। ভাগ্নেদের অঙ্ক করিয়ে দেই। বোনের সংসারে বাজার করে দেই। আর হা মাঝে মাঝে দুলাভাইকে সাহায্য করি। কিরকম সাহায্য? শুনলে হাসি পাবে। কেস সল্ভ করে দেই। ব্যাপারটা কিভাবে হয় আমি জানিনা। আমি পুলিশ নই বা ডিটেক্টিভ নই। টেকনিকাল জ্ঞ্যান কম। কখনো ফেলুদা শার্লক হোমস কিছুই পড়িনি। তারপরেও কিছু একটা বলে ফেলি লেগে যায়।
মোবাইল যে ছিনতাইকারী নিয়ে গেছে এ ব্যাপারে চুপ থাকা গেলনা দুলাভাই জেনে গেলেন। কারন যে আমাকে হাইজ্যাক করেছে সে নতুন কেউ। পুরানরা কখন কোথায় হাইজ্যাক করে সেটা নাকি তাদের সাথে সাথে পুলিশও জানে। কাজেই এ নতুন কেউ। মোবাইল বিহীন জীবন কাটাচ্ছি। ঘড়ি বিহীন হাত নিয়ে ঘুড়ছি। ঠিক এমন সময় সকালে ঘুম থেকে উঠার পর দুলাভাই আমাকে তার পুরান মোবাইল উপহার দিলেন। তিনি নতুন সেট নেওয়াতে পুরানটা আমাকে দিয়ে দিলেন। তার কল লিস্টে সব মন্ত্রী মিনিস্টার থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্ব্পূর্ন নম্বর থাকায় সব আমাকে ডিলিট করতে হল। দুলাভাই গুরিতেপূর্ন কেউ হতে পারে আমি নই। দুলাভাই আমাকে শাফায়তের বাসায় নিয়ে গেলেন। শাফায়াত, স্কুল থেকে ফেরার পর যাকে আর পাওয়া যায়নি। যেতে যেতে কথা হলো। কথা শুরু করলেন দুলাভাই,
- তোমার হারানো মোবাইল মনে হয় ফিরে পাওয়া যাবেনা। তোমাকে বললাম আই-এম-ই নম্বরটা রাখতে তাতো করোনি।
- যা গেছে গেছে। আচ্ছা শাফায়াত সম্পর্কে বলুন।
- বাচ্চা ছেলে। ৭-৮ বছর বয়স। কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ।
পুলিশ অনেক কিছুই গুছিয়ে রেখেছে তারপরেও জানা যাচ্ছেনা শাফায়াত কোথায়। সিকিউরিটি গার্ডকে ধরা হয়েছে। শাফায়াতদের ড্রাইভারকে খালি ধরা হয়নায়, মারধোর করা হয়েছে। দুলাভাইয়ের ধারনা সেই হল ক্লু। শাফায়াতকে কিডনাপ করা হয়েছে সেটাতে ড্রাইভারের হাত ছিল। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম কোন Ransom মানে মুক্তিপন কেউ চায়নি। ব্যাপারটা তাহলে এখনো আমার মাথাতে খেললনা। মুক্তিপন না চাইলে শাফায়াতকে কিডন্যাপ কেউ করবে কেন!! শাফায়াতদের বাসা দেখলাম। শাফায়াতের মা হাসপাতালে। বার বার অজ্ঞান হচ্ছেন দেখে সেখানেই তাকে রাখা হচ্ছে। শাফায়াতের একজন ছোট ভাই আছে সে কই জানিনা। শাফায়াতের বাবাও আপাতত নেই তাই বলতে হল আমার সুবিধাই হল। ওনাদের দুঃখ সহ্য করতে পারতাম না। শাফায়াতদের বাসায় গেলাম। শাফায়াতের রুমে ঢুকলাম। ৮ বছরের বাচ্চা। ক্লাস টুতে পরে। সুন্দর সুন্দর সব পেন্সিল, রাবার শাফায়াতের টেবিলের ড্রয়ারে। বাসায় অন্যান্য আত্তীয় স্বজন আছে। দু একজনের