একজন ক্রিকেটারের জীবনের সব থেকে বড় মূহুর্ত হল যখন সে নিজের দেশের হয়ে খেলে, নিজের দেশের মানুষের সামনে খেলে এবং নিজের দেশের মানুষের সামনে দেশকে জিতায়। মাঠে পারফর্ম করে দেশকে জিতানোর অনুভুতি কি সেটা একটা ক্রিকেটার ছাড়া আর কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। বিশ্ব ক্রিকেট এ বাংলাদেশ এমন একটা দল যারা খুব নিয়মিত ম্যাচ জিততে পারেনা। তারপরেও কিছু কিছু ক্রিকেটার আছেন যারা সেই বিশেষ মুহুর্ত গুলো অনুভব করেন। যখন আশরাফুল ১০১ করে ম্যাচ জিতান অস্ত্রেলিয়ার সাথে, যখন মাশরাফী ৪ উইকেট পান ইন্ডিয়ার সাথে।
অনেক ক্রিকেটার আছেন যোগ্যতা থাকলেও নিজের দেশের জন্য টেস্ট খেলা হয়ে উঠেনি। শহীদ জুয়েল এর ব্যাপারটা একটু বেশি ভিন্ন ছিল। যেই দেশের জন্য তার টেস্ট খেলার কথা, পাকিস্তান এর মত দলে খেলা ছিল শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার, সেই পাকিস্তান এর অন্যায়, অত্যাচার এর বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন ৯ মাস। যুদ্ধের অন্তিম কালে তিনি ধরা পরেন এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি তাকে হত্যা করে। পরম আদরে ও শ্রদ্ধায় তিনি এখন দেশের মাটিতে শুয়ে আছেন। তার চরম আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। যেই দেশের জন্য তিনি জীবন দিয়েছেন সেই দেশ পরে শত্রু মুক্ত হয়েছিল। সেই দেশের অনেক ছেলেই এখন টেস্ট ক্রিকেট খেলে। শহিদ জুয়েল এর সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী একজন জাহাঙ্গির তিনি শহিদ জুয়েল এর বন্ধু। জাহাঙ্গির এর ছেলের নাম ফয়সাল। গল্পটা ফয়সাল কে নিয়ে।
আর দশটা ছেলের মত ফয়সাল এর স্বপ্ন ছিল ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে- এই কথাটা বলা তাও সহজ ব্যাপার আর ১০ টা ছেলের মত ফয়সাল ক্রিকেটার হবে এটা বলা এত সহজ নয়। কারন দেশের হয়ে খেলার জন্য , দেশকে জিতানোর জন্য হতে হয় সেরা ক্রিকেটার। ফয়সাল শুনেছে শচিন টেন্ডুলকার ১০ ঘন্টা প্র্যাকটিস করত। ফয়সাল ও করার চেস্টা করে। প্রতিটা শট বার বার প্র্যাকটিস করে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫০ কিলোমিটার এ বল আসে দেখে সে ২২ গজ নেট এ প্র্যাকটিস করেনা। ১৫ গজ এ করে। যাতে সাধারন বোলারের বল ও অনেক জোরে আসে। তার একটাই স্বপ্ন। সে দুর্দান্ত সব ইনিংস খেলে বাংলাদেশ দলকে জিতাবে। গ্যালারীতে লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে সবাই মেতে থাকবে। পতাকা একটা তার নিজেরও আছে। মাঝে মাঝেই মাথায় লাগিয়ে ব্যাট করে।
ফয়সাল এর ক্রিকেট ভক্ত বাবার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ এ খেলবে।
