শুরুটা না হয় করি আমাদের আশে-পাশের মানুষ দিয়ে। আমার এক চেনা মানুষ, যিনি একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ বছর ধরে ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করতেন। আমি তাকে মামা বলে সম্বোধন করতাম। তিনি প্রায় বলতেন, আমার বয়সী তার ও একটি মেয়ে আছে। কিন্তূু সে পড়তে চায় না!... তিনি আমাদের বাসায় আসতেন লাইট-ফ্যান অন্যান্য ইলেকট্রিক জিনিস মেরামত করতে। তিনি তার কাজে ছিলেন দক্ষ। এমনকি তার কিছু কথা তে তার জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে আন্দাজ করা যেত, বেশ কিছু জানতেন তিনি তার কাজের বাইরেও। একদিন হঠাৎ করেই শুনলাম, তিনি 'পাগল' হয়ে গেছেন। বিশ্বাস তখন করলাম যেদিন প্রথম দেখলাম, উনি রাস্তায় দৌড়াচ্ছেন অস্বাভাবিক ভাবে এবং অকারণে সবাই কে গালি-গালাজ করছেন। আমি খুব কষ্ট পেলেও কিছু করতে পারি নি, ছোট ছিলাম আমি। তবে আব্বু কে বলেছিলাম, আব্বু কেন তার চিকিৎসা করা হচ্ছে না? উনি বললেন, তার পরিবার চিকিৎসা করাতে আগ্রহী না। আমি বললাম, কেন? আব্বু বললেন তার পরিবার এর ধারনা, চিকিৎসা করাতে গেলে তার মৃত্যু ঘটবে! তখন কিছু বলতে পারি নি আমি। এর মধ্যে বেশ কয়েক বছর সেসব ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে পারি নি,কারণ তার মধ্যে আমাদের পরিবারে অনেক কিছু ঘটে যায়। অন্যকিছু নিয়ে ভাবার অবকাশ পাই নি। এসময় এর মধ্যে তার দেখা পাই নি। কিন্তু দীর্ঘদিন পর রাস্তায় তার সাথে দেখা। আমি ছিলাম রিক্সায়। তিনি রাস্তায় দিশেহারার মত ঘুরছিলেন। তার মুখভর্তি দাড়ি, নোংরা শরীর এবং অদ্ভুত বেশভূষা। হঠাৎ তিনি আমায় দেখলেন। তিনি যেন আমাকে চিনতে পারলেন। আমার নাম ধরে ডেকে বললেন, "মামণি, ভাল আছ? বাসার সবাই ভাল?" আমি মাথা হেলে উত্তর দিলাম। তারপর আবার তিনি হারিয়ে গেলেন এলোমেলো ভাবে হাঁটতে হাঁটতে। আমি এরপর ও কিছু করতে পারি নি। কি করতে পারতাম, তাও বুঝতে পারি নি। বাসা্য় এসে রাগতভাবে আব্বুকে বললাম, উনার পরিবার এখনও কেন চিকিৎসা করান না উনার? আর চিকিৎসা করাতে গেলে উনার মৃত্যু হতে পারে এটা ভুল ধারণা,তুমিও জানো। তোমাদের প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিভাবান চাকরিজীবি,তোমাদের কি কোন দায়ীত্ব নেই? উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এটুকুই বললেন, যেখানে পরিবার রাজী হয় না, সেখানে আমরা কি করতে পারি! তাঁকে নিয়ে অনেক গুজব আছে, যে তিনি স্ত্রীকে ফেলে নাকি অন্য নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সেজন্য তার পরিবার তাকে নিয়ে আর মাথা ঘাটায় না। তাও যদি হয়ে থাকে, তবে একজন মানুষ হিসেবে অন্ততঃ তার পরিবার-আত্মী্য়-স্বজন কি পারত না তাঁকে কোন হাসপাতালে ফেলে আসতে? অথবা কোন প্রতিবেশী? না। কেউ করে নি। আর আমি একজন স্কুলছাত্রী হিসেবে, যে নিজেই পরনির্ভরশীল..তার পরিবার কেও চিনি না মাত্র; কিছুই করতে পারি নি...আমরা রাস্তায় এরকম 'পাগল' মানুষ দেখলে সাধারণত এড়িয়ে চলি। অনেকে ভীড় করে দাড়ায়। অনেকে ক্ষেপায়। হাসে। এবার আসি বাংলাদেশের মানসিক রোগী দের হাসপাতাল প্রসঙ্গে। আমরা অনেকেই অনেক কে রসিকতা করে বলি, তোমার পাবনা হাসপাতালে যাওয়া উচিত! যদি তারা পাবনা মানসিক হাসপাতালের চিত্র একবার দেখতো! আর অন্যান্য হাসপাতাল এর অবস্থাও যদি একবার দেখতো! এবার আসি মানসিক রোগীদের চিকিৎসক প্রসঙ্গে। বেশিরভাগ চিকিৎসক সরকারি হাসপাতাল এর চে তাদের খোলা প্রাইভেট চেম্বারে বেশী মনোযোগ দেন। তাও, তারা রোগী দের পুরো সমস্যা না শুনেই প্রেসক্রিপশন লিখে, পরের রোগী কে ডেকে নেন। এরকম ভুক্তভোগী রোগী কম নেই। বলুন, দেশের এই হাল হলে আমাদের,এসব মানসিক রোগীদের কি হবে? মানসিক রোগী, তারা অসহায়। যাদের অনেকে 'পাগল' বলেন। কিন্তূু কখন কার কি হ্য়, তা বলা যায় না। তবে এসব মানসিক রোগী আমাদের আশে-পাশের মানুষ,আত্মীয়,বন্ধু,প্রতিবেশী এমনকি আমি বা আপনি ও হতে পারি।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১২:০২