শেষ কিস্তি
টিপাই বাঁধ : বাস্তবায়িত হলে ধ্বংস হবে সিলেটসহ বিশাল অঞ্চল
সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা নদীর উজানে বরাক নদীতে ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করার সমস্ত দাপ্তরিক আয়োজন ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছে। অতীতে ফারাক্কা বাঁধের মত একতরফাভাবে ভারত টিপাই বাঁধের ক্ষেত্রেও কোন প্রকার আন্তর্জাতিক নিয়ম নীতি ধর্তব্যে আনছে না। ২০০৩ থেকে বাংলাদেশের সর্বসাধারণ এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। বাংলাদেশের অমলসিদ সীমান্ত থেকে ১৯৫ কিলোমিটার উজানে আসাম-মিজোরাম সীমান্তে টিপাইমুখ গ্রামের সন্নিকটে তুইভাই এবং বরাক নদীর মিলনস্থলের ৫০০ মিটার নিচে এ বাঁধ নির্মাণ হবে। বাঁধ নির্মাণের নেপথ্যে ভারত সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে ১৫ শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। এ বাঁধের উচ্চতা হবে ১৬২.৮ মিটার যা ৫০ তলা বিল্ডিংয়ের সমান উঁচু। প্রস্তাবিত এ ড্যামের জন্য ব্যয় নির্ধারণ হয়েছে ৬ হাজার ৩ শ’ ৫১ কোটি রুপি। ভারত সরকারের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মধ্যেও এ বাঁধের পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে একটু পরে বিস্তারিত আলোচনা হবে। ১৯৮৪ সালে প্রথম টিপাই মুখ বাঁধের প্রস্তাব আসে। পরবর্তীতে তা প্রত্যাখ্যাত হলে ১৯৯৫-এ ব্রহ্মপুত্র বোর্ডের বাঁধ নির্মাণের প্রতিবেদন অনুসারে ২০০৩ সালে অনুমোদিত হয়। ২০০৪-এর ২৩ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং টিপাইমুখ বাঁধের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের ঘোষণা দেন। বাঁধের কারণে আসাম-মিজোরামে ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ উঠলে তা এক পর্যায়ে স্থগিত হয়ে যায়। ২০০৬-এর ডিসেম্বরে ভারতের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী ও ভারী শিল্পমন্ত্রী চূড়ান্তভাবে বাঁধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বাঁধের নির্মাণ কাজ ২০১১ সালে সমাপ্ত হবে বলে ভারত সরকার ঘোষণা করে।
ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং পরিচালিত এক সমীক্ষায় বলা হয়, এ বাঁধ চালু হলে বরাক নদীর অমলসিদ পয়েন্টে পানি প্রবাহ কমে যাবে যথাক্রমে জুন মাসে ১০%, জুলাইয়ে ২৩%, আগস্টে ১৬% এবং সেপ্টেম্বরে ১৫%। পানির গড় উচ্চতা অমলসিদ পয়েন্টে জুলাই মাসে এক মিটারের বেশি নেমে যাবে এবং এ গড় উচ্চতা হ্রাস পাবে যথাক্রমে ফেঞ্চুগঞ্জ, শেরপুর ও মারকুলি স্টেশনে ০.২৫, ০.১৫ ও ০.১ মিটার করে। একই সময়ে সুরমা নদীর কানাইঘাট এবং সিলেট স্টেশনে পানির গড় উচ্চতা হ্রাস পাবে যথাক্রমে ০.৭৫ ও ০.২৫ মিটার করে। সিলেট-সুনামগঞ্জ মৌলভীবাজার এলাকার হাওরগুলো সুরমা-কুশিয়ারা থেকে পানি পায়। কিন্তু এ দুই নদীতে পানি প্রবাহ কমে গেলে সিলেটের ৩০ হাজার ২ শ’ ১৩ হেক্টর এবং মৌলভীবাজারের ৫ হাজার ২ শ’ ২০ হেক্টর এলাকা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে। শুকিয়ে যাবে কুশিয়ারা নদীর বাম তীরে অবস্থিত কুশিয়ারা-বরদাল হাওর। ক্ষতিগ্রস্ত হবে কাওয়ার দীঘি হাওর ও হাকালুকি হাওর। এর প্রভাব পড়বে গোটা এলাকার ভূ-প্রকৃতির