পুরা বাংলাদেশ জাতি যখন ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপ এ বাংলাদেশ কে দেখার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছিল তখনই কেনিয়া এর কাছে ১৩ রান এ হেরে জাতির স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, স্বপ্ন ভাঙ্গার বেদনা ফয়সাল এর বাবাকেও স্পর্শ করে। ফয়সাল তখন অনেক ছোট। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি তে বাংলাদেশ এর স্বপ্নপুরন হয়। আকরাম খান মাত্র ৬৭ রান এর একটা ইনিংস (হল্যান্ড এর সাথে) এর উপর দাঁড়িয়ে যায় পুরা বাংলাদেশ এর স্বপ্ন। ফাইনালে কেনিয়াকে হারাল বাংলাদেশ। সমগ্র বাংলাদেশ তখন আনন্দে মাতোয়ারা।
এর কিছু বছর পরে ফয়সাল এর বয়স যখন ১৭ তখন ঢাকাতে অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপ। কঠোর পরিশ্রম করে নিজেকে গড়ে তুলছে ফয়সাল। ৪ নম্বর পজিশনটা তার দারুন পছন্দ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কোচ সব প্র্যাকটিস ম্যাচ এ তাকে ৭ নম্বরে নামায়। বল কম পায় সে। একটা খেলায় কোন বল ফেস করার আগেই রানআউট হয়ে গেল। ৪ নম্বর পজিশন এর জন্য ফয়সাল ছাড়া আরেকজন যে দাবিদার সে আবার সাবেক এক ক্রিকেটার এর ছেলে। দল ঘোষনা করার ৩ দিন আগে তার বাবা মারা গেলেন। সেই শোক কাটাতে না কাটাতেই ফয়সাল একটা অদ্ভুত কথা শুনল। টিম এ সুযোগ পেতে হলে নাকি তাকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি ইহলকের মায়া ত্যাগ করেছেন। ক্রিকেট খেলাটা ফুটবল খেলা না যে গোলাকার কোন বস্তু পাইলেই খেলা যায়। অনেক ব্যায়বহুল একটা খেলা। অল্প বয়স্ক কারো যখন বাবা মারা যায় তখন তার অভিভাবকের অভাব হয় না। ফয়সাল এর বেলাতেও তাই হল। যেহেতু সে টাকা দিতে না পারায় দলে সুযোগ পেলনা তারপরে তার চাচারা তাকে নিয়ে আজে বাজে কথা বলা শুরু করল। ঐসব ঢঙ্গের খেলা বাদ দিয়ে অন্য কিছু কর। ফয়সাল কি করবে বুঝল না। কিন্তু খেলাটা আপাতত বন্ধ করতে হল।
ক্রিকেট তার অনেক আগ্রহের ব্যাপার সেটার প্রতি আর কোন গুরুত্বই থাকলনা। পরিবারে আছে মা আর বোন। বাবার জমানো অল্পকিছু টাকা নিয়ে আর দশজনের মত তখন সে মালয়েশিয়া তে চলে গেল। মালয়েশিয়া তে তার নিজের প্রিয় ব্যাট আর বাংলাদেশ এর একটা পতাকা তার সাথেই ছিল। এই পতাকাই মাথায় লাগিয়ে ব্যাটিং এ নামার চেস্টা করত ফয়সাল। মালয়েশিয়াতে শ্রম জীবন শুরু হল। কষ্টের জীবন কিন্তু টাকা পয়সা উপার্জন হচ্ছে। টাকা দেশে পাঠালে মা বোন খেতে পারছে। এভাবে আরো বছর ঘুরার পর একদিন ক্রিকেট খেলার একটা সুযোগ পেল। