মানুষের জীবনে কত রকম অধঃপতন হয়। কিন্তু আমাদের জীবনের অধঃপতনের যে ট্র্যাজেডী, এটা সহ্য করা খুব কঠিন। এখনো চিন্তা করলে বেশ কষ্ট লাগে যে কি দিনগুলোই না গিয়েছিল আর কি দিনই না এল। আস্তে আস্তে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-আয়তনে যেন অর্ধেক হয়ে গেলাম। আর যেভাবে দিনকাল যাচ্ছে, তাতে মনে হয় না এ জীবনের আয়ু আর খুব বেশি দিন বাকি আছে। এই তো সামান্য কথা বলতে বলতে আয়ুকাল আরো কিছু মনে হয় কমে গেল। ডানপাশ ঘিরে আরেকবার লাল বিল্ডিঙটা দেখলাম। আহা একসময় এ বিল্ডিং-এর ভিতরই বাস করতাম। ওহ- কি দিনগুলোই না ছিল। বিল্ডিং এর নাম কার্জন হল। লর্ড কার্জন নামে একজন এই বিল্ডিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা। সেই ব্যক্তির পছন্দের রঙ লাল কেন কে জানে!!
যাই হোক আমি একসময় একজনের ব্যাগে করে প্রায় রোজই এখানে আসতাম। যে আমাকে নিয়ে আসত সে অবশ্য আমার ব্যাপারে খুব যত্নবান ছিলনা। প্রায়ই আমার গায়ের উপর বিভিন্ন দাগ টানত। উহ! কি যে ব্যাথা লাগত! কিন্তু কিছুই বলতে পারতাম না। কি করব বলেন- বই হয়ে জন্মানোতে অনেক সমস্যা। ও ভালো কথা আমার নাম কি জানেন? Fundamentals of physics. আমাকে বানানোতে Resnick, Halliday আর Walker –এর হাত রয়েছে। তবে যে উদ্দেশ্যে আমাকে বানানো হয়েছে তাতে আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত কোন উদ্দেশ্যই সফল হবে বলে মনে হচ্ছেনা। বর্তমান অবস্থার কথা বাদই দিলাম। যখন আমি রোজ কার্জন হলে আসতাম তখনকার কথাই ধরুন। আমাকে চ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করতে সে এতটুকু কার্পণ্য করত না। উহ আহ উহ.... এখনো মনে হয় কিভাবে দাগ কাটত আমার উপর। লাল কালি, নীল কালি, সবুজ কালি সবভাবেই দাগানো হত। যে দাগাত তার নাম ছিল মনে করেন মিস ‘y’। হ্যা, সে ছাত্রী ছিলো। কিন্তু কিভাবে জানি আমি হাত বদল হয়ে গেলাম। সম্পর্কে আমার খালাত ভাই Heat and Thermodynamics এর সাথে আমার অদল বদল হয় আরেকজনের সাথে। এইবার পরলাম এক ছাত্রের হাতে। তার প্রধান কাজ ছিলো টেবিলে আমাকে উপুর করে আমার উপর ধুমপান করা। আপনারা তো জানেনই গোল্ডলীফ সহ্য করা কতটা কঠিন। একদিন আবার খুব ব্যাথাও পেলাম। ছেলেটা চলতে চলতে রাস্তায় আমাকে সহ পড়ে গিয়েছিল। ছেলেটার একটা পা ভাঙল সেটাতে ব্যান্ডেজ করা হলো কিন্তু আমার কথা কেউ ভাবল না। সবাই ধরাধরি করে ছেলেটাকে নিয়ে গেল আর আমি রাস্তাতেই পড়ে থাকলাম। এত বড় একটা বই কারো চোখে পড়ল না কেন সেটাই আজব! অবশেষে একজন আমাকে তুলে নিল- অন্ধকার হয়ে আসছিল দেখে প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না লোকটা কে। Yeah got it… বুঝতে পারলাম কে… Oh No!!! ভেলপুরী মামা। এ যে সেই ভেলপুরী মামা যাকে সবসময়ই কার্জন হলের গেইটে পাওয়া যায়। যে মেয়েটার হাতে আমি থাকতাম, সেও এখানে ভেলপুরী খেত, ছেলেটাও খেত। যাই হোক- লাল, নীল, সবুজ কালি সহ্য করলাম। গোল্ডলীফ এর ধোঁয়াও সহ্য করলাম। এখন শুরু হল আমার আয়তন কমা। ভেলপুরী মামা একটা ভেলপুরী বিক্রি করতে হলেও আমাকে ছেঁড়েন। দুটো হলেও ছেঁড়েন। আরো বেদনাদায়ক হলো ভেলপুরী খাওয়ার পর লোকজন হাত মোছার জন্যও আমাকে ছেঁড়ে। আরে বাবা আমার একটা ইজ্জত আছে তো, নাকি!! এইখানে তো নিদেনপক্ষে টিস্যুটা ব্যবহার করা যায়। যাই হোক এ জীবন আর বেশি বাকি নাই। এখনো মাঝে মাঝে তাকিয়ে থাকি কার্জন হলের দিকে। কি চমৎকার লাল রঙ! আমার কভারটা এখনো টিকে আছে, সেটার রঙও লাল। এজন্যই কবি বলেছেন- কার্জনের রাজ্যে পৃথিবী লালময়। কোন কবি বলেছেন, এটা অবশ্য জানিনা। পৃষ্ঠা ছেঁড়ার সাথে স্মৃতিশক্তি কমে যাচ্ছে। বোঝেন না! আমার জন্য দোয়া রাখবেন।