বিয়ে নিয়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে না না ধরনের ফ্যান্টাসী কাজ করে। ইনবক্সে মাঝে মাঝেই সেসব ফ্যান্টাসী নিয়ে অনেকের সাথে কথা হয়, সাধ্য মত চেষ্টা করি গুছিয়ে উত্তর দেবার, একটা মানুষের সারা জীবনের প্রশ্ন।
আজকে সবার জন্যই কিছু কথা লিখি -
১) প্রেমে পড়ার সাথে সাথে মেয়েরা বিয়ে আর সংসার নিয়ে ভাবতে থাকে। এটা মেয়েদের জন্মগত ভাবে পাওয়া। ব্যাপারটা (আমার দৃষ্টিতে) এমন - একটা পাখীর ছানা জন্ম থেকেই জানে যে ওকে উড়তে হবে। ডানা গজালেই সে উড়ে যায়। তেমনি - সংসার ব্যাপারটা মেয়েদের মনের মধ্যেই থাকে। মেয়েরা খুব ছোটতেই মায়ের দেখা দেখি পুতুল নিয়ে সংসার সংসার খেলতে পছন্দ করে। ছেলে শিশুটি কিন্তু পছন্দ করে অন্য ধরনের খেলা। যদিও ছেলে আর মেয়ে শিশু দুজনের মায়ের হাতেই বেড়ে ওঠে। যা হোক, ছেলেরা সংসার নিয়ে তেমন একটা ভাবে না। প্রেমটাই মুখ্য থাকে তাদের কাছে। আচমকা প্রেমিকার কাছ থেকে বিয়ে বা সংসারের কথা শুনলে ছেলেরা হকচকিয়ে যায়। এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে - একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে দৈহিক গঠনের পার্থক্যের চাইতেও মন মানষিকতার পার্থক্য অনেক বেশী।
২) জীবনটা নাটক সিনেমা না। রোজ সকালে মেকআপ করা, গহনা গায়ে, হাসি হাসি মূখে জেগে ওঠা - এগুলো কি আসলেও সম্ভব? সম্ভব না। এসব ফ্যান্টাসী থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। প্রেম হচ্ছে জীবনের মধুরতম সময়। প্রজাপতির ডানায় সময় উড়ে চলে। বিয়ের পরে এই সময়গুলো, এই আবেগের রঙ গুলো ফিকে মনে হয় অনেকের কাছে। কারণটা খুব সিম্পল - প্রেম করার সময় দুজনেই যথাসাধ্য সেজেগুজে আসে, নিজেকে উপস্থাপন করে সুন্দর ভাবে, কথাবার্তায় পোষাক আষাকে। আর থাকে কাছে পাবার তীব্র ইচ্ছা। বিয়ের পর আর সেই চমকটা থাকে না। তাই বলে বিয়ের পর কি জীবন পানসে হয়ে যায়? মোটেও না, তখন শুরু হয় অন্য একটা রঙ্গীন জীবন। যার সাথে ফেলে আসা জীবনের মিল অনেক কম। ইচ্ছে করলেও সেই জীবনে আর ফিরে যাওয়া যায় না।
৩) এরেঞ্জ ম্যারেজের ক্ষেত্রে অনেক মেয়ে ছেলেটাকে দেখে একটা স্পার্ক খোঁজে। ছেলেরাও খোঁজে হয়তো, তবে মেয়েদের মত এত বেশী না। ছেলেরা বেশী প্র্যাক্টিকাল হয়। বিয়ে একটা অনেক বড় দায়িত্ব। প্রেমের বিয়েতে ছেলেদের যতটুকু আবেগ কাজ করে, এরেঞ্জ ম্যারেজে তা থাকে না। তবুও ছেলেরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই যে মেয়ের সাথেই বিয়ে ঠিক হয়, তাকে ঘিরেই স্বপ্ন সাজাতে শুরু করে, অনেক মেয়ের জন্য যা নিতান্তই অসম্ভব বলে মনে হয়। প্রথম দেখা বা প্রথম কথায় মেয়েটা চায় ছেলেটা তাকে ইমপ্রেস করুক, সেই একই মুহুর্তে ছেলেটা নার্ভাস হয়ে সব গুলিয়ে ফেলে। মেয়েটি তখন ভাবতে বসে - এর সাথে সারাটা জীবন কিভাবে কাটাবো? আর ছেলেটা ভাবে - এসব আমি কি বললাম? খুব কম মানুষই প্রথম দেখায় একে অপরকে পছন্দ করে।