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে পাকিস্তান ভারত আর বাংলাদেশিরা মিলিত টিম হয়ে খেলবে। ফয়সাল যে কোনকালে ক্রিকেট খেলেছে সেটাও তখন কেউ জানেনা। হটাত করে একটা টিম এ প্লেয়ার কম ছিল তাই ফয়সাল কে নামিয়ে দেওয়া হল। শেষের দিকে ব্যাটিং এ নামল কিন্তু ব্যাটিং করে জিতিয়ে দিল দলকে। তার পরের দিন এ সে যে কম্পানিতে চাকরী করে তার মালিক মালয়েশিয়ার স্থানীয় একটা ক্লাব এ ফয়সাল কে খেলানোর ব্যাবস্থা করে দিল কারন মালিকেরই ক্লাব সেটা। মালয়েশয়া এমন কোন বড় শক্তি না কাজেই আসতে আসতে ফয়সাল মালয়েশিয়ার মুল দলে সুযোগ পেল।
পরের এশিয়া কাপ বাংলাদেশ মালয়েশিয়া আর পাকিস্তান যখন একই গ্রুপ এ পড়ল তখন ফয়সাল ছাড়া আর কারোরি ব্যাপারটা নিয়ে অতিরিক্ত খেয়াল ছিলনা। বাংলাদেশ পাকিস্তান এর আস্থে হারলেও জানা কথা মালয়েশিয়া কে হারাবে। বাংলাদেশ এর সাথে খেলার আগের দিন মাসুদ একবার তার ব্যাটটার দিকে তাকালো, প্রিয় ক্রিকেটার খালুদ মাসুদ পাইলট এর অটোগ্রাফ ব্যাট তে। খালেদ মাসুদ যে তার প্রিয় বাংলাদেশ কে জিতানোর জন্য একবার বলেছিল তার প্রিয় কাউকে জানি আল্লাহ তুলে নেন (১৯৯৭), সেটা আর সবার মত ফয়সাল এর মনেও গভীর দাগ ফেলেছিল। বাংলাদেশ মালয়েশিয়া খেলায় আগে ব্যাটিং করে বাংলাদেশ ২৩০ রান করল। এটা বেশিও না কমও না। ফয়সাল যখন ব্যাট করতে যাবে তার আগ পর্যন্ত ড্রেসিং রুম এ তার বাংলাদেশ এর পতাকাটাই ধরে ছিল। মালয়েশিয়া এর ক্যাপ্টেন সেটা দেখলেও কিছু বলেনি। এই ছেলেটাকে সে চিনে। সে একটু এরকম ই। ফয়সাল ব্যাট করতে নামল। খুব অবাক করা ব্যাপার তার ব্যাটিং করতে খুব সমস্যা হচ্ছে না। সাকিব রাজ্জাক মাশরাফি সবাইকেই সে টাইমিং করতে পারছে। সবাই অবাক হয়ে দেখল আসতে আসতে শেষ ওভার চলে আসছে মালয়েশিয়া এর হাতে তখন মাত্র এক উইকেট রান লাগবে দশ। শাফিউল বল করতে আসলে চার বল এ চারটা ডাবল আর একটা মিস করার পর এখন শেষ বলে লাগে মাত্র ২ রান। ফয়সাল মনে মনে বিড় বিড় করতে লাগল। বাংলাদেশ হারলে তার পরকালে বাবা যে মনে অনেক কষ্ট পাবেন। গ্যালারীতে এত এত বাংলাদেশি দর্শক। সবাই লাল সবুজ পতাকা হাতে। শাফিউল বল করতে আসল। ফয়সাল গ্রিপ দেখল। হা শাফিউল স্লোয়ার দিবে। বল হল, ফয়সাল খেলল, ৬। অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। মালয়েশিয়া এর কাছেই হেরে গেল বাংলাদেশ।
ফয়সাল টিম জিতানোর পর ড্রেসিং রুম এ যাওয়ার সময় অনেক বার বেইমান বেইমান শব্দটা শুনতে শুনতে গেল। ড্রেসিংরুম এ ২০ মিনিট বাংলাদেশ এর পতাকাটা নিয়ে ঝিম মেরে থাকল।
পরের দিন এ ফয়সাল মালয়েশিয়ান ক্রিকেট বোর্ড কে জানিয়ে দিল তার পক্ষে আর ক্রিকেট খেলা সম্ভব না। ফয়সাল তার পুরানো কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেল।