বাংলাদেশ : পানি শূন্য ভয়ঙ্কর অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে
প্রথম কিস্তি
বাংলাদেশ ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে পানি শূন্য এক ভয়াল অন্ধকারের দিকে। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে নদীর পলি নিয়ে গঠিত পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ সহসা মিঠা পানি শূন্য অবস্থায় পতিত হবে। মূলত, প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র কর্তৃক এক তরফাভাবে বিভিন্ন নদীতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বাঁধ নির্মাণ, স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন নদীতে নাব্যতা রক্ষার্থে উদ্যোগ না থাকা এবং সুনির্দিষ্ট নদী নীতিমালার অভাবে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। হাল আমলে টিপাই বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংকট আরো জটিলতর হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প বা ভারতীয় সরকারের সর্বগ্রাসী আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয় জনগণের সামনে এখন উন্মোচিত। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের নতজানু নীতির কারণে এহেন উদ্যোগের বিরুদ্ধে কার্যকর বিরোধিতা দেখা যায়নি। তাছাড়া দেশের স্বাধীনতা পরবর্তী নদীর নাব্যতা রক্ষার্থে কোন কর্মসূচি গৃহীত হয়নি বললে চলে। ফলে নদীর পলি নিয়ে গঠিত এ ব-দ্বীপ সহসা ভয়াবহ পানি সংকটে আবর্তিত হতে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী চারদিনের ভারত সফর থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। দেশের মানুষ প্রত্যাশা করেছিল, এ সফরে বাংলাদেশে প্রবাহিত নদীর উজানে ভারত সরকারের বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় অবস্থান নিবেন। কিন্তু বন্দী বিনিময়, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিষয়গুলো দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির আওতায় আসলেও নদী বিষয়ে আলোচনা গৌণ পর্যায়ে রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে টিপাইমুখে বাংলাদেশের ক্ষতি হয় মত কোন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে না। কিন্তু, টিপাইমুখে বাঁধ হবে না এমন প্রতিশ্রুতি তারা দেয়নি। উপরন্তু, ভারতের সাবেক পানি মন্ত্রী সন্তোষ মোহন দেবের সংবাদপত্রে বলেন, যে কোন মূল্যে টিপাইমুখে বাঁধ হবেই। ফলে স্পষ্ট যে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে বাংলাদেশের নদী এবং পানি নিয়ে আশা জাগানিয়া কোন কিছু তৈরি হয়নি। একদিকে ভারত সরকার বাংলাদেশকে টিপাই বাঁধ নির্মিত হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, একই সময়ে তারা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ এ টিপাই বাঁধ ভারত সরকারের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পেরই একটা অংশ। বাংলাদেশের নদীর যা পরিস্থিতি তাতে এ ক্ষেত্রে সময় ক্ষেপনের কোন সুযোগ নেই। কারণ, ভারতীয় সরকার আন্তর্জাতিক নীতিমালা বা আইনকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে নদী নিয়ে সর্বগ্রাসী বাণিজ্যে লিপ্তে হয়েছে।
সংকটের নেপথ্যে
১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল মেরাগেলডিন বলেছিলেন, “এই শতাব্দীতে যুদ্ধ হয়েছে তেল নিয়ে, আগামী শতাব্দীতে এ পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়ে লড়াই হবে পানি নিয়ে”। ওই সময় কথাটির তাৎপর্য অনুধাবন করা সর্বসাধারণের পক্ষে কঠিন ছিল। কিন্তু নতুন শতাব্দীর শুরুতে পানি নিয়ে বেশ কিছু বিয়োগান্তক ঘটনা প্রাক্তন বিশ্বব্যাংক কর্তার বাণীকে সত্যতায় রূপ দিয়েছে। ইসমাইল মেরাগেলডিন বিশ্বব্যাংকের মালিকানায় পানি ব্যবসার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট করার জন্য এ বক্তব্য হাজির করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে শক্তিধর রাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত বহুজাতিক পুঁজির পানি ব্যবসা আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তিক রাষ্ট্রে ফলাফল কত ভয়াবহ হতে পারে তা ইতিমধ্যে বিভিন্ন ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে বলতে হয়, এক প্রাগতৈহাসিক অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের পানে এ দেশ ছুটে চলছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী পানীয় জল ও আবাদযোগ্য পানির সংকট দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেতি আলোচনার পূর্বে পানির বিশ্বব্যাপী হালহকিকতের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাক।
বিশ্বব্যাংক এবং ইউনিসেফের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ৬ বিলিয়ন লোকের মধ্যে ৮৮৪ মিলিয়ন লোক বিশুদ্ধ পানযোগ্য পানি সংকটে ভুগছে। পাশাপাশি গৃহস্থালী এবং অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্ত্রে ২.৫ বিলিয়ন লোক এই সমস্যায় আক্রান্ত। বর্তমান বিশ্বে পানিবাহিত রোগে মৃতের হার সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর সমস্ত হাসপাতালের প্রায় অর্ধেক শয্যাই পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রুগির দখলে থাকে। সমস্ত রোগের মধ্যে প্রায় ৮৮% স্বাস্থ্যসম্মত পানির অভাবে সৃষ্ট। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ডায়রিয়ার মত সহজ আরোগ্যগামী রোগেই প্রতিদিন মারা যায় প্রায় ৩ হাজার ৯ শ’ শিশু। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে আর্সেনিক সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা অববাহিকার প্রায় ৫৫ কোটি মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তন্মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ৬ কোটি। এখানে আর্সেনিক দূষণের কারণে প্রতি হাজারে ১৩ জনের ক্যান্সারের আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের আর্সেনিক দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে- ভূগর্ভস্থ পানির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা। নিকট ভবিষ্যতে ভারতীয় সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক যদি টিপাই মুখে বাঁধ এবং আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় তাহলে এখানকার আর্সেনিক দূষণ ভয়ানক আকার ধারণ করবে। তখন হয়তো দেখা যাবে, এই দেশের প্রায় ৮ থেকে ১০ কোটি মানুষ আর্সেনিক বিষ পানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মৃত্যুর নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে যাবে।
পানি ব্যবসার পাশাপাশি আরো এক ধরনের বাণিজ্য এখানে উন্মোচিত, তা হচ্ছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। বর্তমানে ভারত থেকে বাংলাদেশে আগত প্রত্যেকটি আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। তথ্যসূত্রে জানা যায়, হিমালয় অঞ্চলের চীনের হিসাব ব্যতিরেকে দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশে সব মিলিয়ে ৫৫২টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে পাকিস্তানে ৬টির নির্মাণ কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে, আরো সাতটি নির্মাণাধীন রয়েছে। পরিকল্পনাধীন আছে ৩৫টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ভুটানে নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে ৫টির, পরিকল্পনাধীন রয়েছে আরো ১৬টি। নেপালে ১৫টির কাজ শেষ হয়েছে। নির্মাণাধীন ও পরিকল্পনাধীন রয়েছে যথাক্রমে ২টি এবং ৩৭ টি। কিন্তু এসব সমীকরণের সমষ্টিকে ছাপিয়ে গেছে ভারতের বাঁধ কর্মসূচি। ভারত এর মধ্যে ৭৪টি বাঁধের নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফেলেছে। নির্মাণাধীন রয়েছে ৩৭টি। পরিকল্পনায় রয়েছে ৩১৮টি বাঁধ। উল্লেখ্য, ২০০৭-০৮ অর্থ বছরে ভারতের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৮৮৬ মেগাওয়াট। বিপরীতে উৎপাদিত