আমার বাবা মা আমার নাম রেখছিল জিকো। সাদা পেলের নাম ও ছিল জিকো। সম্রাট শাহজাহান এর পর যাদের যাদের নাম শাহজাহান রাখা হয়েছিল তারা কেউ সম্রাট হয় নায়। আমিও ফুটবলার হই নাই। কিন্তু হ্যা ফুটবলের প্রতি প্যাশন যেভাবেই হোক চলে এসেছিল।
আমার বয়স যখন ৬ তখন ১৯৯০ সালে ইটালি বিশ্বকাপ। উঠতে, বসতে, খাইতে, জাগতে, নাচতে, কুদতে তখন ম্যারাডোনা এর নাম। আমার জীবনে প্রথম খেলা দেখা আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল। ৬ বছর বয়সে খুব বেশি কিছু বুঝা সম্ভব না একমাত্র বল জালে প্রবেশ করলে গোল - এটা বোঝা ছাড়া। কিন্তু ঐ বয়সেও ক্যানিজিয়া এর গোল এর আগে আমি এটা চিন্তা করলাম বলটা চার জনের মাঝখান দিয়ে তার কাছে গেল কেমনে!! এই প্রথম বুঝতে পারলে কেন সবাই ম্যারাডোনা ম্যারাডোনা করে। অবশ্য ঐ খেলাটা পুরাটাই ছিল ব্রাজিল এর দখলে। খালি গোলটাই যে তারা দিতে পারেনায়। হাজার হোক ফুটবল তো গোলের খেলা।
১৯৯২ ইউরো তে জার্মানি যখন ফাইনাল ডেনমার্ক এর কাছে হারল পুরা এলাকায় খুশির রব। কারন ৯০ এর ফাইনাল এর কারনে কেউ জার্মানি কে দেখতে পারেনা। অথচ ডেনমার্ক নাকি ঐ টুর্নামেন্ট চান্স'ই পায়নায়। যুগোস্লাভিয়া তে যুদ্ধ। ওদের বদলে ডেনমার্ক। বিশ্বের সেরা গোল কিপার অবশ্য তখন ডেনমার্ক এর। (পিটার স্মাইকেল)
১৯৯৪ সালে এসে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ান হল। এই প্রথম বিশ্বকাপ এর সব গুলা খেলা দেখলাম (এরপর আর মিস ও নাই)। সৌদি আরব এর অবিশ্বাস্য গোল (সাইদ ওয়ার ওয়াইন) বেলজিয়াম এর সাথে। বেলজিয়াম রেফারি এর কারনে হেরে গেল জার্মানি এর কাছে। রাশিয়া এর ওলেগ সালেঙ্কো ক্যামেরুন এর সাথে একাই ৫ গোল দিল। কলম্বিয়া এর আন্দ্রে এস্কোবার আত্মঘাতি গোল দিল বিনিময়ে তার জীবনটাই দিতে হল। (পৃথিবীতে ন্যায় বিচার বলে কিছু নাই। এস্কোবার হত্যাকারী ২০০৫ সালে ছাড়া পায় জেল থেকে। এখন স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে)। আর্জেন্টিনা রুমানিয়া এর কাছে বাদ পরল। বুলগেরিয়া বাদ করে দিল জার্মানি কে। তবে ফাইনালটা খুবি বোরিং। ফাইনাল-এই যদি গোল না দেয় তাহলে আর হয় কিভাবে!! ব্যাজ্জিও টাই-ব্রেকার মিস করল, ব্রাজিল এর একটা শট তখনও বাকি, সেটার আর প্রয়োজন হল না। এর মধ্যেও হল্যান্ড ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনালটা ভাল ছিল। রোমারিও বেবেটো এর গোল-এ ব্রাজিল ২-০ তে