১৯৯৮ সালে বিশ্বখ্যাত লন্ডনের সানডে টেলিগ্রাফের ১৭ মে সংখ্যায় ‘ম্যান উইথ দি গোল্ডেন গানস’ শিরোনামে হাইলাইটস হয়েছিলেন বাংলাদেশের একজন ধনকুবের। টেলিগ্রাফের ঐ সংখ্যাটিতে বাংলাদেশী ধনকুবেরকে নিয়ে লেখা হয়েছিল ব্যতিক্রমী প্রচ্ছদ কাহিনী। এর ফলে বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে পশ্চিমা জগতে দারুণ আলোড়ন তোলে এই ধনকুবের কাহন। প্রচ্ছদ কাহিনীতে টেলিগ্রাফের বিশেষ প্রতিনিধি মি. নাইজেল ফার্নডেল লিখেন, বিশ্বের প্রথম সারির এই অস্ত্র ব্যবসায়ী পৃথিবীর সর্বত্র বিশেষ করে পাশ্চাত্য সমাজে ‘প্রিন্স অব বাংলাদেশ’ বলে খ্যাত। বিশ্ব এই ধনকুবের আর কেউ নন, তিনি ড. মুসা বিন শমসের। যাকে বিশ্বের সর্বোচ্চ মহল ও দরবারে সম্মানিত ‘প্রিন্স মুসা’ বলেই সম্বোধন করা হয়।
২০১০ সালে তিনি আবার তোলপাড় তুলেন পশ্চিমা জগতে। এ তোলপাড় তার সাত বিলিয়ন ডলার সুইস ব্যাংকে আটকে যাওয়ার কারণে। এ একাউন্ট জব্দ করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষই। বলা হয়েছে, মুসা বিন শমসেরের ‘লেনদেন অনিয়মিত’।
টাকা তুলতে না পারার কারণ ১ কোটি ডলার দামের একটি মন্ট বাঙ্ক কলম। ফ্রান্সে তৈরী ওই কলম মাত্র একটিই তৈরি করেছে নির্মাতা কোম্পানি। ২৪ ক্যারেট স¡র্ণে তৈরী এ কলমটিতে রয়েছে ৭৫০০টি হীরকখ-।
এক কোটি ডলারের বেশি লেনদেনের কোন ব্যবসায়িক চুক্তিতে মুসা বিন শমসের সাক্ষাতকার করেন ওই কলম দিয়েই।
মুসা বিন শমসের বিশ্বাস করেন,এ কলম দিয়ে যে ব্যবসায় স্বাক্ষর করবেন তা সফল হবেই। সারা বছরই কড়া প্রহরায় এ কলমটি রক্ষিত থাকে সুইস ব্যাঙ্কের ভল্টে। প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় ওই কলম নিয়ে যাওয়া হয় নির্দ্দিষ্ট স্থানে। আবার সেভাবে ফেরত নিয়ে আসা হয়। কিন্তু সম্প্রতি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ওই কলমটি তুলতেই বাধা দিয়েছে তাকে। আর এ কারণে টাকাও তুলতে পারেননি তিনি। কলম তুলতে যাওয়ার পরই তিনি জানতে পারেন সুইস ব্যাংেক গচ্ছিত তার সকল সম্পদই জব্দ করা হয়েছে।
২০১০ সালের ৯ নভেম্বর আইরিশ ডেইলি মিরর এবং ১৪ নভেম্বর বৃটেনের দ্য উইকলি নিউজ এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলে জানায় ব্রিটেনের ক্যাম্পেইন মিডিয়া নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ওই খবরে মুসা বিন শমসেরের বিচিত্র বিলাসবহুল বর্ণাঢ্য জীবনের বৃত্তান্ত-বিবরণও দেয়া হয়।
তিনি যে রোলেক্স ঘড়িটি ব্যবহার করেন তার দাম ৫০ লাখ ডলার। ওই বিশেষ ঘড়ি মাত্র একটিই তৈরি করেছে নির্মাতা কোম্পানি। তার ইউনিক মন্ট ব্রাঙ্ক কলমের দাম ১০ লাখ ডলার। বেশভূষা অঙ্গসজ্জায় তিনি ব্যবহার করেন ১৬ ক্যারেটের একটি রুবি। যার দাম ১০ লাখ ডলার। আরও একটি চুনি পরেন ৫০ হাজার ডলার দামের। এছাড়া পরেন ৫০ হাজার ডলার দামের একটি হীরা ও এক লাখ ডলার দামের একটি পালা (এমেরাল্ড)। প্রতিদিন তিনি গোসল করেন গোলাপ পানিতে। নিত্য দিনের চলাফেরায় অথবা বিশেষ কোন অনুষ্ঠানে তিনি ৭০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের গহনা-অলঙ্কার পড়েন। একবার ড.