উপর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাবে। শুষ্ক মৌসুমে স্রোত কমে যাওয়ার কারণে বাঁধের ১০০/১৫০ কিলোমিটার নিম্নাঞ্চলে নদীর তলদেশে ক্রমান্বয়ে পলি জমার পরিমাণ বাড়বে এবং এর ফলে বর্ষাকালে নদীর প্রবাহ দুই তীর ছাপিয়ে বন্যা সৃষ্টি করবে, ভাঙনের হার বাড়বে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মেঘনার পানি প্রবাহে ভাটা পড়লে সমুদ্রের লোনা পানি অধিকমাত্রায় ভেতরের দিকে প্রবেশ করতে থাকবে যার নিশ্চিত পরিণতি মরুকরণ। সমুদ্রের লোনা পানি একদিকে সিলেট, অন্যদিকে গোয়ালন্দ ছাড়িয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আমাদের কৃষি-মৎস্য সম্পদ-গাছপালা-প্রাণী-পাখি অর্থাৎ গোটা জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। নদীর নাব্যতা হারানোর কারণে নৌ পরিবহন ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে। বন্যা, খরা ও নদী ভাঙনের প্রকোপ বাড়বে।
নদী সংযোগ প্রকল্প : বাংলাদেশ মরুকরণের প্রজেক্ট
ভারতীয় পানি আগ্রাসনের সর্বগ্রাসী প্রকল্প হিসেবে ইতিমধ্যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বিশেষজ্ঞ মহল কর্র্তৃক চিহ্নিত হয়েছে। আমাদের সংবাদপত্রে হাল আমলে টিপাই বাঁধ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা দেখা গেলেও আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে খুব একটা আলোচনা দেখা যায় না। অথচ টিপাই বাঁধ ভারতীয় সরকারের নদী সংযোগ প্রকল্পেরই একটা অংশ মাত্র। ভারতীয় নদী সংযোগ প্রকল্প যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটা অঞ্চল নয় গোটা দেশই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবে। প্রকল্পের বিশাল অবয়বের কারণে অনেকে এর নাম দিয়েছে মেগা প্রজেক্ট। এ প্রকল্পের আওতায় ভারতের ৩৮টি নদ-নদীর মধ্যে আন্তঃসংযোগ ঘটানো হবে। নদ-নদীগুলোর সংযোগ সাধনে ৩০টি সংযোগ খাল কাটা হবে। পাশাপাশি ছোট-বড় ৩৪টি এবং ৭৪টি বড় জলাধার নির্মাণ করা হবে।
সংযোগ খালের মাধ্যমে গঙ্গা থেকে পানি নিয়ে যাওয়া হবে গুজরাট, হরিয়ানা, রাজস্থান, তামিলনাডু প্রভৃতি এলাকায়। এতে গঙ্গাতে যে পানি সংকট হবে তা পূরণ করা হবে ব্রহ্মপুত্রের পানি দিয়ে। এভাবে মোট ১৭৪ বিলিয়ন পানি খরা অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের পানির উচ্চতা গঙ্গা ও অন্যান্য নদী থেকে অনেক নিচু। তাই এখানকার পানি পাঁচটা ধাপে ১০০ মিটার উঁচুতে তুলতে হবে। এজন্য লাগবে শত শত পাওয়ার পাম্প, আর এগুলো চালু রাখার জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ। প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পের ব্যয় এর অনেকগুণ বেশি হবে, তা এক পর্যায়ে ৫ শত বিলিয়ন ডলারকেও (৩৫ লক্ষ কোটি টাকার অধিক) ছাড়িয়ে যাবে। এর সঙ্গে যোগ হবে প্রকল্পের পরিচালনা ও আনুষাঙ্গিক খরচ।