দুটো মানুষ সারা জীবন একসাথে থাকে মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে ... এই মায়াটা একদিনে তৈরী হয় না।
৪) নিজের ভালবাসার বা ভাল লাগার অথবা মনের মত মানুষটিকে বিয়ে করতে পারে খুব কম মানুষ। বিয়ের পরে তাদের জীবনটা নাটক সিনেমার মত সুন্দর হয় আরও কম মানুষের। ভালবাসা বিয়ের আগেই হোক কিংবা পরে, এক সাথে সংসার করা জিনিসটা একেবারেই আলাদা।
৫) বিয়ের মুহুর্ত থেকে নয়, বিয়ের কথা পাকাপাকি হবার পর থেকেই জীবন বদলে যেতে শুরু করে। এই পরিবর্তনটা মেনে নিতে হয়। এটা বাস্তব যে বিয়ের পরে মেয়েরা আর কোন ভাবেই বিয়ের আগের জীবনে অভ্যস্ত হতে পারে না। বিয়ের মুহুর্তের আগে পর্যন্ত যে ঘরে মেয়েটার জীবন কাটে, বিয়ের পরে বাবার বাড়ী বেড়াতে এসে সেই ঘরেই মেয়েটার বোর লাগে, মন পড়ে থাকে তার নতুন ঘরে। বিয়ের আসর থেকে চলে যাবার সময় মেয়েরা যে কান্নাকাটি করে, নিজের মা বাবা ভাই বোন, নিজের ঘর, নিজের পরিবেশটা ছেড়ে যাচ্ছে বোলে, সেই পরিবেশেই বিয়ের পরে নিজেকে অতিথি বলে মনে হতে থাকে। এটাই স্বাভাবিক। অথচ ছেলেদের ক্ষেত্রে এটা তেমন হয় না। আল্টিমেটলী, ছেলেরা তো আর নিজের বাড়ী ছেড়ে যায় না।
৬) ছেলেদের বলি - বিয়ের কনে'টিকে ইমপ্রেস করতে আয়রন করা দামী স্যুট বুটের দরকার নেই। মেয়েরা জন্মগত ভাবে গোছানো স্বভাবের। ওরা অগোছালো জিনিস গুছিয়ে দিতে পছন্দ করে। যে মেয়েটি জীবনে কখনও নিজের ঘর গুছায় না, প্রিয় মানুষটির এলোমেলো চুল ঠিক করে দিয়ে, শার্টের কলার সোজা করে দিয়ে, রুমালটি ভাজ করে দিয়ে তারা অসম্ভব সুখ পায়। মেয়েরা পছন্দ করে এটেনশন ও কেয়ার পেতে। আমার ব্যাক্তিগত অভিমত - বিয়ের কনে'টির সামনে নিজেকে আহামরি কিছু প্রমাণ করবার চাইতে খুব সিম্পল, কেয়ারিং, ভাল মানুষ হিসেবে প্রেজেন্ট করাই ভাল। কোন আড়াল বা ছদ্মবেশ নয়, আপনি যা, আপনি তাই - এভাবেই কথা বলবেন। মেয়েটি খুব সম্ভবত সারাজীবন আপনার সাথেই থাকবে, কাজেই আপনার আসল রূপ টের পেতে তার দেরী হবে না। কাজেই - নো হাঙ্কি পাঙ্কি।
৭) বিয়ে শুধু একটা অনুষ্ঠান নয়, একটা মেয়েকে ঘরে নিয়ে আসাও নয়, বিয়ে একটা নতুন জীবনের সূচনা। একটা ছেলে বা একটা মেয়ে বিয়ের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত একাই থাকে, একাই ভাবে নিজেকে, একা একাই সিদ্ধান্ত নেয়, নিজেই সেটা বাস্তবায়ন করে। সে সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে তার পরিবার আর তার সমাজ। বিয়ের পর এই ভাবনা বা সিদ্ধান্তগুলো নিতে হয় দুজনে মিলে। দুজনে মিলে হাঁটতে হয় জীবনের পথে, দুজনে মিলেই পেরুতে হয় দূর্গম চড়াই উৎরাই। বিয়ের আগে থেকেই এই জিনিসটা মাথায় রাখা খুব দরকার। "মা, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি" - বলে আমরা ঘর থেকে বেড়িয়ে যাই, চিন্তাও করি না যে মা অথবা বাবা একা একা ঘরে কি করবে। দরকারও নেই অবশ্য। কারণ আমরা ভাবি, মা বাবার করার মত অনেক কিছুই আছে ঘরে। বিয়ের পরে এই হুট করে রেড়িয়ে যাবার স্বাধীনতাটুকু অনেক সময়েই পাওয়া যায় না। অনেক কিছু চিন্তা করে ঘর থেকে বের হতে হয়। এটাই স্বাভাবিক, এটাই হয়। প্রস্তুতি নিতে হবে আগে থেকেই।