মুসা ১৯৯৪ সালে সর্বপ্রথম তার বন্ধু ব্রিটেনের বিরোধী দলীয় নেতা (পরে প্রধানমন্ত্রী) টনিব্লেয়ারের নির্বাচনী ফান্ডে ৫০ লাখ পাউন্ড অনুদান দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে বিশ্বদরবারে আলোচনায় উঠে আসেন। একজন বিদেশী নাগরিক হওয়ায় টনি ব্লেয়ার অবশ্য সে অনুদান গ্রহণ করেননি।
এরপরেও নানা কর্মকান্ডের মাধ্যমে এ ব্যবসায়ী মাঝে মধ্যেই বিশ্ব মিডিয়ার আলোচনা বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছেন। লোক মুখে আছে তার বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য জীবনের অনেক চমকপ্রদ কাহিনী। ১৯৯৭ সালে ড. মুসা বিন শমসের তার ইউরোপিয়ান সদর দপ্তর হিসেবে একবার আয়ারল্যান্ডের কালকিনি দুর্গ কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সফল হননি।
প্রিন্স মুসার বিশ্বখ্যাতি অমিত সম্পদশালী এক ধনকুবের হিসেবে। তবে কেউ জানে না কত তার ধনসম্পদ। হয়তো নিজেও তিনি জানেন না। মনে করা হয়, তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ধনীদের অন্যতম একজন । তার জীবন যাপনের কথা ও কাহিনী দেশে ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে আছে কিংবদন্তির মতো। লোকের মুখে-মুখেও আছে তার বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য জীবনের অনেক চমকপ্রদ চাঞ্চল্যকর ঘটনার বিবরণ।
বৃটেনের দ্য উইকলি নিউজ ‘গোল্ডফিঙ্গারস্! ম্যান উইথ দ্য মিডাস টাচ ওন্ট জাস্ট রাইট অফ ফ্রোজেন এসেটস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে লিখেছে, ড. মুসা বিন শমসের বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী হয়েছেন আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসা, তেল বাণিজ্য ও কেনাবেচার দালালির মাধ্যমে। ড্যাটকো নামে রয়েছে তার জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আইরিশ ডেইলি মিরর ‘ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন পেন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ছয়জন দুর্ধর্ষ দেহরক্ষী ছাড়া তিনি কোথাও যান না, চলাফেরা করেন না। ২৭ শে মে, ২০১২ ডেটলাইনে অনলাইনে প্রাপ্ত এক পরিসংখ্যানে লেখা হয়েছে, মুসা বিন শমসেরের অর্থের পরিমান ১.৫ বিলিয়ন ইউ এস ডলার।
একবার মুসা বিন শমসেরের ব্যাংক এ্যাকাউন্টের তথ্য চেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মুসা বিন শমসেরের ব্যাংক এ্যাকউন্টের তথ্য চেয়ে সকল তফসিলী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাছে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু এ ব্যবসায়ী নয়, এর সঙ্গে জড়িত স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসেবেরও তথ্য ৭ কার্যদিবসের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগে জানানোর জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। অর্থ পাচার সন্দেহে এ নির্দেশ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগের যুগ্মপরিচালক একেএম এহসান স্বাক্ষরিত চিঠিতে ব্যাংকগুলোকে এ নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