সাথে কথা বললাম। বুঝলাম কাজের কোন কথাই বের হবেনা। বাসা থেকে বের হলাম। অ্যাপার্টমেন্টে ৪ টা করে ইউনিট। এ, বি, সি, ডি চারটা ভাগে ভাগ করা। শাফায়াতরা থাকে সাত তলায়। অন্যান্যদের সাথে কথা বলা দরকার মনে হয়। তারা শেষ কখন শাফায়াতকে দেখেছে জানা দরকার। একটা ফ্লাটে দরজাই খুললনা। একটা ফ্লাটে বেশ অপমান করল। আরেকটা ফ্লাটে একজনকে পাওয়া গেল যে শাফায়াত হারিয়ে যাওয়াতে বেশ দুঃখী এবং তার ধারনা ছেলে ধরার কাজ।
অ্যাপার্টমেন্টে সিকিউরিটি গার্ড যে দায়িত্বে ছিলেন তার সাথে কথা বললাম। পুলিশের থাপ্পর তার কপালেও জুটেছে মনে হয়। আমাকেও পুলিশ মনে করছে। বলে স্যার আমি কিছু জানিনা, আমি জানিনা। আমি তাকে শান্ত করালাম। এই লোক কিডন্যাপারদের সাথে থাকবে বলে আমার মনে হয়না। বোকা মানুষ কখনো কিডন্যাপ টাইপ কিছুতে থাকবেনা। একে দেখেই বোঝা যায় এ একটা বোকা। অবশ্য চালাক কিংবা বোকা চট করে চিনা কঠিন। আমি সিকিউরিটি গার্ডটাকে নিয়ে বাইরে এলাম। সে আর চাকরী করবেনা এই ধরনের অপ্রয়োজনীয় কথা বলেই যাচ্ছে। তার কাছ থেকে কথা বের করতে সমস্যা হল। তবে জানলাম। যা যা জানার জানলাম। শাফায়াত স্কুল থেকে ফিরেছে গাড়িতে করে এমনটাই সে বলল। শাফায়াত লিফট ধরে উঠেছে। এরপর সে জানেনা। শাফায়াত লিফট ধরে উঠেছে কিন্তু বাসায় যায়নি এমন হওয়ার কথা না। কিডন্যাপ তাকে কেউ করতে গেলে সে চিল্লাবে। চারটা ইউনিটের কেউ নাকি কোনো আওয়াজ শুনেনি। যদি শাফায়াত কিডন্যাপ হয়ে থাকে তার মানে ওই সময় হয়েছে।
দুলাভাইয়ের বাসায় ভাগ্নেকে অঙ্ক করাচ্ছি আর একটা লিস্ট দেখছি। ঐদিন কে কে ঐ এপার্টমেন্টে এসেছিল সেটা ফটোকপি করে আনা। বিরক্তকর কাজ নিঃসন্দেহে। শাফায়াতের স্কুল ছুটি হয় ১০ টায়। ধরলাম ১১ টার দিকে শাফায়াত বাসায় পৌছাল। ড্রাইভার হারুন তাকে নামিয়ে দিয়েই শাফায়াতের আব্বার অফিসে গেল। ১০ টা থেকে ১২ টার সময় বাসায় আসা সবার লিস্ট দেখলাম। কাজের বুয়া আসছে দেখলাম ১২ টার পরে। ছুটা বুয়া। ঠিক করেই রেখেছি কালকে এর বাসায় যাব। শাফায়াতদের ফ্লাট নম্বর সি। ঐ বাসায় আর কেউ আসেনি। আশেপাশের গুলাতেও আসেনি। অন্যান্য ফ্লাট গুলা লিস্টে দেখার চেস্টা করলাম। কিডন্যাপাররা নিশ্চিয়ই অনেক বুঝে শুনেই প্ল্যান বানিয়েছিল। কিন্তু ঠিক কিছুই আমি বুঝতে পারলাম না। কারন সন্দেহ করার মত তো অনেক আছে দেখছি। সব ফ্লাটেই কেউ না কেউ যায়। আমার মনে হল কাজের বুয়াটাকে ধরা দরকার। এর থেকে কিছু বের হলেও হতে পারে।
খুব হাস্যকর একটা ব্যাপার হল। কাজের বুয়ার কাছে আমার পুরান মোবাইলটা পেলাম। বুয়া নাকি এট হাইজ্যাকারের কাছ থেকে কিনেছে। যাই হোক বুয়ার কাছে এটা চাওয়াটা আর সাজে না। বুয়ার সাথে কথা বললাম। এই বুয়া ছোটখাট চুরি করবে এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই, সে কিডন্যাপ জাতীয় কোন কিছুতে থাকবে না এই ব্যাপারেও সন্দেহ নাই। ভীতুটাইপ একজন। বুয়া ঐ ফ্লোরে দুই বাসায় ঘর ঝাড়ু দেয় আর ঘর মুছে। শাফায়াতদের বাসায় আবার পাশের বাসায়। বুয়া যেই বস্তিতে থাকে সেই বস্তিতে খুঁজে খুঁজে তার বাসায় এসেছি। বুয়া কেন বাসায় আনতে চাচ্ছিল না বুঝলাম। তার হাতটান স্বভাব আছে। খুঁচরা খাচরা জিনিস চুরির উপর থাকে। শোপিস জাতীয় জিনিস দেখলাম। খুব বেশি সুবিধা হলনা আসলে। বুয়া আরেক যে বাসায় কাজ করে সেই বাসার সাহেব মাঝে মাঝেই বিদেশে যান। সেই বাসার অনেক জিনিসপত্র বুয়া চুরি করে আনে এমনটাই মনে হল। একটা জিনিস বেশ ভাল লাগল। বুয়ার একটা শাফায়াতের বয়সী ছেলে আছে মনে হয়। সে লেখাপড়া করছিল। বস্তির একটা ছেলে ঘরে বসে লেখাপড়া করছে দেখে অবাক হলাম।
পুলিশের সন্দেহের তালিকায় সবাই আছে আর আমার সন্দেহের তালিকায় কেউ নেই। পুলিশ দেখে অপরাধী চিনতে পারে আমি না। পুলিশের ডিউটি তদন্ত করা আমার না। আমি শখের বসে করি। কারো জবাবদিহীতা লাগেনা। দুলাভাই দেখি শাফায়াতের বাবাকেও সন্দেহ করা শুরু করেছে আমি জানি এরকম ব্যাপার হবেনা। গল্প সিনেমার নাটকীয়তা আর বাস্তবের নাটকীয়তার পার্থক্য আছে। ম্যান অন ফায়ার বা মাসুদ রানার অগ্নি পুরুষ টাইপ কিছু চিন্তা করতে ভাল লাগছেনা। আচ্ছা এমন তো হতে পারে শাফায়াত কিডন্যাপ হয়নি। সে খুন হয়েছে। কেউ তাকে খুন করে লাশ কোনভাবে বের করে নিয়ে গিয়েছে।এখন পররয্ন্ত মুক্তিপন যেহেতু চায়নি। কেউ যদি খুন করে কেন করবে? আমি গেস্টের লিস্টটার দিকে তাকালাম। কয়েকটা নামে লাল কালির দাগ দিলাম।
শাফায়াতের বাবার সাথে দেখা করলাম তাদের বাসায়। তিনি আমাকে পাত্তা দিতে চাইলেন না। জানলাম সকালে শাফায়াতকে ব্যাগ গুছিয়ে দেন তিনি। আরও অনেক কিছু জানলাম কিন্তু এই ইনফরমেশন কাজে দিল। কিভাবে? শাফায়াতের প্রিয় একটা পেন্সিল বক্স আছে। তার মামা বিদেশ থেকে পাঠিয়েছিল। শাফায়াত সেটা সব সময় সাথে রাখে। সেটা না নিয়ে স্কুলে যায় না। শাফায়াতের বাবা সেটা গুছিয়ে দেন। ঐদিনও দিয়েছিলান। তাহলে ওই জিনিষ বুয়ার ছেলের কাছে আমি দেখলাম, তার কাছে গেল কিভাবে!! বুয়া এটা আগে চুরি করেনি। তাহলে বুয়ার কোন ব্যাপার আছে। দুলাভাইকে ঘটনা বললাম না। পুলিশ দিয়ে বুয়াকে ধরার সময় এখনো আসেনি। পুলিশরা শুরুতেই মার দেওয়া শুরু করবে। আমি বুয়ার বাসায় গেলাম। বুয়াকে ধরলাম। বুয়া টাকা জিনিসটা ভালই পছন্দ করে। ১০০ টাকা দিয়ে যা জানলাম তাতেই বুঝে গেলাম পুরা ঘটনা কি। আমার আর কিছু করার নেই। এখন যা করার পুলিশ। আমি দুলাভাইকে সব বললাম। কাজ হল। আসল খুনি পাওয়া গেল।
