বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে ইচ্ছেমতো অনেক কিছু লেখার স্বাধীনতা আছে। বৈজ্ঞানিক সত্যিকারের কাহিনীতে নাই। ইতিহাসকে জানার জন্য আমার ইন্টারনেট এবং অন্যান্য বইয়ের সাহায্য নিতে হয়েছে কাজেই আমি দাবী করতে পারিনা এটা আমার মৌলিক লেখা। তবে যেহেতু আমি সহজ সরল লেখা লিখে অভ্যস্থ কাজেই লেখাটা আমি আমার ছাঁচেই লেখার চেস্টা করেছি। বিজ্ঞানের প্রতি যাদের ভক্তি শ্রদ্ধা অপরিসীম তারা হয়ত চটে যেতে পারেন। আমি ক্ষমা প্রার্থী।
১৯০০ সালের ৭ অক্টোবার সন্ধ্যার দিকে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সন্ধ্যার দিকে নিজ বাসায় বসে চা বিস্কুট পিয়াজি ছোলা বুট জাতীয় খাবার খাচ্ছিলেন। তার পরীক্ষনবিদ রুবেন্স এবং তার স্ত্রী ওই সময় বাসায় আসল। তারা আমাদের মত পরচর্চায় ব্যস্ত ছিল কিনা জানা না গেলেও এতটুকু জানা যায় যে রুবেন্স তার একটা পরীক্ষার কথা বলছিল। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরনের বর্নালীর ঘনত্ব তাপমাত্রার সমানুপাতিক। তবে কম্পাঙ্ক অবশ্যই কম নেওয়া লাগবে। ব্যাপারটা রালে জিন্স নামক একজনের আইনের সাথে খাপ খেলেও ভীনের আইনের সাথে মোটেও যাচ্ছিল না। কিন্তু ভীন যেটা বলেছে সেটাও যে সত্যি। ফ্রিদ্রিশ প্যাশেন নামক একজন সেটা প্রমান করে গেছেন। এখন তো তাইলে লাগসে ঘাপলা। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরনের বর্নালীর ঘনত্ব ব্যাখ্যা করতে দুটো পরষ্পর বিরোধী সমীকরন প্রয়োজন। তাইলে উপায়?
মেহমানদের মাক্স প্ল্যাঙ্ক চায়ের সাথে নাস্তা কি দিয়েছিলেন সেটা জানা যায়নি। কিন্তু তারা বিদায় নেওয়ার পর তিনি একটা ফর্মুলা পেয়ে গেলেন যা বড় এবং ছোট কম্পাঙ্কে দুই আসন্ন মানে দু’রকম ব্যাবহার করে। যেহেতু তখন ইমেল, ফেসবুক এসব ছিলনা, আর কবুতর দিয়ে ফর্মুলা পাঠানো হয়ত সমিচীন হবেনা (কবুতর যদি পরে এই ফর্মুলা নিজের বলে দাবী করে??) তাই তিনি পোস্টকার্ড এ করে রুবেন্স কে ফর্মুলা পাঠালেন। এভাবেই মুলত কোয়ান্টাম ধারনার সৃষ্টি। এই আবিষ্কার এর গুরুত্ব ব্যাপক। কারন তখন সবাই জানত পদার্থবিজ্ঞানের সব কিছু আবিষ্কার হয়ে গেছে। মানে মৌলিক কোনোকিছুই বাকি নাই। সবাই মনে করত পরীক্ষন যন্ত্রের উন্নয়ন সম্ভব। নতুন তত্ত্ব না।
প্লাঙ্কের বিকিরনের ঘনত্বের দুটো ধ্রব সংখ্যা ছিল। একটা তো তথাকথিত বোল্টৎসম্যান-এর টাই। আরেকটা কার্যের সর্বনিম্ন মান যার নিচে কার্য সম্পাদন হতে পারেনা। নামায পড়তে গেলে যেমন সুরা ফাতিহা জানা লাগে। পদার্থবিজ্ঞানে পরতে গেলে এই মানটা জানা লাগে। 6.6 * 10 ^ -27 erg sec.
