২০০৬ সালের কথা। আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। ঢাবি পদার্থবিজ্ঞান সেকেন্ড ইয়ার ল্যাব। অসিলোস্কোপে কি জানি মান নেওয়ার চেস্টা করছি। এইরকম সুন্দর টিভির মত যন্ত্রে এত বাজে কাজ কেন করছি সেটাও একটা কথা। যদি সম্ভব হত ডিশ লাইন দিয়ে দিতাম। সেটা সম্ভব না। ল্যাব টিচার কামরুল স্যার আর কবীর স্যার। পদার্থবিজ্ঞান ঢাবির দুই বাঘা বাঘা টিচার। তবে কবীর স্যার তখনও এসে পৌছাননি। কোন কারনে কামরুল স্যার এর মন মেজাজ আজ ভাল না। সেটা হতে পারেই। মানুষের মন মেজাজ একেক সময় একেক রকম থাকে। পদার্থবিজ্ঞানীদের মন মেজাজও সাধারন মানুষদের মতই। কামরুল স্যারের কাছে যারাই খাতা সিগনেচার করতে যাচ্ছে স্যার আজ একটু বেশিই বকে দিচ্ছেন। একটা গ্রুপে দুইটা মেয়ে একটা ছেলে (তিনজনের গ্রুপ হয়)। সেই গ্রুপ এর মেয়েটা স্যারকে মনে হয় খুশি করতে চাইল। স্যার দেখেন আমার এরর ক্যালকুলেশন অনেক কম আসছে। ১০% এরও কম। কামরুল স্যার একনজর তার খাতা দেখলেন। প্রতিটা মান এর উপর ফ্লুইড দেওয়া। স্যার বললেন, "যেভাবে ফ্লুইড মারস তাতে তো কোন এরর (ভুল) থাকারই কথানা"। খুব খাঁটি কথা। অতি চালাকের গলায় দড়ি টাইপ অবস্থা। এই দিকে আমি কি চালাকি করব বুঝে উঠতে পারলাম না। আমার দুই পার্টনার রাজু আর শাহেদ তখন থেকে অসিলোস্কোপটাকে টিউন করেই যাচ্ছে। পারলে ঐখানে এখন ইএসপিএন চলে আসে কিন্তু আমাদের মান আর কিছু আসেনা। বহুত যন্ত্রনা। আউটপুট কে ইনপুট দিয়ে ভাগ করে তাকে ১০০ দিয়ে গুন করলে ৯৬-৯৮ এর মত আসবে। আমারা চুরি চামারি করেও ৮০ এর বেশি আনতে পারছিনা। কামরুল স্যারকে গিয়ে যে বলব সেই সাহস কুলাচ্ছেনা। এমনিতে কামরুল স্যার বেশ ভাল মানুষ। কিন্তু ঐযে মন মেজাজ যে মনে হচ্ছে আজ তার ভাল নেই।
সিগারেট হাতে নিয়ে কবীর স্যার ঢুকলেন। সিগারেট ছাড়া কবীর স্যারকে চিন্তা করা যায় না। তিন ঘন্টার ল্যাবে মোটামুটি এক প্যাকেট শেষ হয়ে যাবে। তার পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞ্যানের সাথে সিগারেট এর কোন যোগসাদৃশ থাকাটা বিচিত্র না। যে কোন শিশুকেও কবীর স্যার পদার্থবিজ্ঞান বোঝাতে পারবেন। তার ক্লাসে ছাত্রের উপস্থিতির জন্য আলাদা ভাবে নাম ডাকতে হয়না। সবাই আগ্রহ নিয়েই যায়। রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তির কিছুই তার নেই। তার অন্তঃজ্ঞান একটাই, ফিজিক্স। কবীর স্যার সিগারেটটা শেষ করেই কি মনে করে জানি আমাদের দিকে আসলেন। "কি ব্যাপার কি করছ তোমরা?" স্যারের কথায় বুকে বল ফিরে এল। স্যারকে অসুবিধার কথা বললাম। স্যার বুঝানো শুরু করল কিভাবে কি এম্পলিফাইড হয়ে কোন দিক দিয়ে কি আসছে। হা করে আমরা সবাই শুনলাম। বিপত্তি ঘটল এরপর। স্যার নিজে যখন করলেন তখন যা হল সেটা পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে কখনই সম্ভব না। আমাদের মান ৮০% আসে। স্যারেরটা হিসাব করে দেখা গেল ১৩০%। স্যার নিজেও মজা পেলেন। "What is happening here? Output is greater than input? Efficiency is more than 100%! How can this be possible?" স্যার এর মজা পাওয়ার ভঙ্গিটা দেখে আমরাও আনন্দিত হলাম। স্যারের কাছে জানতে চাইলাম এমন হল ক্যান? স্যার বললেন যন্ত্র সবসময় ঠিক মান নাও দিতে পারে। যদি যন্ত্রটাতে কোন ত্রুটি থাকে। এক কাজ কর। কিছুক্ষন অফ করে রেখে আবার কর।
(ঐ ইভেন্টে মনোয়ার স্যার আর ইউসুফ হায়দার স্যার এর সাথে আমরা ভলান্টিয়াররা)