৮) বিয়ের আগে কিছু ডাক্তারী পরীক্ষা করিয়ে নেয়াটা খুব দরকারী। ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হলেও এটা করতে হয়। কে জানে কার শরীরে লুকিয়ে আছে কি রোগ? দুটো উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করার চেষ্টা করি - স্বামী স্ত্রীর রক্তের গ্রুপের কি একটা সমস্যার কারণে ভবিষ্যত সন্তানের জীবন বিপন্য হতে পারে। আবার অনেকে ডেড স্পার্ম অথবা লো স্পার্ম কাউন্ট সমস্যা নিয়ে জন্মায় অথবা কোন আঘাতের কারণে ডেড স্পার্ম হতে পারে, এক্ষেত্রে বিয়ের পরে বাচ্চা কাচ্চা না হওয়ায় কারণে পরীক্ষা করে বিশাল একটা আঘাত পাওয়ার চাইতে আগেই পরীক্ষা করে নেয়াটা ভাল না? আমার খুব প্রিয় দুজন মানুষের একটা সমস্যার কথা বলি। ওদের প্রথম সন্তান হবার পরে ওরা জানতে পারে বাচ্চার শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ রক্ত তৈরী হয় না, কাজেই তাকে প্রতি মাসে রক্ত দিতে হয়। এই রোগটা বাচ্চাটা পেয়েছে তার মা'র কাছ থেকে। তাদের সন্তান যদি ছেলে হয়, সে রক্তের এই সমস্যা নিয়ে বেড়ে উঠবে, মেয়ে হলে সে হবে এই রোগের বাহক। ভয়ঙ্কর না?
৯) বিয়ের পরেই একটা মেয়ে তার পরিচিত গণ্ডী ছেড়ে চলে আসে অন্য একটা পরিবেশে। শুধুমাত্র একটা মানুষকে সঙ্গী করে শুরু করে নতুন পথে হাঁটা। এক্ষেত্রে ছেলেটার সাপোর্টটাই সব চাইতে বেশী দরকার হয় একটি মেয়ের। সম্পুর্ণ নতুন একটা পরিবেশ, নতুন বাসা, নতুন নতুন আত্নীয় স্বজন - সময় তো লাগবেই মানিয়ে নিতে। মনে রাখতে হবে - বাসায় নতুন এই মেয়েটিকে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাপোর্ট দেয়াটাই কেয়ারিং, তার উপর কর্তৃত্ব ফলানো নয়। সময়ই বলে দেবে কে সংসারের হাল ধরবে।
১০) শারিরীক ব্যাপারগুলোর জন্যও নিজেকে তৈরি করতে হবে। বিয়ের পর এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা ঘটবেই। তাই বলে বাসর রাতেই কিছু একটা করে ফেলতে হবে - এটা ভাবা ঠিক নয়। একটা মেয়ে তার পরিচিত পরিবেশ ফেলে চলে আসছে আরেকটা অজানা পরিবেশে, ভয়, অনিশ্চয়তা, প্রিয়জনকে ছেড়ে আসার কষ্ট - সম্পুর্ণ ডিপ্রেসড একটা মেয়ের সাথে অনেক ছেলেই বাসর রাতে যা করে, তাকে সোজা ভাষায় ধর্ষন বলা যায়। বাসর রাতটা গল্প করে কাটিয়ে দিলে ক্ষতি কি? পাশাপাশি দুটো মানুষ থাকতে গেলে শরীর জেগে উঠবেই, শরীর সাড়া দেবেই। বিয়েটা সারা জীবনের ব্যাপার, বউ তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আর নীল ছবিতে যা দেখায়, তা অতিরঞ্জিত। বাস্তবে ব্যাপারটা অনেক আলাদা। এটা চরমতম ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ, ভালবাসাটাই মুখ্য, আর কিছু নয়।