তখন জানা গিয়েছিল, মুসা বিন শমসের ব্যাংক হিসেবে খোলার সময় গ্রাহক পরিচিতি (কেওয়াইসি) সম্পূর্ণভাবে প্রদান করেননি। ফলে কেওয়াইসি`র দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দেশ থেকে অর্থ পাচার করা হতে পারে মনে করা হয়। অর্থ পাচারের সন্দেহেই শমসের ও তার সঙ্গে জড়িত সকলের ব্যাংক হিসেব লেনদেনের তথ্য চেয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, প্রিন্স মুসা বিন শমসের পিতার নাম শমসের আলী মোল্লা, জেলা, ফরিদপুর। বর্তমান ব্যবসায়িক ঠিকানা, বাড়ি নম্বর-৫৭, রোড নম্বর-১, ব্লক-১, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি অর্থণীতির ম্যাগাজিনে বলা হয়, ৭০ দশকের মাঝামাঝিতে বহির্বিশ্ব প্রাচ্যের এক স্বল্প বয়সী যুবকের ধুমকেতুসম বাণিজ্যিক উত্থান লক্ষ্য করে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিল। সৌদি আরব এবং কাতারে প্রবাসী এই খ্যাতিমান বাংলাদেশী ব্যাবসায়ীর উত্থান সত্যিই উল্কার মত ঝলকে উঠেছিল। আরব্য রজনীর গল্প-কাহিনীসম তাঁর বিস্ময়কর জীবন-কথা নিয়ে রচিত উপাখ্যান ৮০ দশকের বিশ্ব-গণমাধ্যমে বারংবার শিরোনাম হয়। পশ্চিমা বিশ্বে দারুণভাবে সাড়া জাগানো বাংলাদেশী এই খ্যাতিমান অস্ত্র-ব্যবসায়ী যেন রূপকথার রাজপুত্রের মর্যাদাই লাভ করে দেশ মাতৃকার ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল করে তোলেন। অত্যাশ্চার্য্য ও কীর্তিমান এই ভাগ্যবান পুরুষই ডঃ মুসা বিন শমসের।
জানা যায়,তিনি বাংলাদেশের শিক্ষিত ও পেশাদার নর-নারীদের জন্য ইটালীতে কাজের সুযোগ করে দেন। বাংলাদেশের ডিপ্লোমা নার্সিং কাউন্সিলের সনদ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের বিষয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাঁরই সৌজন্যে দেশের নার্সদের ইতালী ছাড়াও অন্যসব ইউরোপীয় দেশে কর্ম-সংস্থানের পথ সুগম হয়েছে। বাংলাদেশী জনশক্তির জন্য ইউরোপীয় স্বর্ণ-দ্বার ডঃ মুসার আপ্রান প্রচেষ্টায় আজ উন্মোচিত। এ কথা স্বীকার্য যে,ড.মুসা একজন রহস্যময় ব্যক্তি। তার অনেক কিছুই আমাদের অজানা। কেউ কেউ মনে করেন, প্রকৃত মূল্যায়নের অভাবে তিনি এখনও স্বদেশে এক বিরাট রহস্য।
প্রিন্স মুসার প্রাসাদ: রাজধানীর অভিজাত গুলশান এলাকার সুরম্য প্রাসাদে মুসার বসবাস। প্রাসাদের সাজসজ্জাও চোখধাধানো। লিভিংরুমসহ প্রাসাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ছাদ অবধি শোভা পাচ্ছে বড় বড় দ্যুতিময় অসংখ্য ঝালর। ঘরগুলোর মেঝে মহামূল্যবান ঝকমকে কার্পেটে মোড়া। লিভিংরুমের আকর্ষন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে সুপরিসর ডাইনিংস্পেস। সব মিলিয়ে প্রাসাদটি পরিণত হয়েছে স্বপ্নপুরীতে।