হয়েছে ৯০ হাজার ৯৭৩ মেগাওয়াট। ঘাটতির পাশাপাশি ভারতীয় অর্থনীতির আধিপত্যবাদী নীতির কারণে ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ চাহিদা অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে। শুধুমাত্র নিজের দেশের অভ্যন্তরে নয়, ভুটান-নেপালের পানি বিদ্যুৎ ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে তার সুযোগও সে নিতে চায়। ইতিমধ্যে এ লক্ষে ভারত বেশ কিছু চুক্তি সম্পন্ন করেছে। ২০০৬-এ ভারত ৬০ বছর মেয়াদি এক চুক্তি করেছে ভুটানের সাথে। এর আওতায় ২০২০ সালের মধ্যে ভুটান থেকে ন্যূনতম ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করবে ভারত। নেপাল এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ২২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল এক প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার পুরোটাই রপ্তানি হবে ভারতে। ৫৫২টি বাঁধকে কেন্দ্র করে সর্বমোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ হচ্ছে ২ লাখ ১২ হাজার ২৭৩ মেগাওয়াট। ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে, এ ৫৫২টি বাঁধ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নদীর উজানে। এখান থেকে এক মেগাওয়াট বিদ্যুতের অংশীদারিত্ব বাংলাদেশ না পেলেও ক্ষতির শিকার হবে ব্যাপকভাবে।
পরিস্থিতি বলছে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী পানির যে সংকট তার নেপথ্যে প্রাকৃতিক নিয়ামকের চেয়ে কৃত্রিম কারণের আধিক্য বেশি। আর এই সংকট নির্মাণের নেপথ্যে রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য। টাটা, রিলায়েন্স, জিএমআর, ল্যাঙ্কো, জয়প্রকাশ, গ্রিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট, ইউরোপীয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকসহ বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি এ ব্যবসার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত।
ব-দ্বীপের নদী পরিণত হতে যাচ্ছে পৌরাণিক কাহিনীতে
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় ‘বাঙালির ইতিহাস’ লিখতে গিয়ে বলছেন, “বাংলার ইতিহাস রচনা করিয়াছে বাংলার ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদী। এই নদ-নদীগুলোই বাংলার প্রাণ, এরাই বাংলাকে গড়িয়াছে, বাংলার আকৃতি প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে যুগে যুগে। এখনও করিতেছে। এই নদ-নদীগুলোই বাংলার আশীর্বাদ; এবং প্রকৃতির তাড়নায় মানুষের অবহেলায় কখনো বোধহয় বাংলার অভিশাপ।” বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি গড়ে উঠার ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই ছোট কয়েকটি কথার মধ্যে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। ঢাকার অদূরে মধুপুর অঞ্চল এবং রাজশাহীর বরেন্দ্রভূমির একটা অংশ বাদে এদেশের পুরো ভূখণ্ড প্রধানত গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বয়ে আনা পলি দ্বারা গঠিত। এখনও এ প্রক্রিয়ায় এখানে ভূমি গঠন অব্যাহতভাবে চলছে। তাই স্বাভাবিকভাবে এদেশের ভূ-প্রকৃতি, মানুষের জীবন-জীবিকা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, এক কথায় গোটা জীবন প্রবাহ গড়ে উঠেছে নদ-নদীকে অবলম্বন করে। সেজন্য নদ-নদীকে এদেশের প্রাণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় আলোচনা করলে দেখা যায়, অতীতে এ দেশে প্রায় ১৬ শ’ নদী ছিল। কবিয়ালরা যখন বন্দনা পরিবেশন করেন, তখন এ তথ্য তাদের মুখে মুখে শুনা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সময় বাংলায় ১২ শ’ নদীর নাম সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল। কিন্তু এখন মাত্র ২৩০টি নদীর নাম পাওয়া যায়, যদিও সবগুলো সচল নেই। শীতকালে ৬০/৬৫টির বেশি প্রবহমান থাকে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ২৫টি নদী সহসা শুকিয়ে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে ৫৭ টি। ৫৪টি এসেছে ভারত থেকে, বাকি ৩টি মায়ানমার হতে প্রবেশ করেছে। কিন্তু এ আন্তর্জাতিক নদীগুলোকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা পরবর্তী সংকট ক্রমশ তীব্র হয়েছে। কারণ হিসেবে ভারতের ভূমিকা এক্ষেত্রে স্পষ্ট। পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের খায়েশ জন্মানো এ দেশটি ক্রমাগত আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে প্রবাহিত নদীর উজানে একের পর এক বাঁধ দেয়ায়, এখানকার নদী পৌরাণিক কাহিনীতে পরিণত হতে যাচ্ছে। তথ্য সূত্রে জানা যায়, বহুল কথিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের অংশ হিসেবে ভারত ১৬টি বৃহৎ বাঁধ চালু করেছে। তন্মধ্যে ৮টি নির্মাণাধীন, ভারত তার উত্তর-পূর্বাংশে ক্রমান্বয়ে আরও ৬৪টি বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে সেগুলোর প্রকল্প প্রণয়নের কাজ চলছে। পাকিস্তান, নেপাল, ভুটানসহ ভারতের ৫৫২টি বাঁধ প্রকল্পের একটি অংশ হচ্ছে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। যা বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থার উপর আঘাত হানবে তীব্রভাবে। ফলে নিকট ভবিষ্যতে নদীর পলল ভূমি দ্বারা গঠিত বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশ এক ভয়াবহ অধ্যায়কে মেনে নিতে বাধ্য হবে।
বাংলাদেশের পানির উৎস মূলত তিনটি- আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহ, বৃষ্টি এবং ভূগর্ভস্থ পানি। এর মধ্যে নদী প্রবাহের অবদান দু’তৃতীয়াংশের বেশি (৭৬.৫%)। বাকি দু’টোর অবদান যথাক্রমে ২৩% ও ১.৫%। উল্লেখ্য, সাগরের পানির পাশাপাশি নদীর পানি বাষ্পীভূত হয়ে বৃষ্টিতে পরিণত হয়। ভূগর্ভস্থ পানির ভাণ্ডারেও নদীর অবদান বিশাল। আবার নদী প্রবাহের মাধ্যমে দেশে যে পরিমাণ পানি আসে তার ৯০ শতাংশেরও বেশি বহন করে প্রধান তিনটি নদী-ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র একাই আনে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পানি। কিন্তু, হাল আমলে একদিকে টিপাই, ফারাক্কাসহ ৫৫২টি বাঁধ মালা অন্যদিকে ভারতীয় সরকারের প্রস্তাবিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের কারণে সহসা এ দেশ পানিশূন্যে পরিণত হতে যাচ্ছে। ফলে নদীমাতৃক এ দেশের নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে গোটা দেশই মৃত্যুমুখে পতিত হবে। পৃথিবীর অনেক বড় নদীই একাধিক দেশের অভ্যন্তর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক-বহুপাক্ষিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ১৯৬৬ সালে হেলসিংকীতে গৃহীত হয়েছে আন্তর্জাতিক আইন বা নীতিমালা। বহুদেশ এ নীতিমালা গ্রহণ করে পারস্পরিক সমস্যা সমাধান করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মেকং নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ছয়টি দেশে, ইউরোপের দানিয়ুব নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ১৬টি দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। নীতিমালার ৪ ও ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত দেশ, অভিন্ন নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন অবশ্যই বিবেচনা করবে। একই কথা বলা হয়েছে ১৯৯৭-এ গৃহীত জাতিসংঘের নদী কনভেনশনের (UN Convention on the Law of Nevigational Uses of International Water Courses) ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে। লক্ষণীয়, ভারত সরকার বাংলাদেশে প্রবাহিত নদীগুলোর উজানে নিজস্ব বাণিজ্যিক প্রয়োজনে বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে এ সব নীতিমালা কোনভাবেই গ্রাহ্য করছে না।
ফারাক্কা বাঁধ : উত্তরবঙ্গের মরণ ফাঁদ
ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে সমগ্র উত্তরবঙ্গ প্রায় পানিশূন্য হতে বসেছে। ১৯৭৫-এ প্রথমবারের মত পরীক্ষামূলক ফারাক্কা বাঁধ চালুর জন্য ভারত সরকার বাংলাদেশের সাথে ৪১ দিনের পানি প্রত্যাহারের চুক্তি সম্পাদিত করে। চুক্তিতে বলা হয়, একটা স্থায়ী চুক্তি ছাড়া ভারত কোনভাবেই ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না। আর এ অনুমতি অপব্যবহার করে ভারত চুক্তির ৪১ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করতে থাকে। এর প্রতিবাদে ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল মওলানা ভাসানী ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে খোলা চিঠি দেয়। শুধু তাই নয়, উত্তরবঙ্গকে ভারতীয় পানি আগ্রাসন থেকে রক্ষার্থে তিনি ঐতিহাসিক লংমার্চ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। কর্মসূচিতে ওই সময় হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে। মওলানার লংমার্চ সে সময় দেশ বিদেশে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে। তারপরও ভারত সরকারের আধিপত্যবাদী নীতির কারণে প্রমত্ত পদ্মার অববাহিকাভুক্ত অঞ্চল এখন মরুভূমিতে রূপান্তরিত হতে বসেছে।
উল্লেখ্য, পদ্মা নদীর উৎপত্তি হিমালয়ের দক্ষিণ ঢালে ২৩ হাজার ফুট উচ্চতায় গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে। পদ্মার ভারতীয় অংশের নাম গঙ্গা। দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব দিকে প্রায় ১ হাজার মাইল অতিক্রম করে গঙ্গা নদী পদ্মা নাম ধারণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। চীনের সাথে সংযোগের মাধ্যমে নেপাল, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এটি আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে স্বীকৃত। প্রথা অনুযায়ী, একাধিক দেশের মধ্যে প্রবাহিত নদীর পানি সম্পদ এককভাবে কোন দেশ নিজস্ব প্রয়োজনের দোহাই দিয়ে ইচ্ছানুযায়ী স্বাভাবিক প্রবাহের বাইরে কৃত্রিম বা বিকল্প উপায়ে সরিয়ে নিতে পারে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক নদী নীতিমালা ন্যূনতম মেনে চলার প্রয়োজন অনুভব করেনি ভারত সরকার। ভারত গঙ্গার পানি উত্তর প্রদেশ এবং বিহার প্রদেশে সেচ কাজের জন্য ক্রমবর্ধমানহারে প্রত্যাহার করায় পশ্চিমবঙ্গের ভাগিরথী-হুগলী নদীর পানি প্রবাহ কমে আসে। সেজন্য ভারত কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সীমানার ১১ মাইল উজানে মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা নামক স্থানে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধের পরিকল্পনা করে ১৯৫১ সালে। ’৬১ সালে বাঁধের কাজ শুরু হয় এবং ’৭৪ সালে ফিডার ক্যানেলসহ সমগ্র নির্মাণ কাজ শেষ হয়। বাঁধ চালুর আগে বাংলাদেশে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ থাকতো প্রায় ৭৪ হাজার কিউসেক। গঙ্গার পানি যা পদ্মা রূপে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তার সাথে বাংলাদেশের ৩৭ ভাগ জমি এবং প্রায় ৫ কোটি মানুষের স্বার্থ জড়িত।
’৯৭ সালে সম্পাদিত পানি চুক্তি ছিল প্রহসন
ফারাক্কা বাঁধকে কেন্দ্র করে ইতিপূর্বে দু’দেশের মধ্যে প্রচুর আলোচনা এবং বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সেসব বৈঠক আদৌ কার্যকর কোন কিছু ছিল না। ক্ষমতাসীন বিভিন্ন সরকার বিষয়টি সমাধানের জন্য ভারতের সাথে আলোচনার উদ্যোগ নেয়। ১৯৭৭ সালে ৫ বছর মেয়াদি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ বিষয়ে ’৮২ এবং ’৮৫ সালে দু’টো সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হওয়ার পরবর্তীতে ’৯৬-এর ১২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ঐতিহাসিক পানি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু চুক্তি বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ উদ্যোগ প্রহসন ব্যতিত আর কিছু নয়। চুক্তির কোথাও সুস্পষ্ট লেখা নাই, বাংলাদেশ কি পরিমাণ পানি পাবে। কারণ, ১৯৯৬-এর চুক্তি অনুসারে পানির ভাগ বণ্টন হবে গঙ্গা নদীর ফারাক্কা পয়েন্টে যে পরিমাণ পানির প্রবাহ থাকে তাকে ভিত্তি করে। অর্থাৎ ফারাক্কার উজানে ভারতের উত্তর প্রদেশ ও বিহারের উপর দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা নদীর পানি চুক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অথচ উত্তর প্রদেশ এবং বিহার অঞ্চলে পানি প্রত্যাহারের কারণে ফারাক্কার পানি সংকট। ফলে এ চুক্তি যে লোক দেখানো এক ধরনের প্রহসন তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। প্রমত্ত পদ্মার অববাহিকায় গড়ে উঠা উত্তরবঙ্গের বিশাল অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী হয়ে গড়াই নদীর মোহনা পর্যন্ত সোয়াশ’ মাইল দীর্ঘ এলাকায় জেগে উঠেছে বিশাল চর। পদ্মার সাথে যুক্ত প্রায় ২০টি নদী এবং ঐতিহ্যবাহী চলনবিলসহ ওই অঞ্চলের হাওড়গুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। মহানন্দা, পাগলা, পুনর্ভবা, গড়াই, কপোতাক্ষ, চিত্রা, বারনই, মাথাভাঙ্গা, বড়াল ও ইছামতিসহ অন্যান্য নদীর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। পদ্মার নাব্যতা ও তার অববাহিকায় পরিবেশ-প্রতিবেশ, শিল্প এবং কৃষি উৎপাদন ঠিক রাখতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা ঠেকাতে হলে শুষ্ক মৌসুমে অন্তত ৫৫/৬০ হাজার কিউসেক পানি জরুরি। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে তা একটা কাল্পনিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বর্তমান শুষ্ক মৌসুমে ১০-২০ হাজার কিউসেক পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। অথচ বাঁধের পূর্বে শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকত গড়ে ৭৪ হাজার কিউসেক। এর ফলে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পূর্ব সময় থেকে বর্তমান শুষ্ক মৌসুমের সময়কাল দ্বিগুণ হয়ে পড়েছে।
শুধুমাত্র কৃষি নয়। কোটি কোটি মানুষ এ বাঁধের কারণে এখন আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এখানকার কৃষি থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যাবহারের পরিমাণ ব্যাপক আকারে বাড়তে থাকে। আর তা হয়ে পড়েছে আর্সেনিকের অন্যতম প্রধান কারণ। মানবদেহে আর্সেনিক প্রবেশ করে খাবার পানির মাধ্যমে। আমাদের দেশে অধিকাংশ স্থানে বর্তমানে ভূগর্ভস্থ পানি খাবারের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, শুধুমাত্র ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে, ভূপৃষ্ঠস্থ অর্থাৎ পুকুর, খাল-বিল, নদী-নালার পানিতে নয়। এ দূষণটা ঘটে ভূগর্ভস্থ আর্সেনিক থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্সেনিক বলয়ে যখন গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলা হয় তখন ভূগর্ভস্থ জলগহ্বর পানির উপরিতল নেমে যায়, এর ফলে পানির উপরের অংশে বায়ুর পরিমাণ বেড়ে যায়। এ বায়ুর অক্সিজেন কাছাকাছি অবস্থিত অদ্রাব্য আর্সেনাইট যৌগকে জারিত করে দ্রবনীয় আর্সেনাইট যৌগে পরিণত করে। এই জারিত যৌগ পানির সংস্পর্শে আসার সাথে সাথে দ্রবীভূত হয়ে যায়। এভাবেই ভূগর্ভের পানিতে আর্সেনিক জমা হয়। আর পানির স্তর নিচে নামার সাথে সাথে আর্সেনিক যৌগগুলোও নিচের দিকে নামতে থাকে। আবার ভূগর্ভস্থ পানি যত তোলা হয় তত জলগহ্বরগুলোতে প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে আর্সেনিক আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার যত বাড়ে আর্সেনিক দূষণ নীচের দিকে ও চারপাশে ততই বাড়তে থাকে। ফলে আজকে আর্সেনিক দূষণের কবলে এ অঞ্চলে যে ৩ কোটি লোকের জীবন হুমকিগ্রস্ত, তার জন্য প্রধান দায়ী হচ্ছে নদীর পানি হ্রাস পাওয়া। কারণ, নদীর প্রবাহ যদি স্বাভাবিক থাকতো তাহলে ডিপটিউবওয়েল দিয়ে নির্বিচারে পানি তুলে কৃষিকাজে ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ত না। আর্সেনিকের প্রভাবে মানব শরীরে কোষের শক্তি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং পরিণতিতে রুগি মারা পড়ে। এভাবে লিভার, কিডনী, ফুসফুস, পাকস্থলী ইত্যাদি ক্যান্সার আক্রান্ত হয়। ফলে রুগির বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় কিস্তিতে লিখাটি শেষ করা হবে