মার্বেল খেলার সময় কাদের অন্যদের সাথে খুব একটা পেরে উঠতনা। এ ব্যাপারটি সে কখনো সহ্যও করতে পারতনা। তার দুই সহচর রহমত আর মতি। নানা উছিলায় তাদের মার খাওয়ানোই ছিল কাদের এর কাজ। এটা ওটা মিথ্যা কথা বলে প্রায়ই তাদের বিরুদ্ধে নালিশ দিত।
কাদের এর স্বভাব চরিত্রও তেমন ভাল ছিলনা। গ্রামের গোসল খানায় সুরক্ষা সবসময় কম। সেখানে ছিদ্র করে মেয়ে মানুশ দেখতে গিয়ে সে একবার ধরা খেল। তার উপর অনেক উত্তম মধ্যম চলল। রহমত কোনভাবে তাকে সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দিল।
তারা তিনজনই যখন মোটামুটি পরণত বয়স তখন দেশের উপর ঘোর দূর্যোগ নেমে আসল। পাকিস্তান হানাদার বাহিনি নামক স্বাক্ষাত আজরাইল কালো চাদর বিছানো শুরু করল এই দেশে। এমন অবস্থায় রহমত, কাদের মতিদের বয়সীরা দেশ মাতৃকা সেবায় এগিয়ে এল। সেই সেবায় তারা তিনজন ই গেল। কাদের অবশ্য কি জন্য গেল নিজেই জানেনা। দেশ কি আর সমাজ কি এটা বোঝার জন্য যে বিবেকটা লাগে তার কোন কিছুই কখনও তার ছিলনা। সে সেখান থেকে পালিয়ে এল। এবং অবাক নয়নে খেয়াল করল মুক্তিযোদ্ধা নামক সামান্য চাকরির (!!) থেকে রাজাকার এর চাকরিটা অনেক সহজ এবং লোভনীয়। পাকিস্তানিরা তাদের গ্রাম এ আসার সাথে সাথে সে তখন তাদের খুশি করার কাজে নিয়োজিত থাকল। যে রহমত একদিন তাকে মার থেকে বাঁচিয়ে ছিল সেই রহমত যখন তার বউয়ের সাথে দেখা করতে আসল তখন কাদের দলবল সহ তাদের ধরিয়ে দিল। রহমত এর বউকে ধর্ষন করা হল রহমতকেও মেরে ফেলা হল কাদের এর কোন ভাবান্তরই হল না।
এরপর আর কাদের এর আপাতত গল্প নাই। যুদ্ধে মতি বেশ বাজে ভাবে আহত হল। তার এক পা উরু থেকে কেটে ফেলতে হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোন এক কারনে রাষ্ট্রীয় ভাবে তাকে কোন পুরঃষ্কার দেওয়া হলনা। সম্ভবত কোন গাফেলতী এর ব্যাপার অবশ্যই ছিল। মতির দুঃখ কষ্টের সংসার কোনভাবে চলতে লাগল। ঐ অবস্থাতে পরে তার দুই পুত্র সন্তান হয়।
যুদ্ধ-বিগ্রহে প্রায় ধংস একটা দেশ কে গড়ে তোলার বিশাল দ্বায়িত্ব তখন জাতির পিতার হাতে। রাজাকারদের বিচার শুরু করলে দেশে সম্ভবত আরো অরাজকতার সৃষ্টি হতে পারে তাই হয়ত তিনি ছিন্তা করলেন আপাতত স্থগিত রাখতে। একদিন যখন নিজ বাসায় বসে তিনি দেশ মাতৃকার কথা ভাবছিলেন তখন কেউ একজন সাহস করে বলল, জাতির পিতা, বাংলাদেশ সৃষ্টির কারনে সবাই আপনাকে সারাজীবন মনে রাখবে। কিন্তু মনে রাইখেন, ইতিহাস একদিন আপনাকে এই প্রশ্ন অবশ্য করবে কেন আপনি রাজাকারদের সমুলে উটপাতন করেন নি। সাপের খোলস বদলানো কাদের কিভাবে যে একজন মুক্তিযোদ্ধা হল তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই ভাল বলতে পারবেন। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার তখন ঐখানে সবাই জানে সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। ঐসময়ে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট প্রদান করা হল এবং সেও একটা পেল। ১৯৭৫ এ জাতির পিতা হত্যাও সে খুব কাছে থেকে অবলোকন করল। তাকে একবার জিজ্ঞসে ও করা হল তুই এখানে কি করিস? তার উওর সে জাতির পিতার কেউ না।
জিয়াউর রহমান আসার পর দেশে রাজাকার নামক পরিচিত জনগন সুযোগ পেল রাজনীতি করার। সেই সবর্ন সুযোগ হেলা ফেলা করার মত লোক কাদের না। তারপর থেকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার পালা এল। তার আঙ্গুলের সাথে সাথে সে নিজেও ফুলে গেল। তবে সে কিন্তু রাজনৈতিক কোন ব্যাক্তিত্ব না। কিছু মানুশ যানে কিভাবে সব জায়গা থেকেই ফায়দা নিতে হয়।
মুক্তিযোদ্ধা যারা ছিলেন তারা হলেন সুবিধা বঞ্ছিত মানুষ। নিজ অধিকার আদায়ের জন্যই মুক্তিযুদ্ধের সুচনা। দেশের কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মানুষ যারা অনেক ত্যাগ এর বিনিময়ে দেশ কে এনে দিয়েছে তাদের জন্যই মুক্তিযুদ্ধ সার্টিফিকেট। কারন দেশকে সবার কথা ভাবতে হয়। অনুন্নত অঞ্ছলের মানুষ যাতে উন্নত অঞ্ছলের মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় সমান সুযোগ টা পায় তাই মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট। কাদের এর মত লোকজন এর জন্য এটা নয়। এমন কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিন্তু আর্থিক ভাবে সচ্ছল নিজের যোগ্যতা প্রমানে সফল তাদের জন্যও ক্ষেত্র বিশেষে এই সুবিধা দেওয়া উচিত না।
কাদের এর এক ছেলে ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় অনেক পিছনে থেকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়াও সুযোগ পায়। মতির ছেলে ঢাবি তে টিকতে না পেরে জগন্নাথ এ পরে। কয়েকদিন আগে বিসিএস পরীক্ষা হয়ে গেল। কাদের এর ছেলে বেশ আশাবাদী। অন্তত পক্ষে সার্টিফিকেট এর জোড়েও যদি কিছু একটা হয়ে যায়। সুবিধা বঞ্ছিত মতির ছেলে সাধ্যমত দিয়েছে পরীক্ষা।
(আমার ক্লাসের এক বন্ধু গালিব এর বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। গালিব তার বাবার সার্টিফিকেট কখনো ব্যাবহার করেনি। উপহার পাওয়ার জন্য তো আর কেউ মায়ের সম্ভ্রাম রক্ষা করতে ঝাপিয়ে পড়েনা, সেটা তো মুক্তযোদ্ধাদের কর্তব্য। গালিব এর বাবা দুই বছর আগে মারা যান। কবরে শোওয়ানোর আগে বাবার দেহের উপর লাল-সবুজ পতাকা বিছিয়ে দেওয়া হয়।)