এগিয়ে, হটাত বার্গক্যাম্প এবং আরেকজন এর গোলে ২-২ হয়ে গেল। পরে ব্রাঙ্কো এর গোলে জিতল। ব্রাজিল এর ক্যাপ্টেন ছিল রাই। যে রাশিয়া এর সাথে গোল দিয়েই ইঞ্জুরিতে পড়ে দেশে চলে যায়। পরে ক্যাপ্টেন হয় ডুঙ্গা। একটা খুব মজার ব্যাপার হল ২০০২ এও একই ঘটনা ঘটে। এমারসন ছিল ক্যাপ্টেন। পরে কাফু হয়। ওইবারও ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতে।
১৯৯৬ সালের অলিম্পিক ফুটবল ছিল দেখার মত। নাইজেরিয়া চ্যাম্পিয়ান হয়। সেমিফাইনাল এ হারায় ব্রাজিল কে। এক সময় ৩-১ গোলে পিছায় ছিল নাইজেরিয়া এর মধ্যে আবার পেনালটিও মিস করে। পরে অবিশ্বাস্য ভাবে ৪-৩ গোলে জিতে। (ব্রাজিল কখন ও আফ্রিকা এর কারো কাছে হারেনায় এটা সত্যি না, অবশ্য অলিম্পিক আন্ডার-২৩ টুর্নামেন্ট)। ফাইনালেও নাইজেরিয়া আর্জেন্টিনা এর সাথে ২-১ গোলে পিছিয়ে থেকে ৩-২ তে জিতে নেয়।
১৯৯৮ এর বিশ্বকাপ দেখলাম। গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচ এ যখন জিদান সৌদি আরব এর একজন এর জার্সি টেনে ছিড়ে লাল কার্ড পেল তখন ও বুঝিনাই যে এটা সেই জুভেন্টাস এর জিদান। তারপর জিদান স্বরুপে ফিরল সেমিফাইনাল এ। ডেভর সুকারের গোলে ক্রোয়েশিয়া তখন ১-০ তে এগিয়ে। লিলিয়ান থুরাম যে জীবনে এর আগে কিংবা এর পরে কখনও গোল দেয় নায়, জিদান তাকে দিয়েই দুইটা গোল দেওয়াইলো। কারন ট্রেজেগে আর পেটিট তখন পুরাই করা মার্কিং এ। লিজারাজু ও বল পাচ্ছেনা। ব্যাস, থুরাম এর ঐ দুই গোলে ফ্রান্স গেল ফাইনাল এ। জিদান ফাইনাল এ কি করল সেটা মনে হয় না বলার দরকার আছে। জ্যামাইকার কোচ আর্জেন্টিনা এর বিপক্ষে মাঠে নামার আগে বলেছিল আর্জেন্টিনা (আর্জেন্টিয়ান কোচ ই ছিল) কে হারানোর গোপন রহস্য নাকি সে জেনে গিয়েছে। এরপরেও ৫-০ গোল এ হারল। বাতিস্তুতা ৩ টা, শূন্য ভেক্টর ওর্তেগা ২ টা। ফিজিক্স এর নাল ভেক্টর কি জিনিস এটা ওর্তেগা কে দেখে শিখেছিলাম। একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বলটা নিয়ে সবাইকে কাটিয়ে আবার ঐ জায়গায় এসে বলটা হারিয়ে ফেলা। লব্ধি ভেক্টর জিরো। ভয় হইতেসে রবিনহো আবার এইতা শুরু না করে।
১৯৯৯ সালে আমি সব থেকে অবিশ্বাস্য একটা খেলা দেখলাম। আমার প্রথম চ্যাম্পিয়ান্স লীগ ফাইনাল। বায়ার্ন মিউনিখ আর ম্যান ইউ। ৯০ মিনিট পর্যন্ত মিউনিখ ১-০ গোলে এগিয়ে। ইঞ্জুরি টাইম এ ম্যান ইউ এর ২ গোল। অবিশ্বাস্য। এরপর থেকে চ্যাম্পিয়ান্স লীগ ফাইনাল আর কোন বাদ দেই নাই।