এর ৩ বছর পর একজন লোক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলেন। তিনি কখনই কোন কিছুতে বোর ফিল করতেন না। সব সময় চাঙ্গা থাকতেন। বইয়ের পোকা ছিলেন না। সাইকেল চালানো, নৌকা চালানো, ফুটবল খেলা এইগুলা তার পছন্দের কাজ এবং তিনি খুবই চঞ্চল ছিলেন। তার একটা স্বভাব ছিল তিনি কখনই কোন কিছুর শেষ না দেখে ছাড়তেননা। একটা সমস্যা নিয়ে লেগেই থাকতেন। তার নাম নীলস বোর। নীলসবোর আর রাদারফোর্ড এর পরমানু মডেল আমরা জানি। এখন দেখা যাক মাক্স প্ল্যাঙ্ক এর কাজে তিনি কিভাবে নাক গলালেন। রাদারফোর্ড এর মডেলে একক দৈর্ঘমাত্রার রাশির প্রবর্তন করতে গিয়ে তিনি খেয়াল করলেন, প্ল্যাঙ্ক এর ধ্রুবক এর সাথে আধান গুন করে যে রাশি পাওয়া যায় সেটাই পরমানুর আকৃতির সমান। তিনি আবিষ্কার এর বৈশিষ্ট্য ছিল সেখানে জটিল কোন গনিত ছিলনা।
নীলসবোর ধীরে ধীরে ডেনমার্ক এর বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন। ১৯২১ সালে তার নামে থীওরেটিকাল ফিজিক্স এর ইন্সটিউট খোলা হয়। ১৯২২ সালে নোবেল পুরষ্কার পান। ১৯২২ সালের ১২ থেকে ২২ জুন “বোর উৎসব” পালন করা হয়। বোরের বক্তৃতা শুনতে মোটেও বোর লাগতনা তাই অনেক পদার্থ বিজ্ঞানী আর গনিতবিদ এসেছিল। এমনকি মিউনিখ থেকে সমারফিল্ড তার দু’জন মেধাবী ছাত্র নিয়ে এসেছিলেন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলা যায় সেখানেই শুরু। বোরের অতিপ্রিয় করেস্পন্ডেন্স নীতির উপর আপত্তি জানালেন একজন। তিনি সমারফিল্ড এর ছাত্র। তার নাম হাইসেনবার্গ। বোর বেশ অবাক হলেন হাইসেনবার্গের গভীর বিশ্লেষনী ক্ষমতা দেখে।
বোরের পরমানু গঠনে বিষম জীমান ক্রিয়া নিয়ে কাজ করার সময় হাইসেনবার্গ অর্ধপূর্ন জীমান ক্রিয়ার ধারনা দেন। সমারফিল্ড অবশ্য এটাতে খুব খুশি হননি বলা যায় মানতেই পারেননি। কিন্তু ছাত্রের সৃজনশীলতা নিয়ে তার কোন সন্দেহ ছিলনা।
হাইসেনবার্গের পিএইচডি ছিল তরল পদার্থ রৈখিক প্রবাহ থেকে কিভাবে বিক্ষুদ্ধ প্রবাহে যায় - এ বিষয়ে। হাইসেনবার্গ এর পিএইচডি পরীক্ষার পরীক্ষন ছিলেন ভীন।অনুবীক্ষন যন্ত্রের বিশ্লেষনী ক্ষমতার জবাব দিতে না পারায় ভীন হাইসেনবার্গকে প্রায় ফেল করিয়ে দিচ্ছিলেন সমারফিল্ড এর কারনে তা হয়নি। মজার ব্যাপার এখানেই যে অনুবীক্ষন যন্ত্রের বিশ্লেষনী ক্ষমতা পরে হাইসেনবার্গ এর একটা তত্ত্বেই ফিরে এসেছিল।
পরের তিন বছর হাইসেনবার্গ এর জন্য খুব হতাশার সময়। মাক্স বর্ন নামের একজনের সাথে কাজ করতে যান। মাক্স বর্ন একটা জায়গায় লিখেছিলেন, "আমি হাইসেনবার্গ কে দেখে কৃষক ভেবেছিলাম। সে ছিল একজন হতাশাগ্রস্থ যুবক"। মাক্সবর্নের সাথে হিলিয়াম পরমানু নিয়ে গবেষনা করার সময় আবার তিনি অর্ধপূর্ন কোয়ান্টাম সংখ্যা নিয়ে এলেন আর দেখলেন হা এটাতেই সব মিলে যায়। কিন্তু ১৯২৪ সালে নীলস বোর বললেন পরমানুর তত্ত্ব বলে কিছু নেই।