ফাইভ স্টার ফ্যামিলি: মুসার পরিবারকে বলা হয় দেশের একমাত্র ফাইভ স্টার ফ্যামিলি। কারণ, তাঁর বাসার স্টাইল-আয়োজন কর্মকান্ড সবকিছুই ফাইভ স্টার মানের।
প্রিন্স মুসা তিনটি বুদ্ধিদীপ্ত ও মেধাবী সন্তানের গর্বিত পিতা। ওরা হলেন জাহারা বিনতে মুসা ন্যান্সী, হাজ্জাজ বিন মুসা ববি ও আজ্জাত বিন মুসা জুবি। এদের প্রত্যেকেই যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। ন্যান্সী বিয়ে করেছেন শেখ ফজলে ফাহিমকে। অক্সফোর্ড স্কলার ববি বিয়ে করেছেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমামকে। আর জুবি বিয়ে করেছেন সুমী নাসরিনকে।
হাজ্জাজ বিন মুসা ববি সম্পর্কে একটি কথা না বললেই নয় যে, এই তরুন বয়সেই অভূতপূর্ব সাফল্য তার ঝুড়িতে। তিনি দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি ও পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
প্রিন্স মুসার ব্যবহৃত জিনিসপত্র : জানা যায়, হীরকখচিত যে জুতো পরেন তার প্রতি জোড়ার মূল্য লক্ষ্য ডলার। তাঁর সংগ্রহে এমনি রতœখচিত হাজারো জুতো রয়েছে। তাঁর পরনের কয়েকটি স্যুট স্বর্ণসুতাখচিত। ভারতীয় দৈনিক দি হিন্দুতে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক রাশিদা ভাগৎ।
তিনি নিত্য গোসল করেন নির্জলা গোলাপ জলে। যার পোশাক, পছন্দ-অপছন্দ বৃটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী স্যার এন্থনি ইডেনের মত। ঊনবিংশ শতাব্দির সেরা ফ্যাশনরাজ বিউব্রামেল এর সাথেই তাঁর কেবল তুলনা চলে।
ফিলিপাইনের ফাষ্ট লেডি ইমেল দ্য মারকোসের ওয়্যারড্রব ভরে থাকত ১০০ জোড়া সৌখিন জুতো। মুসা বিন শমসেরের বিলাসিতা তার চেয়েও বিস্ময়কর। তাঁর সংগ্রহে অসংখ্য মূল্যবান স্যুট রয়েছে; তাঁকে কখনো এক স্যুট পরিহিত অবস্থায় দু`বার দেখা যায় না। এমনি মূল্যবান প্রতিটি স্যুটের দাম ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার পাউন্ড। যা শুধু তাঁর জন্য তৈরী করা হয়েছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডিজাইনার বলে খ্যাত প্রিওনী বেলভেস্ট এবং ইটালীর আবলা এবং ফ্যান্সিসকো স্মলটো ও খ্রিস্টিয়ান ডিয়রের বিশেষ ব্রান্ডের অতি মূল্যবান পোশাক-আশাক দিয়েই তাঁর সারি সারি ওয়্যারড্রব ভর্তি।
তাঁর হাতের সবচেয়ে মূল্যবান ঘড়ির ডায়াল এবং ব্রেসলেট হচ্ছে হীরক খচিত। যার মূল্য অর্ধ মিলিয়ন ডলার এবং তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান ঘড়ির বেল্ট, কাফলিঙ্ক-এর সেটের মূল্য ১.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কেবল তাঁর জন্যে প্রস্তুতকৃত এই মূল্যবান ঘড়িটি তৈরী করা হয়েছিল ২৭ মাসেরও বেশী সময় ধরে। বিশ্ব বিখ্যাত রোলেক্স কোম্পানী এই অত্যাশ্চার্য্য ঘড়িটির প্রস্তুতকারক।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:০৩