১১) "আমি তো ওকে ভালবাসি, একে না" - দুটো মানুষ পাশাপাশি থাকলে ভালবাসা জন্মাতে দেরী হয়না। ভালবাসা এমন একটা জিনিস, যেটা একজনকে দিলেই ফুরিয়ে যায় না। সময় সব ঠিক করে দেয়। মানুষ মানিয়ে নেয়, মানুষকে এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে। ভালবাসার ক্ষেত্রে কেউ কাউকে ঠকাতে পারে না, যার যতটুকু ভালবাসা প্রাপ্য, সে ততটুকুই পায়, ততটুকুই দেয়। নিজের কাছে সৎ থাকতে হয়, ভালবাসার কাছে সৎ থাকতে হয়। কম্প্রোমাইজ করতে হয়। এটাই জীবন।
১২) "আমি তো ভার্জিন না, আমার বর কি সেটা বুঝতে পারবে?" - না, পারবে না। ডাক্তারী পরীক্ষা ছাড়া এটা বোঝা সম্ভব না। আর ভার্জিন না বলতে বোঝায়, Hymen নামের পর্দাটা ছিড়ে যাওয়া, এটা শুধু সেই কারণে না, অনেক কারণেই ছিড়ে যেতে পারে, বিশেষ করে যেসব মেয়েরা খেলাধুলা করে, দৌড়, হাই জাম্প, লং জাম্প দেয়, ওদের ক্ষেত্রে এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
১৩) "ও আমাকে অনেক ভালবাসে, বিয়ের পরেও কি বাসবে?" - বাসবে, যদি আপনি সেই ভালবাসার রঙ্গধনূটা মাঝে মাঝে রাঙ্গিয়ে নিতে পারেন। ভালবাসার মানুষটির সাথে এক ছাদের নীচে বসবাস করেও সকাল সন্ধ্য একই মানুষের মুখ দেখাটা বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, যদি না ভালবাসাটা ধরে রাখা যায়। ভালবাসা দিতে হবে, ভালবাসা আদায় করে নিতে হবে। চমকে দিতে হবে, ভালবাসায় সিক্ত করতে হবে।
১৪) "ও কেমন যেন বদলে গেছে বিয়ের পর, আমাকে আর ভালবাসেনা আগের মত" - আপনি নিজেও গেছেন বদলে, ভেবে দেখুন। পানসে করে ফেলেছেন ভালবাসাটাকে। হয়তো না বুঝেই বেশী চাপ দিয়ে ফেলছেন তার উপর, অগোছালো, এলোমেলো ছেলে বা মেয়েটা সোজা করার দায়িত্ব নিয়ে তার স্বাভাবিক জীবন থেকে তাকে সরিয়ে আনতে চাইছেন। ভুলে যাবেন না, সে এইভাবেই বেড়ে উঠেছে, এই পরিবেশেই। প্রতিটা মানুষই আচার আচরণে জীবন ধারণের ধরণে আলাদা। আপনি একটা মানুষকে হুট করে বদলে দিতে চাইলে তাকে কেবল দূরেই সরিয়ে দেবেন। সময় দিতে হবে, একটু একটু করে তাকে অভ্যস্ত করতে হবে নতুন জীবনধারায়।
১৫) "আমার আর পড়ালেখা করতে ভাল লাগে না, চাকরীও না, বিয়ে করে ফেলি?" - পালিয়ে যেতে চাইছেন ধরাবাঁধা নিয়ম আর পরীক্ষার কাছ থেকে? আপনার সামনে খুব সাধারণ একটা উদাহরণ আছে, আপনার মা। দেখুন - তিনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কি পরম মমতায় আগলে রাখেন সংসার। কি কঠিন একাগ্রতায় জীবন খাতায় উত্তর লেখেন। কি কঠিন নিয়মানুবর্তিতায় ঠিক সময় মত আপনাকে খেতে দেন, প্রতিদিন রান্না করেন, বছরে ৩৬৫ দিন। আপনি তো তবুও ছুটি পান মাঝে মাঝে, মা কিন্তু ছুটি নেন না। মাথায় রাখবেন এগুলো।
বিয়ে - সৃষ্টির পথে এগিয়ে যাবার একটা ধাপ। বিয়ে দুটো হৃদয়ের মিলনে পূর্নতা পাওয়া একটা বৃত্ত। বিয়ে একটা সমঝোতা, বিয়ে মানে মেনে নেয়া, বিয়ে মানে মানিয়ে চলা। যত সহজভাবে এই ব্যাপারগুলো নিতে পারবেন, ততই সহজ স্বাভাবিক হবে জীবন।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:১১