১৯২৫ সালে হাসেনবার্গ হাইড্রোজেন বর্নালী নিয়ে কাজ করার সময় অনুধাবন করলেন প্রচলিত গনিত দিয়ে কিছু হবেনা। আসলে পরমানু এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় গেলেই না বিকিরন হবে। আর বিকিরন এর গানিতিক প্রকাশ যে সম্ভাবনা দিয়ে হয় তা প্রাথমিক আর চূড়ান্ত দুটারই নির্দেশক থাকবে। এর মানে হল, প্রচলিত গনিত অনুযায়ী (গরু * ছাগল = ছাগল * গরু) এক কথা হলেও কোয়ান্টাম এ তা না। xy = yx এখানে নাও হতে পারে। গরু ও ছাগল বা x ও y ভিন্ন ভিন্ন কোয়ান্টাম সংখ্যার উপর নির্ভরশীল। পদার্থবিজ্ঞানে এ ধরনের গনিত আগে কখনো ব্যবহার করা হয়নি।
১৯২৫ সালের শেষের দিকের কথা। হেলগোল্যান্ড নামক এক দ্বীপে তখন ডিরাক আর হাইসেনবার্গ। হাইসেনবার্গ এর শরীর ভালনা তাই তিনি বিশ্রাম এর জন্য তখন সেখানে। ডিরাক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিন্তিত যদিও সেই সময় পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ। বোরের কোয়ান্টাম তত্ত্ব নতুন গনিতে কিভাবে আনা যায় হাইসেনবার্গ তাই নিয়ে ব্যাস্ত। আবার নতুন এই গনিত পদ্ধতিতে শক্তির কনসারভেশন "ল" ঠিক রাখা লাগবে। রাত ৩ টার দিকে হাইসেনবার্গ বুঝলেন কাজ হয়ে গেসে। উত্তেজনায় তার ঘুম বলে কিছু নেই। তিনি বের হলেন আর দক্ষিনদিকে গেলেন। সমুদ্রের পার থেকে বের হওয়া শিলাক্ষন্ড সেখানে। তিনি সেখানে বসে সূর্যোদয় দেখলেন। সেটা কোন সাধারন সূর্যোদয় ছিলনা। সেটা ছিল কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূর্যোদয়।
হাইসেনবার্গ তার তত্ত্বগুলো মাক্সবর্নকে দিলেন। বর্ন সেগুলার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করে বুঝলেন এগুলা কিছুই না, হাইসেন বার্গের প্রতিকী গুনুন আসলে ম্যাট্রিক্স ক্যালকুলাস। পরবর্তিতে হাইসেনবার্গ, বর্ন আর জর্ডান একটা প্রবন্ধে কোয়ান্টাম গতিবিজ্ঞানের মুল কথাগুলো তুলে ধরলেন। ডিরাক ঐ দ্বীপে বসে ডাব খাওয়া ছাড়া কিছু করতে না পারলেও পরে হ্যামিল্টনীয় পদ্ধতির উপর এবং শ্রোডিঞ্জার তরংগ বিজ্ঞানের উপর প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। কোয়ান্টাম গতিবিজ্ঞান ডিরাক, হাইসেনবার্গ আর শ্রোডিঞ্জার প্রায় একই সময়ে আবিষ্কার করে ফেললেন।
তবে ঝামেলা কমেনায়। ১৯২৬ সালে মিউনিখে শ্রোডিঞ্জার বোরের “কোয়ান্টাম ঝাপ” বাদ দেওয়ার কথা বললেন। হাইসেনবার্গ দাঁড়ায় বললেন তাহলে প্ল্যাঙ্কের আইন আর বোঝা যাবেনা কারন সেখানে শক্তির বিচ্ছিন্নতা আইন বলা আছে!! ভীন (হাইসেন বার্গ এর পিএইচডি পরীক্ষক) আরো ক্ষেপে গেলেন। তিনি হাইসেনবার্গ কে বললেন, “ যুবক, কোয়ান্টাম ঝাপ তোমাকে ভুলে যেতে হবে এটা শুনে তোমার খারাপ লাগবে জানি, কিন্তু নিশ্চিত থাকো, শ্রোডিঞ্জার সব কিছুর জবাব দিয়ে দিবে”।