২০০২ এ ব্রাজিল এর তখন কি খারাপ অবস্থা সেটা কেউ মনে রেখেছে কিনা জানিনা। বিশ্বকাপ খেলতে আসার আগে ব্রাজিল হন্ডুরাস এর সাথেও তখন একটা খেলা হারল। রোমারিও কে টিম এ নেওয়ার জন্য স্কোলারি কে হত্যার হুমকি দেওয়া হল। আসল ভাঙ্গাচুরা ব্রাজিল। আর্জান্টিনা আর ফ্রান্স ফাইনাল হবে এটা মোটামুটি সবাই লিখে দিল, বিশ্বকাপ এ অন্য দল গুলা কেন যে খেলতে আসছে কেউ কোন কারন খুঁজে পেল না।। পেলেও তাই বলল (পেলের কোনো কথাই অবশ্য কখনও ঠিক হয় না)। আর্জেন্টিনা আর ফ্রান্স ফার্স্ট রাউন্ডেই বাদ। ব্রাজিল কোন খেলা ড্র ও করেনায়। সব গুলা সরাসরি জিতল। রোনাল্ডো ফর্ম এ ছিল প্রতি খেলায় গোল দেয়। কাজেই ব্রাজিল ও জিততেই লাগল।
২০০৩ এ এইচ এস সি পরিক্ষা যেদিন শুরু হবে (দুপুর ২ টায়) তার আগের দিন রাতে জুভেন্টাস আর এসি মিলান এর ফাইনাল। চুপচাপ ড্রইং রুম এ খেলা দেখলাম। এক্সট্রা টাইম এর সময় আম্মা এসে হাজির। রাম ঝাড়ি দিল। পড়ীক্ষা দেওয়ার সময় ও আমার চিন্তা কে জিতসে!! বাসায় এসে শুনলাম এসি মিলান। শেভচেঙ্কো শেষ গোল টা দিসে।
২০০৫ এর এসি মিলান আর লিভারপুল এর ফাইনাল। আরেকটা অবিশ্বাস্য খেলা দেখলাম। আমি এমনিতে লিভারপুল এর সাপোর্টার। আমার এক কাজিন এর হাসবেন্ড সাজিদ ভাই ও লিভারপুল এর সাপোর্টার। এই খেলা দেখতে তিনি তখন ইস্তাম্বুল। ফার্স্ট হাফ এ এসি মিলান ৩-০ তে এগিয়ে। কাকা এর ক্রস এ ক্রেসপো এর গোল, আর্জেন্টিনা ব্রাজিল কম্বিনেশন। সেকেন্ড হাফ এ ৫৪ থেকে ৬০ এই ৬ মিনিটের মধ্যে খেলায় ফেরত আসল লিভারপুল। ৩ টা গোল দিল তারা। নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারলাম না। টাইব্রেকার এ পরে লিভারপুল জিতল।
২০০৬ বিশ্বকাপ আসলে সবাই দেখেছে তাই এটা নিয়ে এখানে কিছু বলতে চাই না। আর্জেন্টিনা এর ভাগ্য খারাপ ছিল টাই-ব্রেকার এ হারাটা সব সময় দুঃখজনক। ব্রাজিল যা খেলসে তার থেকে হারাই ভাল। আর জিদান কে কখনই ব্রাজিল জবাব দিতে পারেনায়। ম্যারাডোনা এর আর্জেন্টিনা কে হারাইসে (১৯৮২) কিন্তু জিদান এর ফ্রান্স কে কখনও পারেনায়।
২০০০ সালের ইউরো-টা খুবি দারুন ছিল। পর্তুগাল, হল্যান্ড, ফ্রান্স, ইটালি সব গুলা দারুন ফর্ম এ। হল্যান্ড সেমিতে ইটালি এর কাছে দুইটা পেনাল টি মিস করল (খেলার মধ্যেই), তারপর টাইব্রেকার এ হারল।। খেলা জিততে যে ভাগ্য কত বড় একটা ব্যাপার। ফাইনাল এ আবার ইটালি ৯০ মিনিত পর্যন্ত ১-০ গোলে এগিয়ে। ঘুমাইতে যাব আর ফ্রান্স এর গোল। তারপর এক্সট্রা টাইম এর গোল এ ফ্রান্স জিতল।