পদার্থবিজ্ঞান এর প্র্যাকটিকালে ব্যাক ক্যালকুলেশন এর গুরুত্ব অপরিসীম। কারন আমাদের বেশিরভাল ইকুইপমেন্ট অনেক পুরাতন। সেগুলাতে সঠিক মান আনা বেশ কঠিন। বিদেশে যারা ফিজিক্স পরতে যায় তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আকাশ-পাতাল পার্থক্য। লেজার ফিজিক্স এর টিচার মনোয়ার স্যার একবার বলেছিলেন আমাদের নাকি দেড় কোটি টাকা দামের লেজার আছে। আমাদের ল্যাবরেটরিতে। শুনে বেশ আহ্লাদিত হলাম। স্যার নিজেই পরে ভুল ভাঙ্গালেন। কারন ঐটা আসলে খয়রাতি লেজার। স্যার বিদেশে গিয়ে যেসব লেজারে কাজ করেছেন সেগুলার দাম বাংলাদেশি টাকায় ২০০ কোটি টাকার বেশি। পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি প্যাশন যাদের আছে কেনই বা তারা বাইরে যাবেনা।
প্র্যাক্টিকালে অবশ্য আমি খুব ভাল নই। যন্ত্রপাতির সাথে আমার বেশ বৈরাগী সম্পর্ক বেশ আদিকাল থেকে। এটার একটা বেশ সাইকোলোজিকাল কারন খুজে বের করলাম। টেকনোলজির আবির্ভাব আগে ছিলনা। ১৯৮৫-৯০ সালের দিকে মধ্যবিত্তদের বাসায় কালার টেলিভিশন থাকা মানেই অনেক কিছু। তখন টিভির দাম ও ছিল অনেক। ৩০,০০০ টাকা তাও আবার সেই আমলে। ছোট বেলা থেকেই আমাকে ভয় দেখানো হত টিভিটা ধরলেই টিভি নষ্ট হয়ে যাবে। সেটার সাউন্ড বাড়ালেও নষ্ট হবে। সাউন্ড কমালেও নষ্ট হবে। সেই ভীতি থেকে সম্ভবত আমি বের হতে পারিনি। ছোটবেলায় থেকেই সেটা মনে গভীর ছাপ ফেলে আসছে। তার এর কানেকশন দিতে গেলে আমার হাত কাপে। সবাই যেই সুইচ টিপ দিলে লাল বাতি জ্বলবে সেটা আমি টিপলে জীবনেও জ্বলবেনা। ফার্স্ট ইয়ার এর ল্যাব এ স্প্রিং কন্সট্যান্ট এর এক্সপেরিমেন্টটা মিলল। এরপর কি জানি একটা করতে গেলাম। তার যে কোনটা কোন মাথায় দিলাম কে জানে। শান্ট রেসিস্ট্যান্স দেখায় ২০০০। এই জিনিস কখনো ২০০০ হওয়ার কথা না।
এই বছর মার্চ মাসের দিকে ঢাবি পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ International Conference on Recent Advances in Physics আয়োজন করেছিল। ১৩ জন পদার্থবিদ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছিলেন। তিনদিন ব্যাপী চলা এই বিশাল আয়োজনের জন্য ভলান্টিয়ার ছিল ১৬ জন যাদের মধ্যে আমি একজন এবং আমাকে বিশেষ মাতব্বরির অধিকারও দেওয়া হয়েছিল।। ইভেন্ট চলাকালীন সময় অনেক গুরুত্বপূর্ন সিধান্ত নিতে হয়েছে এই টাইপ। ইভেন্ট শেষ হওয়ার পর ডেইলি স্টার ক্যাম্পাস এর জন্য লেখা লিখতে হবে। তিনদিন খাটুনির পর টাইম নাই। শার্টের টাই না খুলেই লিখলাম। লিখে চেয়ারম্যান ম্যাডাম এর কাছে নিয়ে গেলাম। উনি বলেছেন ওনাকে না দেখিয়ে জানি লেখা না দেই। উনি পড়লেন। অনেকেই সুলতানা শফী ম্যাডামকে আয়রন লেডি বলে। আয়রন লেডি আমার লেখা পড়ে শান্ত গলায় বললেন, "খালি তো দেখি খাওয়ার কথাই লিখে নিয়ে আসছ!! ফিজিক্স কই?" চুপ থাকলাম। পুরা ইভেন্ট এর অনেক হাবি জাবি জিনিস সামলানোর ফিরিস্তি ম্যাডামকে নাই বললাম। বিদেশীদের জন্য গিফট আরং থেকে নৌকা কিনে আনসিলাম দেখে অনেকে আবার ইঙ্গিত ও ছিল। "করস টা কি? টেকনিকাল সমস্যা কইরা ফালাইসো।" যাই হোক লেখায় ফিজিক্স ঢুকাতে হবে। ডাকলাম অন্যদের যারা ফিজিক্স ব্যাপারটা খেয়াল করেছিল। লিখলাম। (স্টার ক্যাম্পাসে ছাপা হওয়া লেখাটার লিঙ্ক। )
(ইভেন্ট এর প্রথম দিনের ছবি)
আসলে ফিজিক্স নিয়ে হটাৎ করে লিখতে বসার একটা কারন আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে পেপার এ দেখলাম পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেলেন গিম ও নভোসেলভ। কে তারা? কি জন্য পেল? - কিছুই জানতে ইচ্ছে করলনা। এদের দিয়ে আমি কি করব!! একদিন ঢাবি পদার্থবিজ্ঞান থেকে কেউ পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পাবে এই স্বপ্ন দেখার লোভ তো সামলাইতে পারিনা। মনে হয় না মাস্টার্স এর পর আর ফিজিক্স পরব। কিন্তু একদিন ঠিকি বলব এমন জায়গায় ছিলাম যেখান থেকে অমুক আজকে নোবেল পুরস্কার পাইসে। আজ থেকে ৪০ বছর পর নাতি-নাতনিদের বলা সেটাই হবে আমার প্রিয় গল্প।