নদী সংযোগ প্রকল্পের প্রথম প্রস্তাব নিয়ে আসেন ড. কেএল রাও। ১৯৮৭ সালে ভারত সরকারের গৃহীত জাতীয় পানি নীতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল জাতীয় নদীগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালাম ২০০২ সালের ১৫ আগস্ট দেশের স্বাধীনতা দিবসে যে ভাষণ দেন তাতেও এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকটি বেশ গুরুত্ব পায়। ২০৪৩ সালের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের সীমা নির্ধারিত হলেও পরে তা স্থির করা হয় ২০১৬। ১৯৭০-এর দশকে ভারত বাংলাদেশের কাছে এ অঞ্চলের উপর দিয়ে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সংযোগ খাল খননের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু এর ফলে অনেক নদী স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন ও প্রায় চার কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়াসহ বহুবিধ মানবিক-প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কায় বাংলাদেশ তা প্রত্যাখ্যান করে। ওই সময়কার ভারতীয় প্রস্তাব বর্তমানে নদী সংযোগ প্রকল্পে বাস্তবায়নাধীন। বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, নদী সংযোগ প্রকল্পের প্রস্তাবিত সংযোগ খালের প্রস্থ হবে ১০০ মিটার এবং গভীরতা ১০ মিটার। এ মাপের একটা খাল ১ লক্ষ/১ লক্ষ ৪০ হাজার কিউসেক পানি বহন করতে পারে। অথচ শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার সর্বনিম্ন গড় প্রবাহ হল ৬০ হাজার কিউসেক অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্রের ১ লক্ষ ১০ হাজার কিউসেক। এ থেকে স্পষ্ট হয়, কলকাতা বন্দর বাঁচাতে গিয়ে পদ্মা যে দশা বরণ করেছে ভারতীয় শাসকদের পরিকল্পনা অনুযায়ী দক্ষিণ ভারতকে শস্য-শ্যামল করতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রেরও একই দশা হবে। তার শাখা নদীগুলো ক্রমান্বয়ে মরে যাবে। মরুকরণ শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলেই নয়, উত্তরবঙ্গসহ গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ, ব্রহ্মপুত্রের পানির উপর শুধু উত্তরাঞ্চলের ধরলা, দুধকুমার ইত্যাদি নদীই নয় মধ্যাঞ্চলের (ঢাকা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি) পুরনো ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা এমনকি নিম্ন মেঘনা (চাঁদপুর, নোয়াখালী, ভোলা) অববাহিকার নদীগুলোও নির্ভরশীল। সবাই জানে, পদ্মা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রের মিলিত স্রোতই নিম্ন মেঘনা নামে পরিচিত। আর শুষ্ক মৌসুমে এর পানি প্রবাহের ৯০ ভাগ আসে ব্রহ্মপুত্র থেকে। নদী সংযোগ প্রকল্পের পরিণামে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র শুকিয়ে গেলে সারাদেশে মরুকরণের পাশাপাশি কৃষি, শিল্প, পরিবহন, নদীর তীর ভাঙনসহ আরো বিভিন্ন পর্যায়ে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে দেশ।
দূষণ এবং আগ্রাসনের কবলে রাজধানীর নদী
আন্তর্জাতিক নদীতে ভারত সরকারের বাঁধের পাশাপাশি রাজধানীর নদীগুলো ভয়ানক আগ্রাসন ও দূষণের শিকার। মূলত সরকারি-বেসরকারি আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইতিমধ্যে এ অঞ্চলের নদীগুলোর বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখলের শিকারে পরিণত হয়েছে। তীরবর্তী অঞ্চল ভরাট করে দখলের পাশাপাশি কারখানাসহ গৃহস্থালীর বর্জ্য পদার্থ এখানে যত্রতত্র ফেলায় ইতিমধ্যে নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। ওয়াসার সূত্রমতে, রাজধানী ঢাকার ৮২ শতাংশ মানুষের মলমূত্র মিশছে বুড়িগঙ্গায়। এর সঙ্গে রয়েছে গৃহস্থালী ও ব্যবসায়িক বর্জ্য। প্রতিদিন রাজধানীর বিভিন্ন ধরনের বর্জ্যরে ৪৯ শতাংশ ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়। সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা ও শিল্প কারখানার বর্জ্য বহন করতে গিয়ে বুড়িগঙ্গা মারাত্মক দূষণের শিকার হয়েছে। শুধুমাত্র বুড়িগঙ্গা নয় তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী এবং বালু নদীর তীর ধরে গড়ে উঠেছে বেশুমার শিল্প কারখানা। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, প্রতিদিন হাজারিবাগ শিল্পাঞ্চল থেকে ১৬ হাজার ঘনলিটার, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থেকে ৩ হাজার ৭ শ’ ঘনলিটার দূষিত বর্জ্য মিশ্রিত পানি রাজধানীর নদীগুলোতে মিশ্রিত হচ্ছে।
’০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে ’০৭-এর জুন পর্যন্ত ১৩ দফায় বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-শীতলক্ষ্যা নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এতে খরচ হয়েছে কয়েক কোটিরও বেশি টাকা। কিন্তু উদ্ধার করা বেশির ভাগ জায়গা নদী খেকোরা আবার দখল করে নেয়। বুড়িগঙ্গা নদীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, এর প্রশস্ততা দিন দিন কমছে। বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী কামরাঙ্গীরচর, শ্যামপুর ও ফতুল্লা এলাকায় নানা ধরনের স্থাপনা গড়ে তুলে প্রতিনিয়ত নদী দখল করা হচ্ছে। দখলদাররা তৈরি করছে কাঠ, বালু এবং কলার আড়ত অথবা বসিয়েছে বাঁশের বাজার। তবে এসব স্থাপনার বেশির ভাগই প্রথম দিকে ছোট অবয়ব নিয়ে শুরু হয়। কিন্তু দিনে দিনে এগুলোর আকার বাড়তে থাকে এবং যা প্রসারিত হয় নদীর দিকে। অথচ এ বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ঢাকা শহর। কিন্তু দখল এবং দূষণে এ নদী এখন বিপর্যস্ত। রাজধানীর ঢাকার পূর্ব পাশে এক সময় যে নদী প্রবাহিত হত তার নাম বালু নদী। কিন্তু এখন তা আর নদী হিসেবে নেই। এখন এর তীরে দাঁড়ালে চোখে পড়বে ময়লা পানিতে ভরপুর ডোবা। পানিশূন্য এ নদীর মাঝদিয়ে নির্মিত হচ্ছে রাস্তা। এ রাস্তাটি এসে মিলবে আরেকটি সদ্য নির্মিত রাস্তার সঙ্গে, এ রাস্তাটি চলে গেছে বনশ্রী আবাসিক প্রকল্পের দিকে। তুরাগ নদীর অবস্থাও তথৈবচ। গত ৩ জুন তুরাগ নদীকে অবৈধ দখলদার থেকে উদ্ধারের জন্য অভিযান চালানো হয়। এ অভিযানে কিছু স্থাপনার সামান্য অংশ ভাঙ্গা হয়। অভিযানের তালিকায় থাকলেও তুরাগ পাড়ের অনেক স্থানে ভরাট করা জায়গা থেকে মাটি সরানো হয়নি। বিআইডব্লিউটিএ’র হিসাব অনুযায়ী মার্চেন্ট ডায়িং নামের একটি প্রতিষ্ঠান নির্মিত বিশাল দেয়ালের পাশে ৭ হাজার বর্গফুটি নদীর অংশ ভরাট করা হয়েছে। সোনারগাঁ টেক্সটাইলের পাশে রয়েছে ৮ হাজার বর্গফুট ভরাট অংশ। এছাড়া কয়েকটি গার্মেন্টস, ডায়িং ও টেক্সটাইল কোম্পানি মাটি ভরাট করে দখল করে নিয়েছে নদীর এলাকা। এলাকাবাসী জানায়, উচ্ছেদ অভিযানের পরে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে পড়লে আবার দখল প্রক্রিয়া শুরু হয়ে পড়বে। একই অবস্থা বিরাজ করছে শীতলক্ষ্যা এবং ধলেশ্বরীতেও।
বিশ্বজুড়ে পণ্য হিসেবে পানি
আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগেও পানিকে ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে চিন্তা করা ছিল কঠিন। তখন, ২৫ লিটার পানি ৩৫ টাকায় কিংবা ৫০০ মিলি তথাকথিত মিনারেল ওয়াটার ১২ টাকা দিয়ে নিকট ভবিষ্যতে পান করতে হবে এটা ছিল অবান্তর চিন্তা। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ব্যবসায়িক প্রক্রিয়াটা মুনাফা উৎপাদনে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মুক্ত বাণিজ্যের এ যুগে প্রাকৃতিক এবং মানব সৃষ্ট সমস্ত উৎপাদনই মুনাফার লবস্তু। যে সব বস্তু গুরুত্বপূর্ণ তা তীব্রভাবে মুনাফার শিকারে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণার বরাত দিয়ে ইকোনোমিস্ট পত্রিকা বলছে প্রতিদিন একজন মানুষকে পান করার জন্য গড়ে দুই লিটার পানির প্রয়োজন। এর বাইরে অন্যান্য আনুষাঙ্গিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রয়োজন আরো তিন হাজার লিটার পানি। গোসল, কাপড় পরিষ্কার, ভাত অথবা যে খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করা হয় তা উৎপাদনের জন্য যে পানির প্রয়োজন হয়- সব মিলিয়ে তিন হাজার লিটারের এ হিসাব। পানি ব্যবসার হিসেব-নিকেশ পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৬ সালে পানি বোতলজাত করা হয়েছে ১ লক্ষ ১৫ হাজার ৩ শ’ ৯৩.৫ মিলিয়ন লিটার। ব্যবসা হয়েছে ৬০ হাজার ৯ শ’ ৩৮.১ মিলিয়ন ডলারের। হিসাবের পরিমাণটা ’৯৫ সালের দ্বিগুণ। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন আগামী ২০১১ সালে পানি বোতলজাত করার পরিমাণ ২০০৬ সাল থেকে ৫১% বৃদ্ধি পাবে। একই সময় ডলারের মূল্যে ব্যবসার পরিমাণ বাড়বে ৪১.৮%। পানিবাহিত সমস্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাল মিলিয়ে তাকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়িক আয়োজনও প্রসারিত হবে। এ ব্যবসাকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য বিশ্বব্যাংক, ডব্লিউওটিও বর্তমানে পানি ব্যবস্থাকে প্রাইভেটাইজেশানে ছেড়ে দেয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের জাতীয় সরকারকে চাপ দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত মাসিক নিউ হ্যাম্পশায়ার সোশ্যাল জাস্টিস-এর মতে, এখনই আমেরিকার অনেক অঞ্চলে এক গ্যালন তেলের চেয়ে এক গ্যালন পানির দাম বেশি। এখানে বোতলজাত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাৎসরিক ১০ বিলিয়ন ডলারের পানীয় ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করছে নেসলে, কোকাকোলা এবং পেপসি।
অন্যদিকে ফ্রান্সের দুই বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি যথাক্রমে ভেওলিয়া এনভায়রনমেন্ট এবং সুয়েজ বিশ্বব্যাপী পানি ব্যবসাকে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই ব্যবসায় তাদের বৈশ্বিক র্যাংক হচ্ছে যথাক্রমে প্রথম এবং দ্বিতীয়। এই দুই কোম্পানি তিন মহাদেশের একশ’ বিশটি দেশের প্রায় একশ’ মিলিয়ন লোকের কাছে পানি ব্যবসা পরিচালনা করছে। এখন পর্যন্ত মোাটাদাগে ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে শুধুমাত্র খাবার পানিতে। পরিস্থিতি বলছে, বাণিজ্য শুধুমাত্র এই খাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এ সেক্টর বেসরকারি খাতে চলে গেলে, তখন পানি ব্যবস্থাপনা এককভাবে