পরেরদিন যখন ঘুমাচ্ছি আমার বোন এসে জোর করে পেপারের খবরটা পড়াল। শাফায়াতের খুনের খবর। পত্রিকা ওয়ালারা লিখতেও পারে রে ভাই। আমিও এত ভাল করে বলতে পারতাম না।
ফ্লাট ডি তে যেই দম্পতি থাকতেন তাদের মধ্যে পুরুষ যিনি তিনি মাঝে মাঝেই দেশের বাইরে যান। মহিলার পরকীয়া ছিল আরেকজনের সাথে। আমি লাল কালি দিয়ে যে ৩-৪ টা নাম দাগিয়েছিলাম তাদের মধ্যেই একজন। সে মাঝে মাঝেই আসত। লীলাখেলা চালানোর জন্য সুবিধামত সময়তেই আসত। শাফায়াত স্কুল থেকে ফিরে তার ফ্লোরে লিফট দিয়ে বের হওয়ার সময় কোন কারনে ফ্লাট ডি তে ঢুকে পড়ে। আমার যতদূর ধারনা দরজা খোলা ছিল আর তার বলটা সেখান চলে যায়। সে ঢোকার পর পরকীয়ার লোক চলে আসে আর শাফায়াত তাদের আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে। মহিলাকে জেরা করা হয়েছে জানা যায় শাফায়াত এটা বলে দেয় আঙ্কেল আসলে বলে দিবে। এইটুকু বাচ্চা কেন একথা বলল কে জানে!! এরপর ওই লোক শাফায়াতকে গলাটিপে মেরে ফেলে। মুখ চেপে ধরায় শাফায়াত শব্দ করার তেমন সুযোগ পায়নি। লাশ কম্পিউটারের মনিটরের বাক্সে কোন ভাবে ঢুকায় নিয়ে যায়। সিকিউরিটি গার্ড কোনো ভাবে ঐদিনকার ঐ লোকের এন্ট্রি রেকর্ড করেনি আমার মনে হয়না সেটা ইচ্ছাকৃত। লোকটা গাধা টাইপ, মিস করে গেছে। শাফায়াতের কাছে স্কুল ব্যাগ ছিল। ধস্তাধস্তির সময় স্কুল ব্যাগের চেইন থেকে পেন্সিল-বক্সটা পরে যায়। বুয়া সেটা ফ্লাট ডি তে পায় দুপুরের পর যখন ঘর ঝাড়ু দিতে যায় আর চুপচাপ নিজের ছেলের জন্য নিয়ে আসে আর আমি সেটা বুয়ার বাসায় গিয়ে পাই।
শাফায়াতের লাশের সাথে স্কুল ব্যাগটাও পাওয়া যায়। পরকীয়ার বলি হতে হল এতটুকু একটা বাচ্চার।
ঘটনাটা পড়ে সবাই বেশ মন খারাপ করল। আমার বাবা এসে দুলাভাইয়ের খুব প্রশংসা করলেন। কত বুদ্ধি করেই না তিনি কেসটা সল্ভ করলেন। শুনেও না শোনার ভাণ করলাম। এর মধ্যে বাবা আমাকে গাধা বলে বকা দিতে লাগলেন। কেন আমি বোনের বাড়ি পরে থাকি।
পরেরদিন দুলাভাই থানায় ডাক দিলেন। গেলাম। মনে হয় নতুন কেস। কিসের কি!! দুলাভাই ওই বুয়ার মাধ্যমে ছিনতাইকারীকে ধরেছেন। আমার সামনেই চর থাপ্পর লাগালেন। ছিনতাইকারী বলতে লাগল, স্যার আপনার শালা জানলে কি আর ঘড়ি মোবাইল নেই নাকি।
অবশেষে আমি আমার ঘড়িটা পেলাম। তবে মোবাইলটা ঐ বুয়ার কাছেই।