১৯২৬ সালের পরের দিকের ঘটনা। হাইসেনবার্গ বোর এর সাথে কথাবার্তায় ব্যস্ত। কথাবার্তা হল কিন্তু শান্তি মিলল না। নরওয়ে গেলেন কাজ করতে। কোপেনহেগেন এ বসে তিনি বার্লিনে একজন একটা কথা বলেছিল সেটা মনে পড়ল। কথাটা যার তার না, কথাটা আইন্সটাইন এর। তত্ত্বই সব সময় ঠিক করে দেয় পরীক্ষনে কি দেখা যাবে। তখন হাইসেনবার্গ বুঝলেন নতুন গনিত দিয়ে কি বর্ননা করা যায় সেটাই বিবেচ্য। ডিরাক আর জর্ডান এর তত্ব ব্যবহার করে দেখালেন ইলেক্ত্রন এর সঠিক অবস্থান আর ভর নিখুত ভাবে মাপা যায়। এভাবেই হাইসেনবার্গ কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তাত্ত্বিক ভিত্তি খুঁজে পেলেন।
আইন্সটাইন এই ব্যাখ্যা মেনে নেননি সারা জীবন। ১৯২৭ সালে সলভে সম্মেলন এ আইন্সটাইন আর নীলসবোর একই হোটেলে থাকতেন। হাইসেনবার্গ, পাউলি এরাও ছিলেন। বোর এর সাথে আইন্সটাইনের কথা হয়। হাইসেনবার্গ আর পাউলি খুবই আতঙ্কে থাকতেন। কারন প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে আইন্সটাইন হাইসেনবার্গের অনির্দেশ্যতা নীতেতে প্যাচ লাগানোর জন্য আর তা বাতিল করার জন্য বোর কে কিছু একটা বলে যেতেন। আবার বোর ও দেখা যেত রাতেই ডিনার করার আগে সেটার উত্তর আইন্সটাইন কে দিয়ে দিতেন আর হাইসেনবার্গ স্বস্তি পেতেন। এভাবে নিয়মিত চলল। শেষ পর্যন্ত কোপেনহেগেন এর পদার্থবিদদের ধারনা তারা জিতে গেছেন। কারন আইন্সটাইন তেমন কোন আপত্তি গড়ে আর তুলতে পারলেননা। বোরের সব থেকে কার্যকরী জবাব ছিল সাধারন আপেক্ষিক তত্ত্ব ব্যাবহার করে আইন্সটাইন এর আপত্তি খন্ডন করা।
বিজ্ঞানীদের এই কাহিনীতে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও জড়িত। কোয়ান্টাম গতিবিদ্যা আবিষ্কার এর আগে ঢাকা থেকে বোস প্ল্যাঙ্কের সমীকরন বের করার পদ্ধতি আইন্সটাইনকে পাঠান, সেটা ব্যাবহার করেই আইন্সটাইন বোস-আইন্সটাইন পরিসংখ্যান তত্ত্ব দ্যান। শ্রোডিঞ্জার অবশ্য সেটা তেমন পছন্দ করেননি। ১৯২৬ সালে কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার জন্মের সময় তিনি আইন্সটাইনকে বলেন, সম্ভাবনার ধারাকে অসঙ্গতাভাবে ব্যাবহার করা হচ্ছে। সম্ভাবনা দিয়ে বাস্তবতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা দেওয়া উচিত। কিন্তু আপনারা এমন ভাব করেন সেখানে সম্ভাবনার বক্তব্য প্রদান করা প্রয়োজন যার বাস্তবই অস্পষ্ট!!
আইন্সটাইন জবাব দেন, "এই সম্ভাবনাভিত্তিক ব্যাখ্যা সত্যি হলে পদার্থবিদ্যা হবে দোকানদার আর প্রকৌশলীদের। পুড়াটাই জগাখিচুরী হয়ে যাবে"। এই ঝগড়ার মধ্যে শ্রোডিঞ্জার তার সেই বিখ্যাত বিড়ালের “মানস পরীক্ষা” এর কথা বলেন। বাক্সের মধে বিড়াল থাকলে তার জীবিত বা মৃত হওয়ার তরংগ অপেক্ষক বিড়ালটির জীবিত বা মৃত অবস্থার সম্ভাবনার যোগফল।
ডি ব্রগলি আর আইন্সটাইন এর অবদান নিয়ে অনেক কিছু বলা হয়নি কারন ইতিমধ্যে লেখাটা অনেক বড় হয়ে গেছে।