২০০৪ এর ইউরো তে গ্রীস যেভাবে চ্যাম্পিয়ান হইসে তাতে ফুটবল দেখাটাই ছাইড়া দিব নাকি ভাবসিলাম। ২০০৮ এ স্পেন তাদের যোগ্যতার প্রমান দিল।
বাছাই পর্ব পেরিয়ে এইবারের বিশ্বকাপ এ পর্তুগাল এর আসাটা যেমন চমক (হাঙ্গেরি সুইডেন এর অনেক পিছনে ছিল) বাহরাইন এর না আসাটা তেমন ই দূর্ভাগ্যজনক। নিউজিল্যান্ড এর সাথে ৫৪ মিনিটের পেনালটি-তে গোলটা দিলেই হয়ে যেত। এই গোল কেউ মিস করে!! গত বার ও ট্রিনিদাদ টোবাগো এর সাথেও একই কাজ করসিল তারা।
এইবার আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ান হওয়ার একটা ভাল চান্স আছে কারন হইল মেসি এবং পেলে। মেসি এর ফর্মটা দারুন। আর পেলে যখন যা বলে তার কোনোটাই সত্যি হয় না। ১৯৯৪ সালে কলম্বিয়া চ্যাম্পিয়ান হবে বলেছিল বেচারারা ফার্স্ট রাউন্ড পার হইতে পারেনায় (বাছাই পর্বে আর্জেন্টিনা কে ৫-০ গোলে হারিয়েছিল)। ২০০০ সালের মধ্যে নাকি আফ্রিকান কেউ বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হবে তা আফ্রিকান দের অবস্থা দিন দিন খারাপ হইতেসে। ২০০২ এ আর্জেন্টিনা ফ্রান্স ফাইনাল হবে ব্রাজিল কিছুই করতে পারবেনা তা ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ান। আরো আছে। ঘানা যুব ফুটবলের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান (২০ বছর আগের ঘটনা)। ঘানা এর এক খেলোয়ার কে দেখে পেলে বলেছিল সে নাকি ম্যারাডোনা কে ছাড়িয়ে যাবে। ঐ বেচারা পরে আর মেইন টিম এই চান্স পায়নায়। ব্যাক্তিগত জীবনেও তার দুই সন্তান মারা গেসে। পেলে বলসে এইবার নাকি আর্জেন্টিনা এর কোনো চান্স নাই। তখন থেকেই ভয়ে ভয়ে আসি।
মেসিকে প্রথম দেখি ২০০৫ এ যুবফুটবলের ফাইনাল-এ নাইজেরিয়া এর সাথে। মেসি ফাইনাল এ ২ টা গোল দেয়। এরপর দেখি এর তার কোনো থামাথামি নাই। মেসি স্পেন যুবদলেও চান্স পেয়েছিল কিন্তু সে তার জন্মভুমি আর্জেন্টিনা হয়ে খেলার সিধান্ত নেয়।
পৃথিবীতে যারা খেলা বুঝে তারা কোন দল সাপোর্ট করে এটা নিয়ে ব্লগে অনেক দিনের ক্যাচাল। একটা জিনিস সত্যি। পেলে ম্যারাডোনা দুই জন তার তার আমলে মহান ফুটবলার। ফুটবলার হিসেবে তারা সব সময় শ্রদ্ধার প্রাপ্য। পৃথিবীতে সাপোর্টার অনেক রকম ই আছে। কিন্তু খেলা তারাই বুঝে যারা মেসি ম্যারাডোনা এর ফুটবল প্রজ্ঞা কে শ্রদ্ধা করে। যারা ব্রাজিল টিমটাকে শ্রদ্ধা করে।