বহুজাতিকের করায়ত্তে চলে যাবে। তখন সংকটকে কাজে লাগিয়ে ইচ্ছেমত পানির দাম বাড়ানো হবে। হয়তো এমন উদাহরণ তৈরি হবে, সেচ কার্যের জন্য যে পানি তাও নিয়ন্ত্রণ করবে এসব মেগা কোম্পানি। এ অনুমানের পেছনে যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে। কারণ, ভারতের যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প তার নেপথ্য কারণ হচ্ছে, জলকে ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করা। গুজরাট, হরিয়ানা, রাজস্থান প্রভৃতি মরু অঞ্চলে পানি নিয়ে গিয়ে তারা বহুজাতিক কোম্পানিকে লিজ দেয়া আরম্ভ করবে। ইতিমধ্যে ভারতে তার কিছু উদাহরণ তৈরিও হয়েছে। বিশ্বব্যাংক এর মধ্যে হিসাব-নিকাশ শুরু করে দিয়েছে পানি খাত থেকে বছরে কত লাভ করা যায়। কুখ্যাত কীটনাশক এবং টারমিনেট বীজ কোম্পানি মনসান্তো এ খাতে বিনিয়োগ করার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। ফলে পানি নিয়ে ভারতীয় পরিকল্পনা দুই ভাগে বিন্যস্থ। একদিকে তারা হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে অন্যদিকে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পানিকে লাভজনক পণ্যে পরিণত করে হাতিয়ে নিবে মুনাফা।
নিজ বাসভূম রক্ষার্থে বাংলাদেশের করণীয়
পাঠক পুরো প্রতিবেদনে শুধুমাত্র দেশের বিভিন্ন নদীর বর্তমান চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। নদীর উপর মানব শাসন কখনোই ভালো ফলাফল তৈরি করে না। ভারতীয় নদী আগ্রাসন এবং রাজধানী ঢাকার নদী ক্রমাগত দখল ও দূষণের ভবিষ্যৎ পরিণতি ভয়াল আকার ধারণ করবে। বিস্তারিত উপস্থাপন করা এখানে সম্ভবও নয়। পদ্মা, মেঘনা এবং ব্রহ্মপুত্র প্রতিবছর ২৪ শ’ মেট্রিকটন পলি এদেশে নিয়ে আসে। নদীর পানি প্রবাহ কমে গেলে নিশ্চিতভাবে নতুন ভূমি গঠন বন্ধ হয়ে যাবে। তখন সৃষ্টি হবে এক মহাবিপর্যয়। কারণ, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে ৭ মিলিমিটার করে বাড়ছে। বিপরীতে, উপকূলে যথেষ্ট পলি পড়ায় পানি উপকূল ছাপিয়ে ভূপৃষ্ঠে উঠে আসতে পারে না। কিন্তু পলি পড়া বন্ধ হয়ে গেলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে উপকূলীয় এলাকা রক্ষার কোন উপায় থাকবে না। বর্তমানে দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ লোক প্লাবন ভূমিতে বসবাস করে। ফলে ভারতীয় নদী আগ্রাসনের কারণে ভবিষ্যতে কোটি কোটি লোক বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাবে। তাছাড়া পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে সমুদ্রের পানি জোয়ারের সময় নদীর মাধ্যমে দেশের মধ্যাঞ্চলে চলে আসবে। এতে মিঠাপানির মাছসহ জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির সম্মুখীন হবে। প্রাকৃতিক জলোচ্ছ্বাসের রক্ষাকবচ সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। নদীর লবণাক্ততার কারণে কৃষি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাবে নিচে। নতুন করে আর্সেনিক আগ্রাসনের শিকার হবে কোটি কোটি মানুষ।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় কী? টিপাই বাঁধের বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপও উল্লেখযোগ্য নয়। ইতিমধ্যে সংসদীয় টিম ভারত থেকে ঘুরে এসেছে। কিন্তু তাদের বক্তব্যে দেশের মানুষ হতাশ। কারণ, ভারত সরকার নাকি তাদেরকে ক্ষতিকর কিছু না করার কথা দিয়েছেন। আর এতেই সন্তুষ্ট সরকার। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কয়েকদিন আগে ভারত সফরে গেলেন। দেশের মানুষ আশা করেছিল পানির বিষয়টি এখানে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হবে। কিন্তু বন্দী বিনিময় বা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গ যেভাবে গুরুত্ব পেয়েছে, সেভাবে নদীর বিষয়গুলো উত্থাপিত হয়নি। অথচ নদীর বিষয় এ মুহুর্তে মুখ্য এজেন্ডা হওয়া প্রয়োজন। উপরন্তু, পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দিপুমণি ৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে সংবাদ সম্মেলনের বলেন, টিপাই বাঁধসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে ভারত নাকি বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছে কোন প্রকার ক্ষতি না করার। কিন্তু, এ ভারত সরকারই পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধের পানি প্রত্যাহারের কথা বলে ওই অবস্থান থেকে আর ফিরে আসেনি। তারা ’৯৬ সালে চুক্তি নবায়নের কথা বলে নতুন প্রহসন মঞ্চস্থ করেছিল। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অদ্যাবধি বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের একটি অংশ হচ্ছে টিপাই বাঁধ। একদিকে ভারত বলছে বাংলাদেশের ক্ষতি না করে কোন প্রকার বাঁধ নির্মাণ করবে না। কিন্তু অন্যদিকে তারা বাঁধ নির্মাণের সমস্ত অফিসিয়াল কার্যাদি চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিষয়টি ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাধ্যমে এখন আর নিরসন করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক নদী আইন বাস্তবায়নে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে সর্বত্র আলোচনার পরিবেশ তৈরিতে সরকারকে এখনই অবস্থান নিতে হবে। কারণ, অনেক প্রহর ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত। যে দুঃসময় সামনে আসছে, উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব করলে তা ঠেকানোর আর কোন পথ থাকবে না। সরকারকে উদ্যোগী করার জন্য জনসাধারণও পালন করতে পারে নানা ভূমিকা। সচেতনমূলক কর্মসূচির পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এখনি সংঘবদ্ধ হওয়া অতীব প্রয়োজন। তাছাড়া আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্ত্রে রাজনৈতিক নৈতৃত্বও যথাযথ নির্ধারণ করতে হবে। অন্যথায় অতীতের মত এ অন্দোলনও ব্যর্থ হয়ে যাবে। এক্ষেত্ত্রে জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলনের জন্য পরীক্ষিত শক্তি ইতোমধ্যে জনগণের সামনে স্পষ্ট আছে। আর এ আন্দোলনের মাধ্যমে বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনেও উপস্থাপন করা সম্ভব হবে। কারণ, এ দেশ পৃথিবীরই একটা অংশ। এখানকার বিপর্যয় শুধুমাত্র জাতীয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকবে না। দেশে দেশে সমসাময়িক কালে পরিবেশ আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে। তার সাথে এ আন্দোলন সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রক্ষার কণ্ঠস্বর আরো শক্তিশালী হবে।